দেশভাগ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসেরই অংশ। যে সুপরিকল্পিত দাঙ্গার জেরে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, তার নাম-দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস! পূর্বাভাস পাওয়ার পরেও জিন্নাহর পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন গান্ধি-নেহেরু-প্যাটেল।লিখলেন উত্তম দেব-
পাকিস্তানের জন্ম কার্যত কলকাতার রক্তস্নান থেকে। যাকে বলা হয় ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’। ছিল মুসলিম লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস বা ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’। হয়ে গেল গণহত্যা। মুসলিম লিগের আন্দোলন হঠাৎ করে ঘটনাচক্রে দাঙ্গায় পরিণত হয়ে গেল– এই রকম মনে করার কোনও কারণ নেই। হত্যালীলার মাস্টারমাইন্ডদের আড়াল করার চেষ্টা কম হয় নি। এখনও সোরওয়ার্দিদের বাঁচানোর চেষ্টায় ছেচল্লিশের গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসের অনেক নতুন নতুন ন্যারেটিভ নামে কিন্তু তাতে মহাকালের পটে যা লেখা হয়ে গেছে তা পাল্টানো সম্ভব নয়। পাকিস্তান কামিয়াব করতে মুহম্মদ আলি জিন্নাহর হাতে শেষ অস্ত্র ছিল দেশব্যাপী দাঙ্গা। এবং সেই দাঙ্গার সূতিকাগার হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল লিগ সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলার রাজধানী কলকাতাকে। জুলাই মাসেই পাকিস্তান নিয়ে একটা এস্পার কি উস্পার করে ফেলার সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন জিন্নাহ।
জিন্নাহর হুমকি, নেহেরুর নিস্পৃহতা
নিজের অভিপ্রায় জিন্নাহ গোপন রেখেছিলেন এমন দোষ পাকিস্তানের জনককে দেওয়া চলে না। ক্যাবিনেট মিশনের মতিগতি পাকিস্তান সৃষ্টির অনুকূল নয়– এটা বোঝার পর থেকেই ছেচল্লিশের জুলাই মাস ধরে সমানে তড়পে যাচ্ছিলেন জিন্নাহ। শেষমেশ তিনি বলেই বসলেন– ‘আমরা যুদ্ধ চাই না। কিন্তু তোমরা যদি যুদ্ধ চাও আমরা তোমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করতে একটুও দ্বিধা করব না। ‘ যুদ্ধের উদ্দেশ্যও খোসলা করে দিলেন উপমহাদেশের কায়েদে আজম। হুঁশিয়ারি দিয়ে জিন্নাহ বললেন, ‘যুদ্ধে হয় আমরা ভারতকে ভাগ করব নয় ধ্বংস করব। ‘ জিন্নার এই হুমকি ছিল কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে। কিন্তু যাদের উদ্দেশ্যে এই চেতাবনি তাদের পান্ডা জওহরলাল নেহেরু তখন ক্ষমতা পাওয়ার লোভে মশগুল। জিন্নার হুমকিধামকি কানেই তুললেন না নেহেরু। প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ব্রিটিশ সরকার তখন ভারত ছাড়তে পারলে বাঁচে। জিন্নার কথাকে গুরুত্ব দিল না ভারতের ইংরেজ প্রশাসনও। আর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী তখন দিশেহারা এবং কংগ্রেসের ভেতর পরিত্যক্ত। তিনি তখন না হোমে না যজ্ঞে– দেশের কোনও কাজেই লাগছেন না।
জুম্মাবারে মনুমেন্টের নিচে লিগের সভা
১৯৪৬ এর ১৬ অগাস্ট ছিল শুক্রবার। দিনটি বেছে নেওয়ার তাৎপর্য সহজেই অনুমেয়। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোরওয়ার্দি। গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক জন ব্যারোজ। বিকেলে মনুমেন্টের নিচে সমাবেশ ডাকল মুসলিম লিগ। সমাবেশ ডেকেই জুম্মাবারটিকে ‘পাবলিক হলিডে‘ হিসেবে ঘোষণা করতে গভর্নর ব্যারোজকে টোপ দিলেন সোরওয়ার্দি। টোপ গিলে ১৬ অগাস্ট গণছুটি ঘোষণা করে দিলেন ব্যারোজ। মসজিদে মসজিদে জুম্মার নমাজ শেষে সকলের একমাত্র গন্তব্য যেন হয় মনুমেন্টের মাঠ, সেই মতো ব্যবস্থা করা হল। পাড়ায় পাড়ায় লিগের নেতাকর্মীদের হাবভাব দেখে হিন্দুদের মধ্যে আশঙ্কার একটি চোরাস্রোত বইলেও তাদের আশ্বস্ত করতে কোনও আগাম পদক্ষেপই করে নি প্রশাসন।
