খন্ডিতবঙ্গের একটি অংশ পশ্চিমবঙ্গ। দেশভাগের জেরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক- সবদিক দিয়েই বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইটা ছিল ভীষণ কঠিন। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সেই সময়ে যিনি ছিলেন টালমাটাল পশ্চিমবঙ্গের সফল কান্ডারী, আজ তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন। বাংলার রূপকারকে নিয়ে লিখলেন নব্যেন্দু মৌলিক-
১৮৮২ এর ১লা জুলাই যে মহাপুরুষের আবির্ভাব, সেই মহাপ্রাণের জীবন প্রদীপ নির্বাপিত হয়েছিল আরও এক ১লা জুলাই৷ সেটি ১৯৬২-র। জন্মদিনেই জীবনের মায়া কাটিয়ে তিরোধান জগতে দুর্লভ। স্বয়ং তথাগত বুদ্ধ জন্মদিনেই তিরোহিত হয়েছিলেন। বিশ্বাসীরা বলেন, একমাত্র পুণ্যাত্মাদেরই এমন মৃ্ত্যু হয়। এখানে যাঁর কথা আলোচিত হচ্ছে তিনিও আপন কর্মযোগ সমাপান্তে জন্মদিনেই অবিচলিত চিত্তে মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন। আসলে ঘটনাচক্রে জন্ম-মৃত্যু একদিনে হলেই কেউ মহান হয়ে যান না। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে যে জীবন, সেই জীবনের সুকৃতিই কাউকে কাউকে মহান করে তোলে। ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের অনবদ্য কর্মজীবনই তাঁকে পরিণত করেছে মহীরুহ বটবৃক্ষে। তিনি ছিলেন একাধারে কিংবদন্তি চিকিৎসক এবং পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী। তার চেয়েও বড় কথা তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলার রূপকার।
বিহারের বাঁকিপুরে জন্ম। ব্রাক্ষ্ম পরিবারের ছেলে। প্রখ্যাত ব্রাক্ষ্ম নেতা তথা নববিধান ব্রাক্ষ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেন নাম রাখলেন ‘বিধান’। যৌবনে দারিদ্রের সাথে লড়াই করতে গিয়ে কখনও মেল নার্স, কখনও কলকাতার রাস্তায় ট্যাক্সি চালকের কাজ করেছেন। এইসব করতে গিয়ে ডাক্তারির পরীক্ষায় ফেল পর্যন্ত করেছেন পরবর্তীকালের এই ধন্বন্তরি চিকিৎসক। যদিও এই ফেল তাঁকে জীবনযুদ্ধে হারিয়ে দিতে পারেনি। মাত্র ১২০০ টাকা সম্বল করে লন্ডন যান বিধানচন্দ্র এবং ১৯১১ সালে ইংল্যান্ড থেকে মেডিসিন এবং সার্জারির ডিগ্রি MRCP এবং FRCS অর্জন করে ফিরে আসেন কলকাতায়। চিকিৎসক হিসেবে নিজের পেশা শুরু করেন। ক্যাম্পেবল মেডিকেল স্কুল (বর্তমানে নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ) এ চিকিৎসক এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। চিকিৎসক বিধানচন্দ্র এতটাই প্রখ্যাত ছিলেন যে তার খ্যাতি ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বহু বিখ্যাত মানুষের চিকিৎসা করেছেন তিনি। কে ছিলেন না সেই তালিকায়! দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধী, বল্লবভাই প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি এমনকি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এটলি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সদস্য থেকে ১৯৪২ এ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রয়্যাল সোসাইটি অফ টপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন এবং আমেরিকান সোসাইটি অফ চেষ্ট ফিজিশিয়ান এর “ফেলো”। এতকিছুর পরেও শুধুমাত্র পেশাদার চিকিৎসক হিসেবেই নিজের জীবন কাটাতে চাননি ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। বেশিরভাগ রোগী দেখতেন বিনামূল্যে। বলা হত বিধান ডাক্তার রোগীর গায়ে হাত দিলেই নাকি রোগী আধা সুস্থ হয়ে যেত। এহেন চিকিৎসকও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারলেন না। