বিশেষ প্রতিবেদন: উৎসবপ্রিয় বাঙালির জীবনে যদিও বারো মাসই উৎসবময়। তারপরেও বলতে হয় মহালয়া দিয়ে বঙ্গজীবনে যে মহোৎসব পর্বের সূচনা তার অন্ত জগদ্ধাত্রী পুজো এবং রাসোৎসব দিয়ে। দেবী জগদ্ধাত্রী। নামেই দেবীর মাহাত্ম্যের পরিচয়। তিনি এই জগতের ধাত্রী। কারণ দেবী জগতকে ধারণ করে আছেন। তাঁকেই জগতের ধারিণী শক্তি বলে জেনেছি আমরা। জগৎ পালিকা তিনি। আসলে তো দেবী দুর্গারই আরেক রূপ জগদ্ধাত্রী। সেই শক্তিরই লীলা। মা দুর্গার অজস্র রূপ। এবং তার একটি জগদ্ধাত্রী। তিনি ত্রিনয়না এবং চতুর্ভূজা। দেবী জগদ্ধাত্রীর ঊর্ধ্ব দক্ষিণ হস্তে চক্র। নিম্ন দক্ষিণ হস্তে বান। ঊর্ধ্ব বাম হস্তে শঙ্খ এবং নিম্ন বাম হস্তে ধনুক ধারণ করেন। দেবীর গলায় নাগযজ্ঞোপবীত। তিনিও দেবী দুর্গার ন্যায়ই সিংহবাহিনী। তবে এই সিংহ করীন্দ্রাসুর বা হস্তিরূপী এক অসুরের ওপর দন্ডায়মান। শাস্ত্র বলছে দেবী জগদ্ধাত্রীর গাত্রবর্ণ সদ্য উদিত সূর্যের ন্যায়।
তন্ত্র ও পুরাণে জগদ্ধাত্রীর অজস্রবার উল্লেখ আছে। কেনোপোনিষদে জগদ্ধাত্রীকে উমা হৈমবতী বলে উল্লেখ করা হয়েছে । দেবা-সুরের লড়াইয়ে ব্রহ্মের তেজে বলীয়ান হয়ে দেবতারা বিজয়প্রাপ্ত হন। যদিও জয়লাভের পরেই দেবকূলের অহঙ্কার বেড়ে যায় । দেবতারা ভাবতে থাকেন, নিজেদের বলেই অসুরদের পরাস্ত করেছেন তাঁরা। দেবতাদের মিথ্যা অহঙ্কার চূর্ণ করতে যক্ষ রূপ ধারণ করে দেবলোকে আবির্ভূত হন স্বয়ং ব্রহ্ম। দেবতাদের সামনে একটি তৃণ রেখে তা স্থানচ্যুত করতে বলেন যক্ষরূপী ব্রহ্ম। অগ্নি ও বায়ু পর্যন্ত সেই তৃণখন্ডকে পুড়িয়ে কিম্বা উড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হলে ডাক পড়ে দেবরাজ ইন্দ্রের। ইন্দ্র যথারীতি ব্যর্থ হন। দেবরাজ যক্ষকে স্বরূপ উন্মোচনের অনুনয় জানালে যক্ষ অদৃশ্য হন এবং আকাশে আবির্ভূতা হন হৈমবতী উমা। ইনিই জগতের পালিকাশক্তি জগদ্ধাত্রী। দেবতারা বুঝতে পারলেন ত্রিভুবনকে ইনিই চালান, তাঁরা নিমিত্ত মাত্র।
শ্রীশ্রী চন্ডীতেও খুব সুস্পষ্টভাবেই জগদ্ধাত্রীর উল্লেখ আছে । দেবী দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধকালে বারংবার আপন রূপ পরিবর্তন করে ছলনার আশ্রয় নেয় মহিষাসুর। মহিষাসুর একবার হস্তির রূপ ধারণ করলে দেবী দুর্গা চতুর্ভূজা মূর্তিতে রণভূমিতে আবির্ভূতা হন। স্বীয় হস্তের চক্র দ্বারা হস্তির শুঁড়টি কর্তন করে হস্তিরূপী অসুরকে বধ করেন তিনি। সংস্কৃতে হস্তির আরেক নাম করি। তাই শাস্ত্রে এই অসুরের নাম করীন্দ্রাসুর। দেবী দুর্গা যেই রূপ ধারণ করে করীন্দ্রাসুরকে বধ করেন সেই রূপটির নামই জগদ্ধাত্রী। তাই জগদ্ধাত্রীর বাহন সিংহকে একটি মৃত হস্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি আমরা ।
দেবী জগদ্ধাত্রী সত্ত্ব গুণের প্রতীক। কার্তিক মাসের শুক্লা সপ্তমী থেকে নবমী তিথি পর্যন্ত দেবীকে পুজো করার বিধান রয়েছে। তবে অনেকে নবমী তিথিতেই একদিনে তিন তিথির পুজো সেরে ফেলেন । দুর্গাপুজো বাঙালির সর্ববৃহৎ উৎসব হলেও হুগলি জেলার চন্দননগর জগদ্ধাত্রীময়। নদীয়ার কৃষ্ণনগরেও জগদ্ধাত্রী পুজোই সবথেকে বড় পার্বন। হুগলি ও নদীয়া জেলার গঙ্গা তীরবর্তী আরও বহু জনপদেই ধূমধামের সঙ্গে জগদ্ধাত্রী আরাধনা হয়ে থাকে।
Photo- File and collected.