রাজনীতিতে নীতি ছাপিয়ে ব্যক্তি আক্রমণ নতুন কিছু নয়। এই বাংলাতেই ব্যক্তি আক্রমণ বহুবার শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়েছে। ব্যক্তি আক্রমণের প্রশ্নে বাম কি ডান, কেউই কম যায় না। বিপক্ষের নেতানেত্রীকে ব্যক্তি আক্রমণ করতে গিয়ে হালকা-পাতলা, আকারে-ইঙ্গিতে আদি রসের অনুপান ব্যবহার আগেও দেখা গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ব্যক্তি কুৎসা, খিস্তি-খেউড় এবং কেচ্ছা ঘাঁটার যে ধূম পড়েছে, তা অতীতে দেখা যায় নি। নেতাদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র, এই কথা কেউ বলবে না। ব্যক্তি জীবনে নেতানেত্রীরা দোরে খিল দিয়ে কে কী করেন, তা নিয়ে সমাজে কানাঘুষো চিরকালই ছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। মিডিয়ায় এইসব নিয়ে খুব বেশি হইচই করার অবকাশ আগে ছিল না। আর বছর পনেরো আগেও সামাজিক মাধ্যম খায় না মাথায় দেয়, লোকে তা জানত না।
বিজেপির নবান্ন অভিযানের দিন থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতাদের আকথা-কুকথা আর হুমকি-ধামকিতেই সীমাবদ্ধ নেই। তা বিপক্ষ শিবিরের নেতাকে যৌনগন্ধী তীব্র আক্রমণে বিদ্ধ করতেও আর দ্বিধাগ্রস্ত নয়। রাজনীতিতে আক্রমণের জবাবে প্রতিআক্রমণ মজুতই থাকে। তাই কেচ্ছা এবং পাল্টা কেচ্ছায় বাংলার রাজনীতি এখন ছয়লাপ। বলা ভাল, একে অপরের বিরুদ্ধে কেচ্ছার হাঁড়ি ভরা হাটে ফাটাতে থাকায় নাকে রুমাল চাপা দিয়েও দুর্গন্ধ এড়ানো যাচ্ছে না।
সোমবার তৃণমূলের সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা ও দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। তাঁদের কন্ঠে এখন সামাল সামাল রব। নিঃসন্দেহে ব্যক্তি আক্রমণ, কারও ব্যক্তিজীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি, কুৎসা অত্যন্ত কুৎসিত-কুরুচিকর ব্যাপার। কিন্তু মুশকিলটা হল অপরকে আঘাত করার সময় আমরা কেউই এই কথাটা মনে রাখি না। নইলে বিজেপির নবান্ন অভিযানের দিন রাজ্যের বিরোধী দলনেতার যৌন অভিরুচি নিয়ে প্রশ্ন তুলে কুৎসিত ইঙ্গিত করার আগে অন্ততঃ দশবার ভাবতেন তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ এবং কুণালের দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার কুণাল ভাল মানুষের মতো সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন- “শুভেন্দু কেন অভিষেককে এত হিংসে করেন? রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবে। কখনও তা তীব্র হবে। কিন্তু পিতৃপরিচয় তুলে আক্রমণ কেমন রাজনীতি?” শুধু অভিষেকের মতো হেভিওয়েট তরুণনেতা কেন, যে কোনও মানুষের পিতৃপরিচয় তুলে আক্রমণ, আঘাত অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং বর্জনীয়। কিন্তু ১৩ সেপ্টেম্বর শুভেন্দু অধিকারী সম্পর্কে বাছা বাছা বিশেষণ প্রয়োগ করার আগে কুণাল ঘোষের এই শালীনতাবোধ কোথায় ছিল? সেদিন শুভেন্দু সম্পর্কে অভিষেকের মন্তব্যও কি খুব রুচিশীল কিছু ছিল?
রাজ্যের বিরোধী দলনেতার দিকে যৌনগন্ধী বিদ্রুপ ছুঁড়ে দেওয়ার পর কুণাল-অভিষেক কি আশা করেছিলেন তাঁদের দিকে প্রতিপক্ষ শিবির থেকে পুষ্প-চন্দন ছেটানো হবে? শালীনতা কোনও একতরফা ব্যাপার নয়। শুধু রাজনীতিই নয়, জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে কারও কাছ থেকে শালীনতা-সৌজন্যের প্রত্যাশা থাকলে আপনাকেও তাঁর প্রতি একই আচরণ করতে হবে। ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও’- নিজেদের আচরণ ঠিক না থাকলে কুণালবাবুরা বিরোধীদের কী শালীনতা-শিষ্টতা শেখাবেন? কুৎসা-কেচ্ছা বড্ড খারাপ জিনিস। আপনি অন্যেরটা ঘেঁটে দিলে, অন্যে আপনারটাও ঘেঁটে দেবে। বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি সুস্থ ও রুচিশীল হোক। এবং তা করার দায় শাসক-বিরোধী, দুই তরফেরই।
Feature image is representational.