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুপ্রেরণায় যোগ দিলেন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জিকে পরাজিত করেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং দ্রুত কলকাতা পুরনিগমের মেয়র হন বিধানচন্দ্র রায়। ১৯৩১-এ গান্ধীর সাথে যোগ দেন আইন অমান্য আন্দোলনে। ১৯৪৭ এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন বিধানচন্দ্র রায়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে খন্ডিত বাংলার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৮ এর ১৪ই জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। মৃত্যুর দিন অর্থাৎ ১৯৬২ এর ১লা জুলাই অবধি প্রায় সাড়ে ১৪ বছর সেই পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়।
ডাক্তার বিধানচন্দ্রের থেকেও অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্রের জীবন। সদ্য খন্ডিত স্বাধীন দেশ। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্য বাংলা। তারই মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র। উদ্বাস্তু, ক্ষুধা, বেকারত্ব এক ভয়ংকর সমস্যা। এরই মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাত। বাংলায় পাট রপ্তানি বন্ধ করেছে পূর্ব পাকিস্তান। সেইসময় বাংলার অর্থনীতির চালিকা শক্তি পাট-শিল্প। সেই শিল্প না বাঁচলে লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে যাবেন। এমনিতেই মাথাগোঁজার ঠাঁই আর এক মুঠো ভাতের তীব্র অভাব। সেই সময় কর্মবীর বিধান উদ্যোগ নিলেন পতিত জমি উদ্ধারের। সেই জমিতে শুরু করালেন পাটচাষ। এমনকি কিছু ধানের জমিতেও পাটচাষের ব্যবস্থা করলেন। এভাবেই রক্ষা করলেন লক্ষাধিক চটকল শ্রমিকের পেশা। বিধানচন্দ্র বুঝলেন, এই কঠিন সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে ঠিক তেমনই উপনগরী গড়ে মানুষকে থাকার জায়গা দিতে হবে। তাঁর উদ্যোগে স্থাপিত হল ইস্পাত নগরী দূর্গাপুর, রেলইঞ্জিন প্রস্তুতকারক শহর চিত্তরঞ্জন। বাসস্থানের জন্য তৈরি হলো কল্যাণী, সল্টলেক (বর্তমানে তাঁরই নাম অনুসারে বিধাননগর), লেকটাউন, অশোকনগর-কল্যাণগড় প্রভৃতি উপনগরী। দুগ্ধজাত সামগ্রী সরবরাহের জন্য তৈরি হলো হরিনঘাটা দুগ্ধ প্রকল্প। একদিকে কর্মসংস্থান অন্যদিকে মাথা গোঁজার ঠিকানা, একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতার যা করা উচিত তাই করেছেন বিধান চন্দ্র রায়। যদি ভাবেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিধান চন্দ্র রায়ের কৃতিত্ব এখানেই শেষ তাহলে আপনি ভুল করছেন। আসলে দিবারাত্র পরিশ্রম করে লিখেও তাঁর যাবতীয় কৃতিত্ব ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন কাজ। তাই তিনি আধুনিক বাংলার রূপকার। শিক্ষাক্ষেত্রে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁরই অবদান। বহু কলেজ, স্কুল তার সৃষ্টি। স্কুল কলেজের মূল ভবনগুলিও তারই কৃতিত্ব। বাঁকুড়া সম্মীলনি মেডিকেল কলেজ থেকে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ, পুরুলিয়া, রহড়া, নরেন্দ্রপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমিক