বঙ্গ বিজেপির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধান্ধাবাজরা বাসা বেঁধেছিল। একুশে নবান্ন ফস্কে যেতেই এদের অনেকে ভাগলবা। নতুন রাজ্য সভাপতি কাউকে কাউকে পদ থেকে সরিয়ে দিতেই তারা স্বমূর্তি ধারণ করলেন। কিন্তু ভোগীরা নয় বিপদের দিনে বাংলার বিজেপিকে বাঁচাবেন ত্যাগীরাই।লিখলেন নির্বাণ রায়-
পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিতে অসন্তোষের আগুন। একুশে নবান্ন দখলের চরম প্রত্যাশা জাগিয়েও ব্যর্থতা! আর তার পর থেকেই রাজ্য বিজেপিতে ডামাডোল। তবে ইদানিং বঙ্গের পদ্মশিবিরে কোন্দল যেন চরমে উঠেছে। দলের ভেতরে হঠাৎ হঠাৎ পদত্যাগের ফুলকি, নেতাদের বিরূপ মন্তব্য বিজেপি বিরোধী শক্তি ও মিডিয়ার আমোদের কারণ হয়ে উঠছে। একটা তিক্ত বাস্তব হল এই সব হওয়ার যথেষ্টই কারণ আছে এবং আরও অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। কেন বঙ্গ বিজেপির অন্দরে বিদ্রোহ ঘটার সঙ্গত কারণ আছে ? সেই প্রসঙ্গেই আসছি।
মধুলোভীদের চাক ভেঙে দিতেই শোরগোল
আসলে বঙ্গ বিজেপির সংগঠনের বুকের ওপর নিজেদের আখের গোছানো, ধান্ধাসর্বস্ব নেতাদের জগদ্দল পাথর হয়ে বসে থাকার ঘটনা তো নতুন নয়। বিজেপি বাংলায় ক্ষমতায় আসতে পারে এই গন্ধ পেয়ে বহু পচানেতা মুরলীধর সেন লেনের গৈরিক ভবনে লাইন দিয়েছেন এবং চ্যানেল করে একে একে ঢুকেও পড়েছেন। একুশের দোসরা মের পর যে মধুলোভীদের মোহভঙ্গ হয়েছে তাঁরা একে একে কেটেও পড়েছেন। তারপরেও এমন অনেকে রাজ্য বিজেপিতে রয়ে গেছেন যারা নিজেদের কামাই-ধামাই ছাড়া আর কিছু বোঝেন না। তবে সুকান্ত মজুমদার বিজেপির রাজ্য সভাপতি হয়ে এসে এই মধুলোভীদের চাকে জোরেসোরেই বাড়িটি মেরেছেন। আখের গোছানো বেশ কয়েকজন নেতাকে পদের গুরু দায়িত্ব থেকে এবারের মত অব্যাহতি দিয়েছেন বিজেপির রাজ্যসভাপতি সুকান্ত মজুমদার ও সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তী। পদ খুইয়ে এদের এখন মাথা ঠিক নেই। পদের মায়া বড় মায়া। মাথা ঠিক না থাকাই স্বাভাবিক।
কিন্তু সুকান্ত মজুমদার ভুলটা করেছেন কী? নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ সহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুমোদন ছাড়াই সুকান্ত মজুমদার সংগঠন পুনর্গঠন করছেন বলে আপনাদের মনে হয়? রাজ্য বিজেপির উত্তরবঙ্গ আর দক্ষিণবঙ্গের পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য রাখলেই বোঝা যায় কাদের জন্য দলের মুখ পুড়ছে বারেবারে। বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত মজুমদারকে যেদিন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য বিজেপির সভাপতির চেয়ারে বসান সেদিনই বোঝা গিয়েছিল বাংলায় বিজেপির হালচালে বড় বদল চায় দিল্লির দীনদয়াল ভবন। বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণবঙ্গে বিজেপির ফল উত্তরবঙ্গের মতো হলে এখন হয়তো নবান্নে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী থাকতেন। দক্ষিণবঙ্গে বিজেপির ফল ভাল না হওয়ার বড় কারণ যে দলের ভেতরেই লুকিয়ে তা সবথেকে ভাল জানেন বিজেপির নেতা-কর্মীরাই। আসল কথা হল দক্ষিণবঙ্গের পদসর্বস্ব নেতাদের আলস্য ও অর্থলোলুপ প্রবৃত্তিই ২০২১ সালে জয় থেকে পদ্মশিবিরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে আত্মচিন্তনে নেমে কেন উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে গড়িমসি করবেন বিজেপির নতুন রাজ্যসভাপতি? দক্ষিণবঙ্গের ধান্ধাসর্বস্ব নেতাদের হেফাজতে বিজেপি থাকলে বিজেপির জনভিত্তিতে ধ্বস অনিবার্য। এদের তাই সরিয়ে দেওয়া ছাড়া সুকান্ত মজুমদারের সামনে আর কোনও রাস্তা ছিল না।
ম্যানেজ না হওয়াতেই কি সুকান্তর উপর সবার এত রাগ?
