সিবিআই ডাকে ডাকুক। কিছুতেই ওই প্রেমজালে ধরা দেবো না- অনুব্রতর মতোই এমন কঠিন পণ কি পরেশেরও?
ডেস্ক রিপোর্ট : মন্ত্রীমশাই সকন্যা ট্রেন থেকে হাওয়া! বুধবার সকাল থেকেই রাজ্য জুড়ে তোলপাড় কান্ড। কোথায় গেলেন বঙ্গের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারী? মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন থেকে পদাতিক এক্সপ্রেসে উঠতে দেখা গেছে পরেশবাবুকে। ভোরে শিয়ালদহে ট্রেন পৌঁছালে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীরও নামার কথা। পদাতিক রাইট টাইমে শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছালো ঠিকই কিন্তু মন্ত্রী শিয়ালদহ পৌঁছালেন না। কন্যা অঙ্কিতা সহ মাঝ পথেই কাটিং খেলেন তিনি। পরেশের গায়েব হয়ে যাওয়ার খবর হাওয়ায় ভাসতেই রাজ্যের মানুষ মুখ টিপে হাসতে লেগেছিলেন। আসলে সিবিআইটিসে আক্রান্ত পরেশ অধিকারী এর পর আর কী কী করেন তা নিয়েই যত কৌতূহল, সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি থেকে আম আদমি সবার।
বাবা তৃণমূলে যোগ দিতেই মেয়ের চাকরি লাভ
পরেশচন্দ্র অধিকারী। মেখলিগঞ্জের বিধায়ক। পোড় খাওয়া নেতা। নিজের এলাকায় তাঁর দাপটই আলাদা। ছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লকের বড় নেতা। বাম জামানায় সামলেছেন খাদ্য দফতরের পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব। ২০১৮-র অগাস্টে পরেশবাবুর তৃণমূলে লম্ফ। পরেশ ব্যাঘ্র ছেড়ে জোড়াফুলে নাম লেখানোর ৭২ ঘন্টার মধ্যেই নাকি তাঁর কন্যার নাম স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক নিয়োগের ওয়েটিং লিস্টে উঠে যায়। পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতাকে প্যানেলে জায়গা করে দিতে বলি দেওয়া হয় ববিতা সরকার নামে অন্য এক চাকুরিপ্রার্থীকে। ওয়েটিং লিস্টের ২০ নম্বরে নাম ছিল ববিতার। ববিতাকে সরিয়ে সেই জায়গায় পরেশকন্যার নাম তুলে দেয় স্কুল সার্ভিস কমিশন। দ্বিতীয় কাউন্সেলিংয়ের সময় পুরো ঘটনা জানতে পেরে মাথায় হাত ববিতা সরকারের। তখন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ববিতা বুঝে যান পাল্টিবাজ নেতার মেয়েকে চাকরি পাইয়ে দিতে প্যানেলে ঘাপলা করা হয়েছে। ২০১৮-র ২৪ নভেম্বর মেখলিগঞ্জের একটি স্কুলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা। এদিকে আজও চাকরির প্রতীক্ষায় শিলিগুড়ি কোর্টমোড়ের বাসিন্দা ববিতা।
ইন্টারভিউ না দিয়েই পরেশকন্যার চাকরি!
পরেশ অধিকারীর মেয়ে কীসের ভিত্তিতে চাকরি পেলেন, তার কোনও সদুত্তর আজ পর্যন্ত দিতে পারে নি স্কুল সার্ভিস কমিশন। কারণ সেই মুখই কমিশনের নেই। অভিযোগ যে পরেশকন্যার পার্সোনালিটি টেস্ট পর্যন্ত নেয় নি কমিশন। যাকে বঞ্চিত করে পরেশ অধিকারীর মেয়েকে চাকরি দেওয়া হয়েছিল সেই ববিতার পার্সোনালিটি টেস্ট সহ প্রাপ্ত নম্বর ৭৭। পার্সোনালিটি টেস্ট ছাড়া পরেশকন্যা অঙ্কিতার প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৬১। পার্সোনালিটিতে দশে দশ পেলেও ববিতার নম্বরকে ছাপিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না অঙ্কিতার। তাই মনে হয় ইন্টারভিউয়ের ঝামেলায় না গিয়েই পরেশ অধিকারীর মেয়ের চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশন।
শিক্ষা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়েও শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী!
