কত ভক্তের রক্তে রাঙানো রমনা কালীমন্দির - nagariknewz.com

কত ভক্তের রক্তে রাঙানো রমনা কালীমন্দির


একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে রমনা কালীমন্দিরের সেবায়েত ও ভক্তবৃন্দের বলিদানকে মুছে ফেলার কোনও সুযোগ নেই। ভক্তের রক্তে রঞ্জিত ঐতিহাসিক রমনা কালীমন্দিরের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত-

এই উপমহাদেশ জুড়ে ৫১টি শক্তিপীঠের পাশাপাশি অসংখ্য কালীতীর্থ ও কালীমন্দির ছড়িয়ে আছে। কালীতীর্থগুলি ঘিরে অনেক কাহিনী, লোকশ্রুতি ও মাহাত্ম্য। কিন্তু যে কালীবাড়ির কাহিনী শুনলে অশ্রু সংবরণ করা মুশকিল, তার নাম ঢাকার রমনা কালীবাড়ি। এই সেই মায়ের মন্দির যা সেবায়েত ও অগণিত ভক্তের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল। এই সেই মন্দির যা যথাস্থানে দর্শনের সৌভাগ্য থেকে ভক্তগণ বঞ্চিত। এই সেই মন্দির, যেখানে মায়ের নিত্যপুজো বন্ধ ছিল টানা ২৯ বছর।

ঢাকার রমনা কালীবাড়ি তিনশ‌ বছরের ‌প্রাচীন। ঢাকার বিশাল রেসকোর্স মাঠের আজ যেখানে রমনা পার্ক বা সোর‌ওয়ার্দি উদ্যান ও ঢাকা ক্লাব, ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ রাত পর্যন্ত সেখানেই ছিল বিখ্যাত রমনা কালীমন্দির। রমনা কালীমন্দিরের বয়স তিনশ বছর। পাঁচশো বছর আগে বদ্রীনাথ ধামের যোশীমঠ থেকে ঢাকার রমনায় এসে একটি আখড়া স্থাপন করেছিলেন সাধক গোপাল গিরি। এর ঠিক ২০০ বছর বাদে এখানে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সন্ন্যাসী হরিচরণ গিরি। কালক্রমে যা ঢাকার রমনা কালীমন্দির নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীকালে মন্দিরটি সংস্কার করেন ভাওয়ালের রানি বিলাসমণি দেবী। ঢাকা যেমন দেবী ঢাকেশ্বরীর ঠিক তেমনি রমনা কালীবাড়ির‌ও।

ঐতিহাসিক রমনা কালী মন্দিরের আঁকা চিত্র ( ১৮৩৩ )। শিল্পী যোশেফ স্কট।

রমনা কালীমন্দিরের চূড়োটি ছিল ১২০ ফিট উঁচু। মন্দিরটি ছিল দ্বিতল। বহু দূর থেকে মন্দিরের চূড়ো চোখে পড়ত। রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণের ছবিতে রমনা কালীমন্দিরের চূড়োটি দৃশ্যমান। এক‌ই চত্বরে ছিল রাধাকৃষ্ণের মন্দির, চন্ডীমন্ডপ ও আনন্দময়ী মার আশ্রম। সারাদিন রমনা কালীমন্দিরে ভক্তবৃন্দের আনাগোনা লেগেই থাকত। সন্ধ্যে নামলে মায়ের আরতি দর্শনে উপচে‌ পড়ত ভিড়। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে রমনা কালীমন্দিরে সেবায়েত ও ভক্তবৃন্দের বলিদানকে মুছে ফেলার কোনও সুযোগ নেই। ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় পাকিস্তান আর্মি। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন মেজর জিয়াউর রহমান। ২৭ মার্চ মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশ জুড়ে অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে কোতলে আম শুরু করে পাক আর্মি। সন্ধ্যায় ঐতিহাসিক রমনা কালীমন্দির দিয়ে শুরু হয় আর্মির অপারেশন। মন্দির চত্বরে অনুপ্রবেশ করে বিধর্মী সেনা।

