কলঙ্কিত পার্থকে ঝেড়ে ফেলল তৃণমূল। পার্থকে বধ করে শাসকদল কলঙ্ক মুক্ত হতে চাইছে- অভিযোগ বিরোধীদের। পারবে?লিখলেন নির্বাণ রায়-
অবশেষে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আম-ছালা দুই-ই গেল। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ইডি-র হাতে সবান্ধবী গ্রেফতারের পরপরই রাজ্য মন্ত্রিসভা ও তৃণমূল দল থেকে পার্থ বিদায়ের তোড়জোড় চলছিল। শুক্রবার ভোরে পার্থের বাড়িতে ইডির হানা। বিকেলে পার্থের বান্ধবী অর্পিতার টালিগঞ্জের ডায়মন্ড সিটি হাউসের অভিজাত আবাসনের ফ্ল্যাট থেকে কুবেরের সম্পদ উদ্ধার। শনিবার ভোরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। হেফাজতে নেওয়া হয় অর্পিতাকেও। শনিবার পার্থ চট্টোপাধ্যায় ফাঁদে পড়া মাত্রই তাঁকে বাতিলের খাতায় ফেলতে তৃণমূলের ভেতরে যিনি সবথেকে বেশি তৎপর ছিলেন তাঁর নাম অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুঃসময়ের সাথীদের একজন এবং অন্যতম। তাই অভিষেক এবং তাঁর লবি অনেক চেষ্টার পরেও দলের ভেতরে পার্থকে পুরোপুরি কোনঠাসা করে ফেলতে সফল হয় নি সেদিন। দল ও সরকারের মুখ পোড়ানোর পরেও বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তৃণমূলের ভেতরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে যাঁরা প্রাণপণে গার্ড করে যাচ্ছিলেন তাঁরাও পার্থর মতোই মমতার পুরোনো অনুগামী। কিন্তু ইডি-র তদন্ত যত এগোচ্ছিল দলের ভেতরে তাঁদের প্রতিরোধের বাঁধ ততই আলগা হয়ে পড়ছিল। সন্ধ্যায় অর্পিতার বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাট থেকে ফের আরেক দফা কুবেরের ধন উদ্ধারের পর দল ও সরকারে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের টিকে থাকার সামান্য সম্ভাবনাটুকুও ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এরপর অভিষেকের মুখ বন্ধ রাখা মমতার পক্ষেও কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে।
মমতা এমন বিড়ম্বনায় আগে পড়েন নি
পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে যে তৃণমূল ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলবে, বুধবার রাতের মধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। পাছে ববি-অরূপেরা কাঠি করে পার্থের বিরুদ্ধে চরম অবস্থান নেওয়া থেকে কোনও ভাবে মমতাকে নিরস্ত করে, এই আশঙ্কায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয় কুণাল-দেবাংশুকে। কার নির্দেশে কুণাল-দেবাংশু সকাল-সকাল পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে টার্গেট করে ট্যুইটারে গরমাগরম পোস্ট ঝাড়েন তা বুঝতে কারও বাকি থাকে না। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর সারদা-রোজভ্যালি-নারদা সহ বিভিন্ন স্ক্যামে জড়িয়ে দলের একাধিক হেভিওয়েট জনপ্রতিনিধি-মন্ত্রী জেলে গেছেন। কিন্তু পার্থ গ্রেফতারের পর যে বিড়ম্বনা মমতাকে সইতে হচ্ছে, অতীতে আর কেউই তৃণমূল সুপ্রিমোর জন্য তেমন বিড়ম্বনার কারণ হয়ে ওঠেন নি। নেহাত বিরোধীরা দুর্বল ও ছন্নছাড়া তাই এখনও রাজনৈতিক ভাবে চাপে পড়তে হয় নি সরকারকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী নেত্রী আর সরকারটা অন্য কারও- আজ আন্দোলনের ঝাঁঝ কোথায় গিয়ে ঠেকত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পার্থের পতনে দলে আরও একলা পুরোনোরা
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর দুই ফ্ল্যাট থেকে ইতিমধ্যেই প্রায় পঞ্চাশ কোটি নগদ টাকা উদ্ধার। সোনার গয়না এবং বিদেশি মুদ্রা সহ উদ্ধার হওয়া অন্যান্য সম্পদের কথা উল্লেখ না করাই ভাল। শুধু কলকাতা শহরেই অর্পিতার নামে কতগুলো ফ্ল্যাট আছে বলা মুশকিল। ইডি-র উদ্ধার অভিযান শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে, কে জানে! এই পরিস্থিতিতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় যতই পুরোনো অনুগামী হোন, তাঁকে বলি দেওয়াই মমতার জন্য নিরাপদ। মমতার মন্ত্রিসভায় শিল্প-বাণিজ্য, তথ্যপ্রযুক্তি এবং পরিষদীয়- তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দফতর একাই সামলাতেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ছিলেন তৃণমূলের মহাসচিব এবং দলের মুখপত্র ‘জাগোবাংলা’-র