উনিশের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে একুশের বিধানসভা ভোটের দোরগোড়া তক বানের জলের মতো তৃণমূল থেকে লোক ঢুকছিল বিজেপিতে। কোনও ফিল্টার ছিল না প্রবেশপথে। চোরচোপ্টা, চিটিংবাজ সবাইকে পদ্মবাগানে স্থান দেওয়া হল। শুনতে খারাপ লাগলেও এই কথাটা আজ আর চেপে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না- রীতিমতো উৎকোচের বিনিময়ে তৃণমূলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বিজেপি ঢোকানো ও ভোটে টিকিট পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঘুষটা খেয়েছিলেন কারা? বিজেপির বড় বড় নেতারাই খেয়েছিলেন। দিল্লিতে বিজেপির তিন শীর্ষ নেতার কানে সব তথ্যই পৌঁছেছে। এবার তাই ব্যবস্থা নেওয়ার পালা। এবং সেই ব্যবস্থাটাই নিচ্ছেন সুকান্ত মজুমদার। সুকান্ত মজুমদার নিজে সংঘের লোক। বাংলায় দলের সংগঠনে সংঘের লোকেদের প্রাধান্য বাড়ুক এটাই চাইছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
রাজ্য বিজেপির আরামপ্রিয় নেতারা ভেবেছিলেন পদ তাঁদের পার্মানেন্ট। যখন দেখলেন পেছন থেকে চেয়ার সরে গেছে তখন প্রাথমিক ধাক্কায় হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন। শক কাটিয়ে ওঠার পর শুরু করলেন চিল্লাফাল্লা। এবং সেটাই স্বাভাবিক। রাজ্য বিজেপিতে কামিনী-কাঞ্চন কালচার কাদের আমদানি? আন্দোলন-সংগ্রাম না করে ঠান্ডাঘরে বসে কাঠিবাজি, রাজ্যের শাসকদলের কাছে ঘরের খবর সাপ্লাই দিয়ে টাকা খাওয়া আর কতদিন? এরা ভেবেছিলেন দলের নতুন রাজ্যসভাপতিকে ম্যানেজ করে দিব্যি নাশকতার কাজটি চালিয়ে যাবেন। যখন এরা দেখলেন সেই গুড়ে বালি তখন টনক নড়ল। দিল্লিতে দালাল ধরেও যখন পদ রাখা গেল না তখন বাকি রইল বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহের খবরই এখন রোজ হেডলাইন হচ্ছে মিডিয়ায়।
বিজেপির যতটা ভাল ততটাই খারাপ করেছেন দিলীপ
দিলীপ ঘোষের অধঃপতন যে কোনও নিবেদিতপ্রাণ বিজেপি কর্মীকে ব্যথিত করার জন্য যথেষ্ট। নিঃসন্দেহে দিলীপ ঘোষ পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সবথেকে সফল সভাপতি। কিন্তু আবার তাঁর জন্যই অনেক চড়া মূল্য দিতে হয়েছে রাজ্য বিজেপিকে।প্রচারকের কৃচ্ছ্রসাধনের জীবন কাটিয়েও যেই প্রচারের আলো ও ক্ষমতা পেলেন ওমনি তিনিও গা ভাসিয়ে দিলেন ক্যালকেশিয়ান রাজনৈতিকদের বিলাসবহুল জীবনযাপনে। গরম গরম কথাবার্তা, হুমকি ইত্যাদির প্রভাবে এবং মিডিয়ার সহায়তায় তিনি হয়ে উঠলেন বঙ্গ বিজেপির মুখ। কিন্তু বুথ লেভেলে যখন পার্টির কর্মীরা মার খাচ্ছে, খুন হয়ে গেছে অসংখ্য বিজেপি কর্মী তখন কিন্তু দিলীপ ঘোষকে দেখা যায়নি। নেতাদের গাড়ি ভাঙচুর হলে থানা ঘেরাও হয়, বিক্ষোভ হয়। কিন্তু যে শতাধিক বিজেপির কর্মী খুন হয়েছে তাঁদের নিয়ে দিলীপ ঘোষের মাথাব্যাথা কমই ছিল বলে জনসাধারণের ধারণা। এখন দিলীপ ঘোষ বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি। কিন্তু তিনি কি পদের মর্যাদা রাখছেন? সুকান্ত মজুমদারকে অস্বস্তিতে ফেলতে বিদ্রোহীদের উস্কানি দিয়ে যাচ্ছেন কেন দিলীপ ঘোষ?
শুভেন্দু সংগঠনের সঙ্গে দূরত্ব রাখছেন কেন?