সভা শেষ হতেই হিংস্রতা শুরু
১৬ অগাস্ট সকাল দশটার পর থেকে একটা উত্তেজনার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল নগর কলকাতায়। সরকারের গণছুটির বিরোধিতা করেছিল কংগ্রেস। হিন্দুরা যথারীতি দোকানপাট খুলেছিলেন। তবে মিছিল করে সভাস্থলে যাবার পথে জোর করে দোকান বন্ধ করে দিচ্ছিল লিগের কর্মীসমর্থকেরা। মিছিলকারীদের হাতে ছিল বাঁশের মোটা মোটা লাঠি এমনকি লোহার রডও। মনুমেন্টের তলায় লিগের সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন ও হোসেন শহিদ সোরওয়ার্দি। সমাবেশে লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত হয়েছিল। গরম গরম ভাষণ দিয়ে জনতাকে তাতিয়ে দিলেন দু’জনেই। ‘সভায় আসার পথে মুসলমানরা আক্রান্ত হয়েছে ‘ মঞ্চ থেকে এই কথা বলে আগুনে ঘি ঢাললেন নাজিমুদ্দিন। সভা ফেরত জনতা মহানগরীর পথে পথে কী করেছিল তার প্রমাণ পরের দিনের আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয– ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রামের তান্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করিলাম। আমরা পূর্ব হইতেই যাহা আশঙ্কা করিয়াছিলাম, তাহাই বাস্তবে পরিণত হইল। কলিকাতার রাজপথ বার বার নাগরিকদের রক্তে স্নাত হইয়াছে। কিন্তু প্রতিবারই এই সংগ্রাম চলিয়াছিল নিয়মতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে। নিরস্ত্র নিরীহ অহিংস জনসাধারণ ও ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করিয়া ইংরেজ রাজপুরুষ আপনার ক্ষমতা মত্ততার নিষ্ঠুর পরিচয় দিয়াছে। এই আন্দোলনে যাঁহারা শহিদ হইয়াছেন তাঁহারা জাতীয় জীবনে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন। কিন্তু আজিকার এই সংগ্রামকে আমরা কী আখ্যা দিব? নরহত্যা, লুটতরাজ, অত্যাচার প্রভৃতি যত কিছু অন্যায় সমস্তই অনুষ্ঠিত হইয়াছে। আজ জাতীয় জীবন কলুষ কালিমালিপ্ত। নিরীহ পথচারীর ওপর আক্রমণ চালাইয়া অসহায় পরিবারবর্গের ওপর অত্যাচার করিয়া ঘরবাড়ি পুড়াইয়া যে সংগ্রাম তাহার জঘন্য রূপকে প্রকাশ করিল তাহা জাতীয় ইতিহাসের কলঙ্কস্বরূপ। ‘
লালবাজারে বসে মজা দেখলেন সোরওয়ার্দি
১৬ অগাস্ট সন্ধ্যার পর থেকে তিলোত্তমা কলকাতাকে দোজখে পরিণত করল দাঙ্গাবাজরা। সভাস্থল থেকে সোজা লালবাজার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে চলে যান বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোরওয়ার্দি । সারারাত সেখানেই ছিলেন তিনি। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ নয় বরং প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় রেখে দাঙ্গা ছড়িয়ে দিতেই লালবাজার কন্ট্রোল রুমে ঘাঁটি গেড়েছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী– সোরওয়ার্দির দিকে অভিযোগ এমনই। ১৬ অগাস্ট রাতে সোরওয়ার্দি যে লালবাজার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ছিলেন এটা কোনও গুজব নয় । অনেক সাংবাদিক এই দৃশ্য দেখেছেন। তাঁদের মধ্যে প্রখ্যাত সাংবাদিক শঙ্কর ঘোষও একজন। সোরওয়ার্দি স্বয়ং এই ঘটনা অস্বীকার করার সুযোগ পান নি। তিনি সাফাই দিয়ে বলেছিলেন, ‘কন্ট্রোল রুমে ছিলাম কথা সত্য তবে পুলিশ যাতে ঠিকঠাক কাজ করে এটা দেখার জন্যই সেখানে ছিলাম। ‘ যদিও ১৬ তারিখ রাত কিম্বা ১৭ তারিখ সারাদিনের ঘটনা সোরওয়ার্দির দাবির সত্যতা প্রমাণ করে না। এর পর থেকেই কলকাতার হিন্দুরা হোসেন শহিদ সোরওয়ার্দির নাম দেয় ‘ছোরাবর্দি সাহেব‘।
