রাজা নেই। রাজত্বও গেছে কবে ভেসে। কিন্তু রাজার পুজো আছে। জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির দুর্গা পুজো ৫১৩ বছরের প্রাচীন। বড় রহস্যে ঘেরা এই পুজো। এক সময় হত নরবলিও। এখন হয় প্রতীকি বলি। আরও জানুন এই প্রতিবেদনে-
রাজা নেই। রাজত্ব নেই। জীর্ণ রাজবাড়িগুলি পড়ে আছে। আর আছে রাজাদের পুজো। রাজাদের পুজো মানেই তো রহস্য। বাংলা জুড়েই রাজার আমলের অনেক প্রাচীন দুর্গাপুজো আজও নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে উদযাপিত হয়ে আসছে। এই রকমই একটি পুজো- জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর রাজ এস্টেটের দুর্গাপুজো। সেই পুজোর গল্পই এখন শোনাই আপনাদের। জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজো এবার পাঁচশ তেরো বছরে পড়ল। নানা তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে গবেষকেরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ১৫০৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শিষ্য সিংহ এই পুজোর প্রচলন করেন। শিষ্য সিংহের জেষ্ঠ্যভ্রাতা বিশ্ব সিংহ (যাঁকে কোচ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে) ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে কোচবিহার রাজবাড়ির বড়দেবীর (কোচবিহার রাজবাড়ির দেবী দুর্গাকে এই নামেই ডাকা হয়) পুজোর প্রচলন করেন বলে জানা যায়। এই হিসেব মেনে নিলে বলতে হয় বৈকুণ্ঠপুর রাজ এস্টেটের দুর্গাপুজোর বয়স কোচবিহার রাজবাড়ির বড়দেবীর পুজোর থেকেও এক বছর বেশি। বাংলার প্রাচীনতম দুর্গাপুজো গুলির মধ্যে বৈকুণ্ঠপুর এবং কোচবিহার রাজবাড়ি– দুটোই উল্লেখযোগ্য।
আগে নরবলি হত, এখন প্রতীকি বলি হয়
রাজার পুজো মানেই রহস্যে মোড়া। কোচবিহার রাজাদের বড়দেবীর পুজো থেকে বৈকুন্ঠপুর রাজ এস্টেটের পুজোয় রহস্য কিছু কম নয়। পুজোর সূত্রপাত থেকেই নরবলি ছিল। এই প্রথা নাকি পরবর্তী একশ বছর যাবৎ চালু ছিল! নিখুঁত এবং সর্ব সুলক্ষণযুক্ত দেহের অধিকারী অনূর্ধ্ব দ্বাদশ বর্ষীয় ব্রাহ্মণ বালককে দেবী মূর্তির সামনে বলি দেওয়া হত সপ্তমীর গভীর নিশীথে সংগোপনে। বলিকৃত বালকের কলিজা ( হৃদপিন্ড ) দেবীর উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করা হত। চারশ বছর আগে এই নিষ্ঠুর প্রথা বন্ধ হয়ে গেলেও নরবলির কথা পরিবারের বড়দের মুখে শুনেছেন রাজবাড়ির সকল সদস্যই। এখনও হিমালয় সংলগ্ন উত্তরবঙ্গের তরাই-ডুয়ার্সে পুজো এলেই লোকের মুখে মুখে ফেরে বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়িতে নরবলির গল্প। সপ্তমী তিথিতে রাত বারোটার পর অনুষ্ঠিত অর্ধরাত্রি পুজোয় প্রতীকি নরবলি কিন্তু আজও হয় রাজবাড়িতে। চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো মনুষ্য আকৃতির পুতুল বলি দেওয়া হয়।
পুজোর রীতিনীতি আগে যেমন ছিল তেমনটিই আছে এখনও। বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়িতে মায়ের পুজো হয় কালিকা পুরাণ মতে। এই পুজোয় বলি সিদ্ধ। সপ্তমীর অর্ধরাত্রি পুজোয় আটটি পায়রা বলি দেওয়া হয়। জলপাইগুড়ি জেলার রাজবংশী সমাজের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৈকুণ্ঠপুরের দুর্গা পুজো। নবমীতে যজ্ঞের আগে মনোস্কামনা পূরণে পুজো প্রাঙ্গণে পাঁঠা , হাঁস , চালকুমড়ো এবং আখ বলি দেন স্থানীয়রা।
তপ্ত কাঞ্চন মহামায়া, শ্বেতশুভ্র সিংহ