সম্পাদক। বৃহস্পতির বারবেলায় সব কিছুই কেড়ে নিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দল থেকেও কার্যত তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রেফতার হওয়ার সাথে-সাথেই কুণাল ঘোষ ছাড়া আর কোনও তৃণমূল নেতার কপালে এমন বেইজ্জতি ও দুর্ভোগ জোটে নি। তৃণমূলের ইতিহাসে কুণাল ও পার্থের অবস্থান এক নয়। ছাত্র রাজনীতি করার সময় থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয়। তৃণমূলের জন্মের পরে পরেই মমতার অনুরোধে বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়ে পার্থের রাজনীতিতে যোগদান। দল থেকে পার্থের বিয়োগান্তক বিদায়ে মমতাকে ঘিরে থাকা তৃণমূলের পুরোনো নেতারা আরও দুর্বল ও কোনঠাসা হয়ে পড়ল বলে রাজনৈতিক মহলের অনুমান।
মমতার মন্ত্রিসভাতেও অভিষেকের প্রভাব বাড়ার সম্ভাবনা
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পতন তৃণমূলের ভেতরে বড়সড় নাড়া দেবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। সিনিয়র লবির শক্তিশালী উইকেটটি ক্লিন বোল্ড হওয়ায় অভিষেক লবি স্বাভাবিক ভাবেই স্বস্তিতে এবং ফূর্তিতে। এই মুহুর্তে তৃণমূলে মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে সিনিয়র ও পুরোনোদের মধ্যে সুব্রত বক্সী, ফিরহাদ হাকিম ও অরূপ বিশ্বাস ছাড়া আর কেউ রইলেন না। অভিষেকের সঙ্গে এটে উঠতে না পেরে সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় কবেই নীরব হয়ে গেছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ফাঁদে পড়ার পর থেকেই রাজ্য মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে নতুন করে গড়ার দাবিতে সরব অভিষেক অনুগামীরা। বৃহস্পতিবার তেমনই ইঙ্গিত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা মন্ত্রিসভা নতুন করে ঢেলে সাজালে তাতে নিজের অনুগামীদের ঢোকাতে অভিষেক যথেষ্টই তৎপর থাকবেন বলে মনে করার সঙ্গত কারণ আছে।
পার্থ একাই পাপেরর ভাগী! মানুষ মানবে?
কলঙ্কিত পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ঝেড়ে ফেলার পর তৃণমূলের বলার সুযোগ থাকছে- দ্যাখো, যতবড় নেতাই হোক অন্যায় করলে দল রেয়াত করে না। অভিষেক ইতিমধ্যেই বলেছেন- ” সাধারণ মানুষের সঙ্গে অন্যায় করলে আপস করে না তৃণমূল। যত বড় নেতাই হন, তাঁর যত জনসমর্থনই থাকুক, মানুষের সঙ্গে অন্যায় করলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবেই। আমরা কাউকে আড়াল করব না। কেউ দলের মঞ্চ ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করলে তাঁকে ছেড়ে দেবে না দল।” কিন্তু দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় দিনের পর দিন দুষ্কর্ম করে গেলেন, অথচ দলের সুপ্রিমো তার কিছুই টের পেলেন না- এমন কথা মানুষকে বিশ্বাস করানো শক্ত। তাই বিরোধীরা পার্থকে বলছেন স্কেপগোট- বলির পাঁঠা। পার্থকে বধ করে সরকার কলঙ্ক মুক্ত হতে চাইছে বলে বাম-বিজেপি-কংগ্রেসের অভিযোগ। এসএসসি-র নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আজ থেকে নয়। ২০১৪ থেকেই আদালতে মামলার পর মামলা হয়েছে। কিন্তু সরকারের টনক নড়ে নি। হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই-ইডি তদন্তে না নামলে কি পার্থের ভান্ডাফোঁড় হত?
বিধ্বস্ত পার্থ মুখ খুলবেন?
পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দশদিনের ইডি হেফাজতে। শনিবার সকালে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নামের সঙ্গে সরকারের মন্ত্রী ও তৃণমূলের মহাসচিব পরিচয় লেপ্টে ছিল। রাত থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায় একজন প্রাক্তন মন্ত্রী মাত্র। নিজের দল থেকে সাসপেন্ড হওয়া বিধায়ক ছাড়া তিনি আর কিছু নন। ইডির খাঁচায় বন্দী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করেন এখন সেই দিকেই তাকিয়ে রাজনৈতিক মহল। পার্থ এমনিতে বেশ ভীতু। কিন্তু এখন তিনি একলা, নিঃসঙ্গ, অপমানিত, পর্যুদস্ত এবং সব হারানো একটা মানুষ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। অনেকেই মনে করেন পার্থ অনেক কিছু জানেন। এবং তিনি একা কিছুই করেন নি। পার্থ মুখ খুলবেন নাকি চেপে যাবেন- শুক্রবার থেকে সেই দিকেই নজর থাকবে সবার।
Photo source- Collected.