উত্তরটা হল- হ্যাঁ! বাংলার জমি রাজ্যের নেতাদের ভরসায় ফেলে রাখার বান্দাই নন তিনি। আর রাখবেনই বা কাদের ভরসায়?
বিশেষ প্রতিবেদন : বিধানসভা ভোটে পরাজয়ের ধাক্কা বঙ্গ বিজেপি এক বছর পরেও কাটিয়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু অমিত শাহের কাছে একুশের ভোট অতীত মাত্র। বছর পেরিয়ে ফের বাংলায় এসে দলের নেতাদের ঠারেঠোরে এটাই বুঝিয়ে দিলেন বিজেপির চাণক্য। একুশের দোসরা মের পর থেকে গত এক বছর ধরে রাজনৈতিক মহলের মনে হয়েছিল বাংলা নিয়ে বুঝি আগ্রহ হারিয়েছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। অমিত শাহের দু’দিনের বঙ্গ সফর বুঝিয়ে দিল বাংলাকে এখনও চোখে চোখেই রাখেন তিনি। বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক এক বছর পর বাংলা সফরে এলেন বিজেপির অন্যতম কান্ডারী। ঠিক দুই বছর পরে লোকসভা নির্বাচন। মোদী-অমিত শাহ ভালোই জানেন কখন, কীভাবে যুদ্ধের আগে ঘর গোছানো শুরু করতে হয়। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে মাত্র দু’টি আসন দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। একুশে আঠারো। মোদী, শাহ কিম্বা নাড্ডা- এরা কেউই এত বোকা নন যে এক হারের শোকে বাংলায় দলের ভবিষ্যৎ বরাবরের মতো জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের ক্ষতি করবেন। বাইশের ৫ মে থেকেই বাংলায় দলের হালচাল ফের তদারকি করা শুরু করে দিলেন তাঁরা। লক্ষ্য- চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে বাংলা থেকে ভালো সংখ্যক আসন তুলে আনা।
শাহ জানেন বাংলার কোন নেতার কী মুরোদ
অনেকেই বলে বঙ্গ বিজেপিতে বাঙালিয়ানা কোথায়? বাঙালি নেতা কোথায়? বিজেপিকে তো চালায় দুই গুজ্জু! আচ্ছা বলুন তো বঙ্গ বিজেপিতে পাতে দেওয়ার মতো নেতা কোথায়? বঙ্গ বিজেপির সংগঠনের হাল একার হাতে ধরার মতো জনপ্রিয় নেতা কোথায়? গোটা দলটা ১৪টা উপদলে বিভক্ত। এই মুহুর্তে অমিত শাহের মতো ঘোর বাস্তববাদী নেতা এবং সংগঠক ভূ-ভারতে হাতে গোনা। হয়তো আর একটিও নেই। শাহের চরম শত্রুও মানেন তাঁর লোক চেনার ক্ষমতা দুর্দান্ত। এই অমিত শাহ কি জানেন না বাংলায় তাঁর দলের নেতাদের কার কী আওকাত? মোদী-শাহ এসে টনিক না খাইয়ে গেলে একটা পুরসভাও জেতার মুরোদ আছে এই নেতাদের? মোদী-শাহ ভালোই জানেন হিমন্ত বিশ্বশর্মার মতো একজন নেতা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ঠেলেঠুলেই দলের সংগঠন সচল রাখতে হবে বাংলায়। দুই বছর খুব বেশি সময় নয়। দেখতে দেখতে দিন যাবে। ব্যবসায়ীরা সময়ের মূল্য বোঝেন। সবার আগে তাই শিবির গোছগাছের কাজটি শুরু করে দিয়েছেন দুই গুজরাটি সেনাপতি। বাংলার জন্য কোন টোটকা দরকার তা না ভেবেই অমিত শাহ হোমওয়ার্ক শুরু করে দিলেন তেমন ভাবার কোনও কারণ নেই।
বাংলার নেতাদের খেটে খেতে বললেন শাহ
অমিত শাহ নিউটাউনে রাজ্য বিজেপির সাংগঠনিক বৈঠকে কী কী দাওয়াই দিয়েছেন তার কিছু আভাস আমরা পাচ্ছি। বিনা পরিশ্রমে ফল পাওয়া যায় না আর তা চাওয়াও উচিত নয়- বঙ্গ বিজেপির বিবদমান নেতাদের উদ্দেশে এই ছিল শাহি সবক। এর চেয়ে সদুপদেশ আর কী দিতে পারতেন অমিত শাহ। হ্যাঁ। তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। জেলযাতনা তাঁকেও সহ্য করতে হয়েছে। কাজেই কত ধানে কত চাল হয় তা শাহের অজানা নয়। রাজ্যের বিরোধীদল কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকলে রাষ্ট্রপতি শাসনের একটা দাবি থাকেই। বাম আমলে বহুবার এই দাবি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে করতে দেখা গিয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যখন সত্যিই পালাবদল হল তখন রাষ্ট্রপতি শাসনের দরকারই পড়ে নি। দলীয় বৈঠকে রাজ্যের নেতাদের এই কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে খুব কি ভুল করেছেন শাহ?