স্কুল তৈরি সবেতেই বিরল কৃতিত্বের দাবিদার এই মানুষটি। সরকারের বিনোদন প্রেম কতটা গভীর হতে পারে এবং তার উৎকর্ষ সাধনের জন্য বাস্তবিক কী করা উচিত তারও কৃতিত্ব রেখে গিয়েছেন বিধানচন্দ্র রায়। সত্যজিৎ রায়ের অর্ধ সমাপ্ত ছবি “পথের পাঁচালি” এর সরকারি উদ্যোগে প্রযোজনা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র। কালজয়ী সেই সিনেমা পরবর্তীকাল বিশ্ব দরবারে অস্কারে ভূষিত হয়। এখানেই শেষ নয়, হলদিয়া বন্দর নির্মাণ, ফারাক্কা ব্যারেজের পরিকল্পনা তৈরি, দিল্লিতে বঙ্গভবনের নির্মাণ (যা পরবর্তীতে অন্য রাজ্যগুলিকেও তাদের ভবন দিল্লিতে তৈরিতে অনুপ্রানিত করেছিল), দার্জিলিং এ ভারতের একমাত্র পর্বত আরোহন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান “হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট” প্রতিষ্ঠা সবই বিধানবাবুর প্রেরণার ফল। বাংলার উন্নয়নের স্বার্থে নিজের পৈত্রিক ভিটে বিক্রি করে দিতেও দ্বিধা করেননি বিধানচন্দ্র। আবার স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কলকাতা থেকে রেলের দপ্তর যখন সরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেয় কেন্দ্র তখন প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন তিনি। রুখে দেন সেই পরিকল্পনা। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনও নিয়মিত বিনেপয়সায় রোগী দেখতেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন চিকিৎসা করেছেন নেহেরু থেকে ইন্দিরা, কেনেডি থেকে এটলির। পারিশ্রমিক হিসেবে কখনও চেয়েছেন ইস্পাত নগরী দুর্গাপুরের জন্য অর্থ সাহায্য কখনও চেয়েছেন কল্যাণী তৈরিতে সাহায্য। চিকিৎসক হিসেবে নেহেরুর কাছে বিধানচন্দ্র এতটাই বিশ্বাসের জায়গা ছিল যে নিজের কন্যা ইন্দিরার চিকিৎসার জন্য কোলকাতাকেই বেছে নেন তিনি।
যে উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন এবং বঞ্চনা নিয়ে এত কথা আলোচনা হয় সেই উত্তরবঙ্গেরও কি কিছু কম প্রাপ্তি রয়েছে বিধানবাবুর কাছে? উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ, জলপাইগুড়ি সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, উত্তর পূর্ব ভারতের লাইফলাইন তিস্তা সেতু থেকে আরও কত কি। এমনকি আমার নিজের কলেজ আনন্দ চন্দ্র কলেজের মূলভবন। সবই তারই কৃতিত্ব। আরও হয়তো অনেক কিছু পেতে পারতো উত্তরবঙ্গ বা জলপাইগুড়ি। কিন্তু সেইদিনের সেই কুৎসিত অপকর্ম অনেক প্রাপ্তিকে আটকে দিয়েছিল। যদিও তাতে এই মহান আত্মার গায়ে একটি কালির পোঁচও লাগানো যায়নি।
প্রখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই বিদায় নিয়েছেন। ধন্বন্তরি চিকিৎসক মৃত্যুর আগে বলেছেন “আর কোনো ওষুধই আমাকে ভালো করতে পারবে না।” কিন্তু এত বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা মানুষটিকে কতটাই বা মনে রেখেছি আমরা! আজ যখন সরকার কী! সরকারের কাজ কী! উপঢৌকন নাকি উন্নয়ন! ভাতা নাকি কর্মসংস্থান! শিল্প নাকি তোলাবাজি! ধর্ম নাকি পেটের ভাত! এইসব নিয়ে আমরা জেরবার, তখন এই মানুষটি প্রাসঙ্গিক। অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। তাই আজকের দিনে বেশি বেশি করে এই মানুষটিকে জানা দরকার।
- লেখক ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা।