মুছতে হবে জেনেও কি দেবাংশু পোস্ট ভাইরাল করলেন ইচ্ছে করেই? দেবাংশুকে দিয়ে পোস্ট লেখালেনই বা কে? মুছতেই বা বাধ্য করলেন কে?
বিশেষ প্রতিবেদন : দলের মধ্যে সময়টা মোটেই ভাল যাচ্ছে না দেবাংশু ভট্টাচার্যের। রাত পোহালেই ২’রা মে- তৃণমূলের হ্যাট্রিক বিজয়ের বর্ষপূর্তি। আর তার আগের দিনই কিনা ঠ্যালা খেয়ে তড়িঘড়ি পোস্ট মুছতে হল দেবাংশুকে। বর্ষপূর্তির আগের দিন নিজের ফেসবুক পেজে কী এমন বিস্ফোরক পোস্ট লিখেছিলেন দেবাংশু যে পোস্ট ভাইরাল হওয়ার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই তা মুছে দিয়ে সাফাই দিতে হল তৃণমূলের ক্যারিশ্মাটিক যুবনেতাকে? দেবাংশু ভট্টাচার্য লিখেছিলেন- ” গতবছর ঠিক আজকের দিন পর্যন্ত রাজ্যে যে তৃণমূলটা ছিল, সেটাই নিষ্কলুষ, ধান্ধাবাজবিহীন, অকৃত্রিম, প্রকৃত তৃণমূল। তারপর তো বন্যা এল। গঙ্গার জল, ড্রেনের জল সব মিলেমিশে একাকার। তবুও দলে একটা স্ট্রং ফিল্টার আছে বলেই বিশ্বাস। তারা পেছনের সারিতেই থাকবেন, সেটাও বিশ্বাস করে দলের কর্মীরা। “
কাদের নর্দমার জল বললেন দেবাংশু?
ডিলিট করে দেওয়া পোস্টে দেবাংশু যা বলতে চেয়েছেন তা এতটাই জলের মতো স্বচ্ছ যে বুঝতে কারোরই বিশেষ বেগ পেতে হচ্ছে না। দেবাংশুর আক্ষেপ- একুশের পয়লা মে পর্যন্ত তৃণমূল দলটা ছিল পুণ্যসলিলা গঙ্গার মতোই পবিত্র। দোসরা মে থেকে গঙ্গায় নর্দমার জল মিশতে শুরু করল। আজকের তৃণমূলে গঙ্গার জল আর নর্দমার জল মিলেমিশে এক বলেই মনে করেন যুব তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক। তৃণমূলে ড্রেনের জল বলতে কাদের নিশানা করেছেন দেবাংশু? নেটপাড়ার বাসিন্দারা খিল্লি জুড়েছেন- দিদির ঘরের দরজায় শুয়েও যাদের দলে ফেরা আটকাতে ব্যর্থ, তাদেরকেই মনের দুঃখে আজ নর্দমার জল বলছেন দেবাংশু ভট্টাচার্য।
মুকুল-শুভেন্দু-রাজীব-সব্যসাচীরা যদি তৃণমূলে ফিরতে চান তবে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরের দরজায় শুয়ে পড়ে হলেও তাঁদের দলে ফেরা আটকাবেন বলে একুশের ভোটের আগে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দেবাংশু ভট্টাচার্য। মমতা ক্ষমতায় ফেরার ছয়মাসের মধ্যেই শুভেন্দু অধিকারী বাদে বাকিরা সবাই তৃণমূলে ফিরে এসেছেন। একজন করে বিজেপি থেকে ঘর ওয়াপসি করতেই সোস্যাল মিডিয়ায় খিল্লির পাত্র হতে হয় দিদি অন্তঃপ্রাণ দেবাংশুকে।
দেবাংশুর ক্ষতে নুন ছেটালেন সুকান্ত
দেবাংশু সুবক্তা। মিডিয়ায় তৃণমূলের সবথেকে জনপ্রিয় মুখ। তৃণমূলের তরুণ ব্রিগেডের ভেতরে দেবাংশুর ডিমান্ডও দারুণ। খেলা হবে গান লিখে ভোটের আসর একা মাতিয়ে দিয়েছিলেন দেবাংশু ভট্টাচার্য। মমতাকে মা ডাকে ছেলেটা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত লোকসভা-বিধানসভা তো দূরের কথা একটা পুরসভার টিকিটও জোটাতে পারে নি দেবাংশু। তবে দেবাংশুর বুক ফাটে তো মুখ ফাটে না। যখন প্রাণে সয় না তখন এভাবেই ইঙ্গিতে মনের দুঃখ ব্যক্ত করার চেষ্টা করেন তৃণমূলের এই যুবনেতা। কিন্তু ঠ্যালা খেয়ে সেই পোস্টও মুছে দিয়ে বিরোধীদের কটাক্ষ হজম করতে হয় বেচারাকে। রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার যেমন বলেছেন,” হতাশ হয়ে লিখেছেন হয়ত। বাচ্চা ছেলে। আগে বলেছিলেন, এরা যদি তৃণমূলে ফিরতে চায়, দরজার সামনে শুয়ে পড়ে এদের তৃণমূলে ফেরা আটকাব। এরপর দেখা গেল, উনি পাপোশ হয়ে শুয়ে থাকলেন, আর যারা তৃণমূল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তাঁরা পা মুছে ঢুকে গেলেন। সেই জন্যেই হতাশা বেড়ে গিয়েছে।” হতাশা কাটাতে দেবাংশুকে যোগা করারও পরামর্শ দিয়েছেন সুকান্ত।