অশান্তির আঁচ পেয়ে রমনা কালীমন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন হিন্দু জনগোষ্ঠীর অজস্র নর-নারী। নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের উপর শুরু হয় মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার। আশ্রিতদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন মন্দিরের সেবায়েত স্বামী পরমানন্দ গিরি। মিলিটারির মেশিনগানের সামনে বুক পেতে দেন অকুতোভয় সন্ন্যাসী। তপ্ত বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায় পূজারীর বুক। সেই কালসন্ধ্যায় রমনা মন্দির চত্বরে খুন হয়েছিল পাঁচশ মানুষ। হত্যালীলা সাঙ্গ হ‌ওয়ার পর ট্যাঙ্কের গোলা মেরে‌ উড়িয়ে দেওয়া মন্দিরটি। বুলডোজার ঢোকে চত্বরে। একে একে গুড়িয়ে যায় চন্ডীমন্ডপ, রাধাকৃষ্ণের মন্দির এবং আনন্দময়ী মার আশ্রম।

পুরোনো রমনা কালীমন্দির। ৭১-এর ২৭ মার্চ মন্দিরটি ধ্বংস করে দেয় পাক সেনা।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের হাত থেকে ঢাকা মুক্ত করে ভারতীয় সেনা। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ঢাকার রমনা কালীবাড়িতে আবার পুজো শুরু হবে। আবার ঢাক-কাঁসরের আওয়াজে মুখরিত হবে মন্দির। এমন আশায় বুক বেঁধেছিলেন ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়। কিন্তু যথাস্থানে মন্দিরটি পুনরায় চালু হতে দেয় নি বাংলাদেশ সরকার। শোনা যায় খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের অসম্মতি ছিল এতে। মন্দিরের অবশিষ্টাংশ‌ও বুলডোজার দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে অকুস্থলে তৈরি করা হয় রমনা পার্ক ও ঢাকা ক্লাব। ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রমনা কালীবাড়ির কার্যত কোন‌ও অস্তিত্ব‌ই ছিল না। কাজেই পুজো‌ও হয় নি।

রমনা কালীমন্দিরের বিগ্রহ।

রমনা কালীমন্দিরের পুনর্নির্মাণ ছিল বাংলাদেশের হিন্দুদের দীর্ঘদিনের দাবি। ২০০০ সালে দুর্গা পূজার সময় মন্দির পুনর্নির্মাণের দাবি মেনে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অস্থায়ীভাবেপুজো শুরু হলেও মন্দিরের কোন‌ও পরিকাঠামো গড়ে তুলতে দেওয়া হয় নি। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে খালেদা জিয়া সরকারের হিন্দু মন্ত্রী গয়েশ্বর রায় রমনা কালীমন্দির পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেন। মূল মন্দির যেখানে ছিল, সেখান থেকে অনেকটা দূরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মন্দির নির্মাণের জমি দেয় খালেদা সরকার।‌‌ অপ্রিয় হলেও এই প্রশ্ন না তুলে পারা যায় না- নিজেকে উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করা বঙ্গবন্ধু কেন ঐতিহাসিক মন্দিরটি যথাস্থানে রেখে সংস্কারের উদ্যোগ নিলেন না?

ভারত সরকারের ব্যয়ে নির্মিত নতুন রমনা কালীমন্দির।

অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তীবর্ষ উপলক্ষে রমনা কালীমন্দির পুনর্নির্মাণে উদ্যোগ নেয় ভারত সরকার। সাত কোটি টাকা খরচ হয় নতুন করে মন্দিরটি নির্মাণে। মন্দির চত্বরে একটি অতিথিশালাও গড়ে তোলা হয়েছে। আগের মন্দিরের অনুকরণে নব নির্মিত মন্দিরের শীর্ষেও একটি সুউচ্চ চূড়া স্থাপন করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফরকালে নবনির্মিত রমনা কালীমন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। শত শত ভক্তের রক্তে রঞ্জিত ঢাকার ঐতিহাসিক রমনা কালীমন্দিরের এই হল সংক্ষিপ্ত কাহিনী।

Photo sources- File.

{c574aaff-664f-400a-9e7f-928a3c7321ba}

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *