তাঁর চলচ্চিত্রের ভাষায় কোনও দুর্বোধ্যতা ছিল না। বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ আর্ট ফিল্ম বলতে যা বোঝে তিনি সেই পথ কখনও মাড়ান নি। তিনি মূলতঃ বাংলার মূল ধারার চলচ্চিত্রেই ছিলেন। কিন্তু তিনি সেলুলয়েডে গুছিয়ে কাহিনী বলেছেন। সাজিয়ে গল্প বলেছেন। বাঙালি গল্প শুনতে ভালবাসে। দেখতেও। সেলুলয়েডে বলা তাঁর গল্পগুলি বাঙালি মধ্যবিত্তকে নির্মল আনন্দ জুগিয়েছে। গল্পগুলি বাঙালির মন ছুঁয়ে গেছে। তাই তাঁর সিনেমায় পয়সা ঢেলে প্রযোজককে কখনও আফশোস করতে হয় নি। সোমবার সকাল ১১টা ১৭ মিনিটে তরুণ মজুমদার চলে গেলেন। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার, মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এবং তপন সিনহা- প্রত্যেকের চলচ্চিত্র নির্মাণের আলাদা আলাদা ঘরানা ছিল। কিন্তু এঁরা সবাই মিলে বাংলা চলচ্চিত্রের যে নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন তরুণ মজুমদারও ছিলেন তারই অংশ। তরুণ মজুমদারের জীবনাবসানে নিঃসন্দেহে নির্বাপিত হয়ে গেল বাংলা সিনেমার সেই যুগটি।
১৯৩১-এর ৮ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার বগুড়ায় জন্ম তরুণ মজুমদারের। বাবা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। পড়াশোনা কলকাতায়। রসায়নের ছাত্র। কিন্তু ঝোঁক ছিল সিনেমার জগতে। ১৯৫৯-এ যখন ক্যামেরার পেছনে প্রথম দাঁড়িয়েছিলেন তখন তরুণের বয়স মাত্র আঠাশ। ১৯৬৩ পর্যন্ত দুই বন্ধু শচীন মুখোপাধ্যায় এবং দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে ‘যাত্রিক’ নামে সিনেমা পরিচালনা করেছেন। ১৯৬২-তে ‘যাত্রিক’ পরিচালিত কাঁচের স্বর্গ জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছিল।
ষাটের দশকের কলকাতার বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবন থেকে গ্রাম বাংলার উপেক্ষিত লোকশিল্পীদের জগত- নিজের চলচ্চিত্রে সবাইকেই ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন তরুণ মজুমদার। বাঙালি সমাজের প্রতিটি স্তরে যতায়াত ছিল। গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন। গ্রামের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। মানুষের ছোট ছোট চাওয়া পাওয়া, প্রেম-বিরহ, সুখ-দুঃখ নিয়েই ছিল তরুণের নাড়াঘাঁটা। তিনি ছিলেন সেলুলয়েডে বাঙালি জীবনের কথাশিল্পী। সেই সময় সাহিত্য নিয়েই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন বাঙালি পরিচালকেরা। সাহিত্যের ভাষাকে সেলুলয়েডের ভাষায় সফলভাবে রূপান্তরিত করার কাজটি বড় সহজ নয়। কিন্তু তরুণ সেটা জানতেন। তাঁর কাহিনী নির্মাণের বুনট ছিল চমৎকার। সম্পাদনা ছিল নিটোল। ক্যামেরার লেন্সের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল অনবদ্য। সঙ্গীতের ব্যবহার কখন কোথায় কীভাবে করলে দর্শকের মন উতলা হয়ে উঠবে এটা খুব ভাল জানতেন তরুণ মজুমদার। ঝুঁকি নিতে ভয় পেতেন না। একেবারে আনকোরা মুখদের দিয়ে সিনেমা বানিয়ে বক্স অফিসে হিট করেছেন একাধিকবার। মৌসুমী, মহুয়া, তাপস পাল এবং দেবশ্রী রায়- রূপোলি পর্দার দুনিয়ায় এই চার নায়ক-নায়িকার ক্যারিয়ার গড়েপিটে দিয়েছেন তরুণ মজুমদারই।
১৯৫৯-এ যখন প্রথম পরিচালনায় এসেছিলেন তখন বয়স ছিল আটাশ। ২০১৮-তে যখন শেষ ফিল্ম বানালেন তখন তরুণের বয়স সাতাশি। কাজের প্রতি কতটা ভালবাসা ও দায়বদ্ধতা থাকলে দীর্ঘ ঊনষাট বছর নিজের সৃষ্টির জগতে সচল থাকা সম্ভব! দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছেন কিডনি ও হৃদযন্ত্রের অসুখে। শরীর বেঁকে বসলেও মনের তারুণ্য হারান নি। এই সেদিনও মাল্টিপ্লেক্সে এসে অনীক দত্তের অপরাজিত দেখে শিশুর মতো আপ্লুত হয়েছেন। জীবন জুড়ে ৩৬টি ফিল্ম বানিয়েছেন। সবগুলিই যে সমান জনপ্রিয় হয়েছে তেমন নয়। কিন্তু দেখে মুগ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সিনেমার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। পলাতক, বালিকা বধূ, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, গণদেবতা, দাদার কীর্তি, আলোর পিপাসা, ঠগিনী, পথভোলা এবং আলো- কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব। এসবের মধ্যে বালিকা বধূ, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, গণদেবতা এবং দাদার কীর্তি তো মাস্টার পিস। দাদার কীর্তি সদ্য যুবাদের নিদ্রাহরণ করেছিল বলে শোনা যায়। আমৃত্যু সাইড বদল করেন নি। নিজের বিশ্বাসে অটল থেকেছেন। এঁটোকাঁটার লোভে ক্ষমতার ভাগাড়ে বিড়াল হয়ে তাঁকে তাঁকে মিউ মিউ করতে দেখা যায় নি। শিরদাঁড়া সোজা রেখেই গেলেন।
Photo sources- Collected.