নিয়োগ দুর্নীতির মামলা আদালতে উঠতেই কমিশনের ঘোটালার হাঁড়ি একে একে ফাটতে শুরু করে। এবার ফেঁসেছেন পরেশ অধিকারী। ঘটনার সময় পরেশ ছিলেন প্রাক্তন বিধায়ক। একুশের নির্বাচনে মেখলিগঞ্জ আসন থেকে জিতে বিধানসভায় ফিরতেই তাঁকে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সময় পরেশ অধিকারীর মন্ত্রিত্ব প্রাপ্তিতে অবাক হয়েছিলেন অনেকেই। তাও আবার শিক্ষা দফতরে! নিজের মেয়েকে কারচুপি করে শিক্ষিকার চাকরি পাইয়ে দেওয়ার পুরস্কার স্বরূপই পরেশকে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী করা হল কিনা, এই প্রশ্নও তুলেছিলেন কেউ কেউ।
পরেশকে আর শিক্ষামন্ত্রী দেখতে চান না বিচারপতি
মঙ্গলবার নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় পরেশ অধিকারীকে সিবিআই জেরার মুখোমুখি হওয়ার নির্দেশ দেয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিঙ্গেল বেঞ্চ। রাত আটটার মধ্যে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীকে সিবিআই দফতরে পৌঁছানোর নির্দেশ দেন বিচারপতি। পরেশকে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে রাজ্যপালের পদক্ষেপ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। আদালতের নির্দেশ যখন কানে এসে পৌঁছায় তখন নিজের নির্বাচনী এলাকায় দলীয় কর্মসূচিতে ব্যস্ত ছিলেন পরেশ অধিকারী। সিবিআই-এর কথা শুনেই ডাকাবুকো নেতার মন ও শরীর থেকে হাওয়া বেরিয়ে যায়। মন্ত্রীর কাছাকাছি থাকা অনুগামীদের সূত্রে তেমনটাই জানা যাচ্ছে। মনমড়া হয়ে মঞ্চ থেকে নেমে আসেন তিনি। সিবিআই ডাকলেই রাজ্যের শাসকদলের নেতারা কী কী কাজ করে থাকেন তা সাংবাদিক থেকে সাধারণ মানুষ- সকলের এতদিনে মুখস্ত হয়ে গেছে। পরেশ অধিকারী সিবিআই তদন্তের মুখোমুখি হবেন কিনা- সিঙ্গেল বেঞ্চের নির্দেশের বেরোনোর পর থেকেই সেই দিকে তাকিয়ে ছিলেন সবাই।
সিবিআই থেকে বাঁচতে ডিভিশন বেঞ্চে পরেশও
দেখা গেল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পরেশ অধিকারী মেয়ে অঙ্কিতাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার ট্রেনে উঠলেন বটে কিন্তু ট্রেন থেকে নামলেন না। ট্রেন থেকে বর্ধমানে নেমে সড়ক পথে কলকাতায় ঢুকে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ঘাপটি মেরেছেন বলে খবর। তার আগে অবশ্য আইনজীবী মারফত সিঙ্গেল বেঞ্চের নির্দেশের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে মামলা ঠুকে খানিকটা অক্সিজেন টেনে নিলেন পরেশ অধিকারী। কিন্তু কতদিন পর্যন্ত সিবিআইকে দর্শন না দিয়ে বাঁচতে পারবেন পরেশ? বুধবারই নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে সিঙ্গেল বেঞ্চের সিবিআই তদন্তের নির্দেশ বহাল রাখল ডিভিশন বেঞ্চ। এদিনই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ফের সিবিআই দফতরে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিল বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সিঙ্গেল বেঞ্চ। সন্ধ্যা ছটার মধ্যে সিবিআই দফতরে না পৌঁছালে পার্থকে হেফাজতেও নিতে পারবেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকেরা- এমনই নির্দেশ আদালতের। এইসব শোনার পর পরেশের মনের অবস্থা কেমন, কে জানে!
Photo source- Reporter and collected.