একুশে বাংলা জয় করতে জলের মতো টাকা খরচ করেছে বিজেপি। পুরোটাই এসেছে দলের সদর দফতর থেকে। ভোট মেটার পর দেখা গেল হেরেও বেজায় খুশি বহু প্রার্থী। কারণ বুঝতে কোয়ান্টাম মেকানিজম নয় কান্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। বাংলায় দলের পরাজয় বাংলার নেতাদের শিক্ষা না দিলেও নিঃসন্দেহে অনেক কিছু শিখিয়েছে অমিত শাহকে। তিনি ঘোর বাস্তববাদী বানিয়া। অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে জানেন। বাংলায় বিজেপির কোনও জমিই ছিল না। প্রচুর শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগের পরেও কাঙ্ক্ষিত লাভ না পাওয়া গেলেও বাংলায় যে দল অবশেষে পায়ের নিচে একটা শক্ত জমিন পেয়েছে তা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন অমিত শাহ। একুশের আগে ফাটকা যা খেলার খেলেছেন, কিন্তু এখন শাহ বুঝেছেন এরপর বাংলা থেকে কিছু পেতে চাইলে খেটে খেতে হবে। সেই পরামর্শটাই সুকান্ত-শুভেন্দুদের দিয়েছেন তিনি।
শাহ বললেন- কেঁদে কী হবে,লড়াই কর
কাঁদুনে গাওয়া শাহের স্বভাব নয়। তিনি তা সইতেও পারেন না। তাই ৩৫৬-র কাঁদুনে না গেয়ে বাঙালি সতীর্থদের সংগঠনে নজর দিতে বলেছেন অমিত শাহ। যেই দল বুথে এজেন্ট বসানোর লোক পায় না। কাউন্টিং হলে এজেন্ট পাঠানোর কর্মী পান না যেই দলের প্রার্থী। এমনকি যেই দলের কর্মীরা ভোটের আগে ঘরে ঘরে ভোটার স্লিপ পর্যন্ত বিতরণ করতে জানে না সেই দলকে সংগঠন গড়ায় মনোযোগ দিতে বলে নিশ্চয় কোনও ভুল করেন নি দেশের সবথেকে দক্ষ সংগঠকটি? সাংগঠনিক সভায় মমতার উদাহরণ টেনেছেন অমিত শাহ। যেকোনও দলের হতোদ্যম নেতাদের উজ্জীবিত করতে মমতার চেয়ে ভাল উদাহরণ আর কী থাকতে পারে? শাহও মমতাকে টেনেছেন। শাহ রাজ্য বিজেপির নেতাদের বলেছেন- তোমরা একাই মার খাচ্ছো? কেন মমতা কি মার খান নি? মমতা যদি সিপিএমের মার খেতে খেতেও লড়াই জারি রেখে একদিন কামিয়াব হতে পারে তোমরা কেন পারবে না?
৩৫৬ ধারার আশায় বসে না থেকে রাজ্য বিজেপির নেতাদের লড়াই করে জমি দখল করার পরামর্শ দিয়েছেন অমিত শাহ। শুধু মমতা নয় নিজের উদাহরণ দিয়ে বলছেন- মার আমিও খেয়েছি। একটা নির্বাচিত সরকার- তৃতীয় দফায় যার বয়স সবে এক পেরিয়েছে চাইলেই দুম করে তাকে ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়। আদালত সেই সরকারকে পুনঃস্থাপনের নির্দেশ দিয়ে বসলে কেন্দ্রের যে মুখ পুড়বে সেই হিসেব মাথায় রাখতে হয় মোদী-শাহকে। বাংলায় দলের শীর্ষে কোন রত্নরা শাহের তা বেশ জানা। কার কি ব্যাকগ্রাউন্ড শাহের তা নখদর্পণে। গোষ্ঠীকোন্দল নিয়ন্ত্রণে না এলে বাংলায় পদ্মের বাগান যে দ্রুতই শুকিয়ে মরে যাবে- এই জ্ঞানও অমিত শাহকে কারও কাছ থেকে ধার করতে হবে না। তাই রাজ্য বিজেপির নেতাদের খোয়াখুয়ি ভুলে সবাইকে এক সাথে কাজ করার সদুপদেশ দিয়েছেন। যদিও তাতে কতটুকু কাজ হবে তা নিয়ে সংশয় আছে রাজনৈতিক মহলের।
বাংলায়ও ঘুটি সাজাবেন শাহই
একটা বিষয় খুব স্পষ্ট- বাংলার নেতাদের এখনও খুব একটা ভরসার যোগ্য বলে মনে করেন না অমিত শাহ। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা হলেও পদ্ম শিবিরের সংগঠনে এখনও শেষ কথা শাহ। বিজেপি চলে মোদীর ক্যারিশ্মা আর শাহের বুদ্ধিতে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে মোদী-শাহ জুটির বিরোধীর সংখ্যা কম নয়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত এই দুই গুজরাটি নেতা দলকে সাফল্য দিয়ে যাবেন ততক্ষণ পর্যন্ত খাপ খোলার মওকা পাবে না বিরোধী লবি। আপাতত অমিত শাহের পাখির চোখ চব্বিশ। চব্বিশের যুদ্ধে বিজেপি জিতলে ঊনত্রিশের আগেই শাহের হাতে ব্যাটন তুলে দিয়ে সাউথ ব্লক থেকে বিদায় নিতে পারেন নরেন্দ্র মোদী। যদিও যোগীকে নিয়েও অনেক প্রত্যাশা বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের একটি বড় অংশের। সে যাই হোক, চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে যে ওয়ার্মআপ অমিত শাহ শুরু করে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ তার বাইরে নয়। তিনমাস পরে আবার দলের হালচাল বুঝতে বাংলায় আসার কথা শাহের। বোঝা যাচ্ছে ঘুটি তিনিই সাজাবেন। তাতে বরং বঙ্গ বিজেপির ক্ষতির সম্ভাবনা কম। কারণ বাংলায় বিজেপি সাবালক হয়েছে এই প্রমাণ এখনও পর্যন্ত বাংলা বিজেপির নেতারা দিতে পারেন নি।
Photo Credit- Official FB page of Bengal BJP.