বৈকুণ্ঠপুর রাজ এস্টেটের দুর্গা প্রতিমার পৃথক কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।মহামায়া এখানে তপ্ত কাঞ্চন বর্ণা। এবং তিনি সর্বাঙ্গে সালংকারা। দেবীর মস্তকে স্বর্ণ মুকুট এবং গন্ডদেশে শোভা পায় নবরত্ন হার। দেবীর দশ হস্ত ও কর্ণকুন্তলে বিরাজ করে সোনা-রূপার গহনা। দেবী পরিধান করেন লাল বেনারসি শাড়ি। প্রতিমার উচ্চতা ১৫ ফিট। একচালা একটি রথের উপর দেবী উপবেশন করেন। সিংহবাহিনী দেবীর সঙ্গে থাকে ব্যাঘ্রও। সিংহের গাত্রবর্ণ শুভ্র। অসুর দলনী দেবী দুর্গার দুই পাশে তাঁর চার পুত্রকন্যা কার্তিক-গণেশ, লক্ষ্মী-সরস্বতী তো থাকেনই বিগ্রহ রূপে চালায় বিরাজ করেন মহামায়া, দেবী চন্ডী, দেবাদিদেব মহেশ্বর, ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুও। এমনকি মায়ের পাশে স্থান পেয়েছেন কৈলাশে ভোলানাথের চ্যালা নন্দীর স্ত্রী জয়া এবং তাঁর সখী বিজয়াও। বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির নাটমন্দিরে পুজো হয়। স্থায়ী কাঠামোর উপর প্রতিমা নির্মাণের কাজও চলে সেখানেই। মহালয়ার সকালেই তর্পণান্তে রাজ পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে মায়ের চক্ষুদান সেরে ফেলেছেন রাজবাড়ির মৃৎশিল্পী। কার্যত মহালয়া থেকেই বৈকুন্ঠপুর রাজ পরিবারের দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গেছে। মহালয়ার অমাবস্যায় কালীপুজো এখানে দুর্গাপুজোরই অঙ্গ ।
পুজোয় আমিষ ভোগের প্রাধান্য
বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়ির পুজোয় নবপত্রিকার স্নানের জল আসে হরিদ্বারের গঙ্গা, মথুরা ও বৃন্দাবনের যমুনা নদী এবং কৈলাশ মানস সরোবর থেকে। রাজা নেই। রাজত্বও কালের স্রোতে ভেসে গেছে কবে। রাজ পরিবারের সদস্যরা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু ষষ্ঠীর বোধন থেকে দশমীতে নিরঞ্জন– ঐতিহ্য , পরম্পরা ও নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম নেই রাজবাড়ির পুজোয়। পুজোর ভোগে আমিষের প্রাধান্য । সপ্তমী, মহাষ্টমী এবং নবমী– তিনদিনই দেবীর ভোগে থাকে রুই-কাতলা, ইলিশ, বোয়াল এবং চিতল মাছ। থাকে পাঁঠার মাংসও। এক সময় বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির পুজো মানেই ছিল বিরাট উৎসব। এস্টেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ আসতেন পুজো দেখতে। রাজবাড়ি চত্বর জুড়ে শত শত তাঁবু পড়ত। পুজো উপলক্ষে বিশাল মেলা বসত। সময়ের গ্রাসে অতীত দিনের জৌলুস অনেকটাই ফিকে। তারপরেও পুজো উপলক্ষে রাজবাড়ি সংলগ্ন রাস্তার দু’পাশে আজও মেলা বসে।
দশমীর সিঁদুর খেলা নজর কাড়া
রাজবাড়ির দশমী ও সিঁদুর খেলা আজও জলপাইগুড়ির দুর্গা পুজোর অন্যতম আকর্ষণ। দশমীর পুজো সমাপান্তে সধবারা দেবী বরণ ও সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। রাজ পরিবারের সদস্যরা তো বটেই দলে দলে সাধারণ মানুষও এতে অংশগ্রহণ করে। বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়িতে দেবী নিত্য পূজিতা। দেবী দুর্গার দশমী বিহিত পুজো সমাপান্তে মৃৎ প্রতিমার নিরঞ্জন হয় মাত্র। ঢাক-ঢোল-কাশি-বাঁশির প্রবল বাদ্যের মধ্যে রথে আসীন দেবী প্রতিমা টানতে টানতে রাজবাড়ির দিঘির ঘাটে নিয়ে যান ভক্তরা। এই দৃশ্য দেখতে রাজবাড়ি চত্বরে উপস্থিত হন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিমা নিরঞ্জনের সাথে সাথেই কাঠামো জল থেকে তুলে ফেলাই নিয়ম। এই কাঠামোর উপরেই নির্মিত হবে পরের বছরের দেবী প্রতিমা। রাজবাড়ির দুর্গা পুজোর পুরো দায়িত্ব কুল পুরোহিত শিবু ঘোষালের কাঁধে। শিববাবুর পিতৃপুরুষেরাও একই কাজ করে এসেছেন। রাজ পরিবারের তরফে পুজোর মূল দায়িত্ব সামলান প্রণত বসু। লোকে তাঁকে পুচুবাবু বলে চেনে। কোভিড অতিমারির কারণে বিশের পুজো মাটি হয়েছিল। একুশের পুজোতেও একটা ভয়-ভয় ব্যাপার ছিল। মানুষ প্রাণখুলে আনন্দ করতে পারে নি। আনন্দময়ীর কৃপায় বাইশের পুজোর অনেক আগেই করোনাসুর কার্যত পর্যুদস্ত। জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর রাজ এস্টেটের ঐতিহ্যবাহী পুজোতেও এবার আগের মতোই আনন্দের মেতে ওঠার সুযোগ থাকছে।
File Photo.