২’রা মে’র পর তৃণমূলে ড্রেনের জল ঢুকলেও দলের ভেতরে একটা স্ট্রং ফিল্টার আছে বলে বিশ্বাস করেন দেবাংশু। দেবাংশুর এই ফিল্টারের নাম যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেবাংশুর এখনও ক্ষীণ আশা- পাল্টিবাজদের পেছনের সারিতেই রাখবেন দলনেত্রী। অথচ বাস্তব এটাই যে ফিরে এসে দলে বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছেন অনেকেই। বাবুল সুপ্রিয় আগে তৃণমূল না করলেও বিজেপিতে থাকতে দু’বেলা নিয়ম করে মমতা-অভিষেককে তীব্র কটাক্ষ-উপহাসে ভরিয়ে দিতেন। সেই বাবুলও আজ তৃণমূলে জয়েন করার সাত মাসের মধ্যেই বিধায়ক অথচ মায়ের জন্য জান-মান কবুল করেও দেবাংশুর প্রাপ্তি বলতে শুধুই মায়ের শুকনো আশীর্বাদ।
দেবাংশুর পোস্টে মমতাও নাকি রুষ্ট!
চাপে পোস্ট ডিলিট করার পর দেবাংশুর মনের ভেতর কী চলছে তা বুঝতে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদেরও অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু মনে যাই থাক বাইরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন অভিষেক ঘনিষ্ঠ এই যুবনেতা। আগের পোস্ট মুছে দিয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে দেবাংশু লেখেন- ” শেষ পোস্টের অর্থ হয়ত ঠিকঠাক বোঝাতে পারি নি। অকারণ বিতর্ক হচ্ছে। তাই পোস্ট ডিলিট করলাম। কর্মীরাই দলের সম্পদ। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। তৃণমূল কংগ্রেস শৃঙ্খলাবদ্ধ দল। দলের সিদ্ধান্তের উপর ভরসা রাখতে হবে। এই দলে কর্মীদের স্বার্থ সবার আগে দেখা হয়। কারণ এই দলের নেত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। “
তৃণমূলের অন্দরে দেবাংশু ভট্টাচার্য অভিষেক ব্যানার্জি লবির লোক বলেই রাজনৈতিক মহল জানে। অভিষেকের সঙ্গে তৃণমূলের প্রবীণ নেতাদের দ্বন্দ্ব আর গোপন নেই। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিষেককে একটু দূরে দূরেই রাখছেন। এরপর থেকেই আগের মতো আর প্রকাশ্যে ঘন ঘন মুখ খুলছেন না তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড। অভিষেক আদৌ আর তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড পদে আছেন কিনা তা নিয়েই অনেকের সন্দেহ। এই পরিস্থিতিতে দলের মধ্যে দেবাংশুর পজিশন ভাল থাকে কীভাবে? দেবাংশু মিডিয়া-সোস্যাল মিডিয়ায় যতই জনপ্রিয় হোন না কেন ববি-পার্থ-কল্যাণদের মতো সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে তাঁর কেমন মধুর সম্পর্ক তা তৃণমূলের ভেতরে সবার জানা। দেবাংশুর বিতর্কিত পোস্ট চোখে পড়তেই তৃণমূলের ভেতরে তুমুল আলোড়ন ওঠে বলে জানা গেছে। প্রবীণ নেতারা রুষ্ট হন। বিজেপি থেকে ফিরে আসারাও কাঠি করা শুরু করেন। বিষয়টি মমতার কানে তুলতে দেরি করেন নি অভিষেক বিরোধী শিবিরের নেতারা। পোস্ট পড়ে তৃণমূল সুপ্রিমোও চটে যান বলে খবর। বেগতিক বুঝে পোস্ট ডিলিট করতে দেরি করেন নি দেবাংশু। যদিও ততক্ষণে পোস্ট ভাইরাল।
দেবাংশুর পোস্টে অন্য কারও হাত নেই তো?
রাজনৈতিক মহলে অন্য একটি তত্ত্বও ভাসছে। কেউ কেউ বলছেন, বিতর্কিত পোস্ট এক সময় ডিলিট করতে হবে জেনেও তৃতীয় জয়ের বর্ষপূর্তির আগের দিন পোস্ট করে হাওয়া গরম করে দিলেন দেবাংশু ভট্টাচার্য। পুরসভা ভোটের আগেও দলকে অস্বস্তিতে পড়তে হয় এমন পোস্ট করেছিলেন দেবাংশু। রবিবার দেবাংশুর যে পোস্টের কারণে এত বিতর্ক তার পেছনে তৃণমূলের শীর্ষ কোনও মাথার মদত থাকলেও থাকতে পারে বলে অনেকের অনুমান।
Photo Credit- Official FB page of Debangshu Bhattacharya.