নিঃসন্দেহে এই মুহুর্তে রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখ শুভেন্দু অধিকারী। রাজ্য বিধানসভায় বিরোধীদলের নেতা তিনি। বাম জামানায় নন্দীগ্রামে ভূমি রক্ষার আন্দোলনের অন্যতম কান্ডারী শুভেন্দুর সাংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা প্রশ্নাতীত। বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানোর পর থেকেই বিজেপির অন্দরেও অনেক কর্মী-সমর্থকেরও নয়নের মণি হয়ে উঠেছেন শুভেন্দু অধিকারী। বিধানসভা ভোটের কয়েক মাস আগে শুভেন্দু অধিকারী কেন তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে এসেছিলেন সেই কথা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহল জানে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের ভাইপোকে বেশি বেশি তোল্লা দিতে থাকায় মূলতঃ অভিমানেই তৃণমূল ত্যাগ করে বিজেপিতে আসা শুভেন্দুর। নিঃসন্দেহে বড় নেতা। বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব পালন করছেন। রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে ঘনঘন কর্মসূচিও নিচ্ছেন। কিন্তু তারপরেও বিজেপির সাংগঠনিক নেতৃত্বের সঙ্গে শুভেন্দুর একটা দূরত্ব যেন থেকেই যাচ্ছে। প্রশ্ন হল, এই দূরত্বটা কি শুভেন্দু অধিকারী ইচ্ছে করেই জিইয়ে রেখেছেন? নাকি বিজেপির সাংগঠনিক নেতৃত্বই তাঁর সঙ্গে ঠিকঠাকভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে না? এখনও বোঝা যাচ্ছে না মুকুল রায় যেভাবে ২০২১– এ দলের মধ্যে থেকে দলকে পেছন থেকে ছুরি মেরে ছিলেন সেরকম কোনও অবতারে শুভেন্দু অধিকারীকে ২০২৬ এর নির্বাচনে দেখা যাবে কি যাবে না! মোট কথা, শুভেন্দুকে নিয়ে এখনও দ্বন্দ্বে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এমনকি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও।
পাল্টিবাজ নেতারা নয় সম্পদ মার খাওয়া কর্মীরাই
তাহলে কি এই মুহুর্তে নেতৃত্বের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের গেরুয়া শিবিরে সবটাই হতাশার? উত্তর- না নেতাদের দলের আদর্শের প্রতি বিশ্বাস-ভালোবাসা না থাকলেও বিজেপির সাধারণ কর্মী-সমর্থকেরা দলের জন্য এখনও জান-মান-সম্পদ বলি দিতে প্রস্তুত। নেতাদের খোয়াখুয়ি, লোভ-লালসা দেখে কর্মী-সমর্থকেরা নিঃসন্দেহে বিরক্ত কিন্তু তারা নেতা দেখে নয় জাতীয়তাবাদী আদর্শের টানে বিজেপিতে এসেছে। এরা বিজেপির নেতা বলতে একজনকেই বোঝে- তিনি পিএম মোদী। রাজ্যের নেতাদের আচরণে মনে ব্যথা পেলেও দলের কাজে এরা পিছিয়ে থাকে না। এই বাজারেও বিজেপির কর্মসূচিগুলির দিকে চোখ রাখলেই বিষয়টা বুঝতে পারবেন। সভা-সমাবেশ, মিছিল-আইন অমান্যে ভিড় করছে যারা, তাদের পদ-পদবি আর অর্থের আকর্ষণ নেই। বিজেপি করার অপরাধে এরা পাড়ায় ঢুকলে থ্রেট খায়। পুলিশ এদের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা সাজায়। এদের রুটিরুজি পর্যন্ত বন্ধ করে দেয় শাসকদলের লোকেরা। তারপরেও এরা পদ্মপতাকা হাতে দলের সভায় যোগ দেয়। সভা ভরায়। নেতারা ভরা সভায় গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাহারায় নিরাপদে ঘরে ফিরে যান।
সুকান্ত মজুমদার-অমিতাভ চক্রবর্তী যদি পদলোভী, অর্থলোভী নেতানেত্রীদের বদলে বিজেপির ত্যাগী কর্মীদের যোগ্য সম্মান দেওয়া শুরু করেন তবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উচিত দলের বর্তমান রাজ্য নেতৃত্বের হাত শক্ত করা। যারা মাঠে নেমে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে ইচ্ছুক একমাত্র তাঁদেরই এবার দলের সর্বস্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ দিক পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব। একমাত্র তবেই চব্বিশে এবং ছাব্বিশে রাজ্যবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাবে বিজেপি। বাংলার মানুষের যে বিপুল সমর্থন এখনও বিজেপির পেছনে আছে, তাতে একটু চেষ্টা করলেই জনবিরোধী সরকারটিকে নবান্ন থেকে উৎখাত করা সম্ভব।
- মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
Feature Image is representational.