আনন্দবাজারের বর্ণনা
১৭ অগাস্টের যেই বর্ণনা আনন্দবাজার দিচ্ছে দেখা যাক– ‘দ্বিতীয় দিবসেও ( শনিবার ) কলিকাতা নগরী কান্ডজ্ঞানহীন উচ্ছৃঙ্খল জনতার কবলে সম্পূর্ণ অরাজক অবস্থায় ছিল। বিক্ষুব্ধ জনতা কর্তৃক গত দুই দিবসে মোটের ওপর দুই শতাধিক হত এবং ১৫০০ আহত হইয়াছে। গতকল্য নগরীর রাজপথসমূহ হইতে অসংখ্য মৃতদেহ অপসারণ করা হইয়াছে। এখনো বহু মৃতদেহ রাস্তায় পড়িয়া আছে। আইন ও শৃঙ্খলার পরিবর্তে অরাজকতার বিজয়রথই যেন নগরীর ওপর দিয়া তাহারা চালাইয়াছে। বস্তুত গতকল্য প্রাতঃকাল হইতে অপরাহ্ন পর্যন্ত উত্তর ও মধ্য কলিকাতায় অব্যাহত গতিতে ছুরিকা ও লাঠি চলিয়াছে। অবশেষে সন্ধ্যা সমাগমে অবস্থা কতকটা শান্তভাব ধারণ করিলেও প্রায়শই চোরাগোপ্তা আক্রমণের সংবাদ পাওয়া গিয়াছে। ‘ ১৮ অগাস্টের আনন্দবাজার জানাচ্ছে ১৭ তারিখ সকালে তাদের দফতরও আক্রান্ত হয়েছিল– ‘অরাজক অঞ্চলে অবস্থিত বলিয়া আমাদের অফিসের কার্য্যাদি প্রায় সমস্তই বন্ধ ছিল। তজ্জন্য আজ দুইদিন পর্যন্ত আনন্দবাজার ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড মাত্র দুই পৃষ্ঠা করিয়া প্রকাশ হইতেছে। গতকাল প্রাতে গুন্ডাগণ আমাদের অফিস বাটী আক্রমণ করিয়াছিল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমরা উহা প্রতিহত করিতে সমর্থ হইয়াছিলাম। প্রধান অফিসগৃহের নিকটবর্তী মেছুয়াবাজার স্ট্রীটস্থ আমাদের মেসবাড়িও অনুরূপভাবে আক্রান্ত হইয়াছিল। কিন্তু মেসের অধিবাসীদের সাহস ও কৌশলে তাহা রক্ষা পায়। অফিসের সম্মুখস্থ আমাদের গুদামঘরে এবং অফিস সংলগ্ন পোষ্ট অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়, আমাদের রিপোর্টারগণের গাড়ি রাস্তায় বাহির করা মোটেও সম্ভব হয় নাই। ‘
কলকাতার আগুন ছড়িয়ে গেল দিকে দিকে
১৬ থেকে ১৮ অগাস্ট– মুসলিম লিগের একদিনের সমাবেশের ঠ্যালায় টানা তিনদিন বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল কলকাতা মহানগরী। তখন কলকাতায় হিন্দুর সংখ্যা ছিল ৭৩ শতাংশ । মুসলমান ২৩ এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষ ৪ শতাংশ। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসে ঠিক কত জীবনহানি হয়েছিল হিসেব নেই। একটি হিসেবে কমপক্ষে বিশ হাজার মানুষ খুন হয়ে যায় তিনদিনের দাঙ্গায়। তখন কলকাতার জনসংখ্যা ছিল ৪০ লক্ষ ৬৪ হাজার ৫৫৬। কোনও সন্দেহ নেই যে, কিলিংস টা ছিল গ্রেট! কলকাতাকে কেন্দ্র করে মুসলিম লিগের রণকৌশল নিঃসন্দেহে সফল হয়েছিল। এরপর লাহোর থেকে নোয়াখালি– সারা ভারতবর্ষে দাঙ্গার আগুন জ্বলে ওঠে। রীতিমতো অক্ষরে অক্ষরে তাঁর ওয়াদা রক্ষা করতে পেরেছিলেন মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ। ভারতকে ধ্বংস এবং ভাগ দুটোই করেছিলেন তিনি। গান্ধি-নেহেরু-প্যাটেল নীরব দর্শক হয়ে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে গেছেন মাত্র।
- তথ্যসূত্র- ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৬-১৯৬৪ পত্রপত্রিকার ভাষ্য’- সুকুমার বিশ্বাস।
- ফটো- লাইফ ম্যাগাজিন।