তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই অভিযুক্ত আইসিকে পুলিশ সুপারের ক্লিনচিট! তপন কান্দু হত্যা মামলায় পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তদন্ত সিবিআইকে দিল হাইকোর্ট
কলকাতা :শেষ পর্যন্ত সিবিআইয়ের হাতেই গেল ঝালদার কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু হত্যা মামলা। সোমবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার একক বেঞ্চ মামলাটিকে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিল। গত ১৩ মার্চ সন্ধ্যার দিকে ঝালদার গোকুলনগরে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করার সময় তপন কান্দুকে কয়েকজন দুষ্কৃতী মোটরবাইকে চেপে এসে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে হত্যা করে। ঝালদা পুরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ড থেকে কংগ্রেসের প্রতীকে বিজয়ী হয়েছিলেন তপন। ঘটনার পরপরই সিবিআই তদন্ত দাবি করেছিলেন নিহত কংগ্রেস কাউন্সিলরের স্ত্রী পূর্ণিমা কান্দু। পূর্ণিমা নিজেও ঝালদার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস কাউন্সিলর। তপন কান্দু খুনের তদন্তে সিট গঠনের নির্দেশ দেয় নবান্ন। যদিও সিবিআই চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন পূর্ণিমা।
তপন কান্দু হত্যা রহস্যের সমাধানে রাজ্য সরকার সিট গঠন করলেও ঘটনার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এই মামলাতেও রাজ্য পুলিশের উপর ভরসা করতে পারল না আদালত। সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে গিয়ে বিচারপতি বলেন, “মামলার অভিযোগকারী এবং ঝালদার মানুষের মনে আস্থা ফেরানোর জন্য সিবিআই তদন্ত জরুরি।” কংগ্রেস কাউন্সিলর খুনের তদন্তে পুলিশের চেষ্টায় খামতি আছে বলে আদালতের পর্যবেক্ষণ। তপন কান্দু খুনের সঙ্গে ঝালদা থানার আইসি সঞ্জীব ঘোষের নাম জড়িয়ে গেছে। ঘটনার পরেই আইসির দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন নিহতের স্ত্রী। কিন্তু নিহতের স্ত্রী এবং কংগ্রেসের অভিযোগে কর্ণপাত না করে রবিবার সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে প্রকাশ্যেই আইসিকে ক্লিনচিট দিয়ে বসেন পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার এস সেলভামুরুগন। দেখা গেল তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই অভিযুক্তের হয়ে সংবাদ মাধ্যমের সামনে পুলিশ সুপারের সাফাই গাওয়ার ঘটনাকে মোটেই ভাল চোখে নেয় নি হাইকোর্টও। সোমবার রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা প্রশ্ন তুলেছেন, “তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই পুলিশ সুপার অভিযুক্ত আইসিকে ক্লিনচিট দিলেন কীভাবে?”
তপন কান্দু হত্যা মামলার যাবতীয় নথি অবিলম্বে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতে সিটকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সিবিআইকে ৪৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে বলেছে হাইকোর্ট। দিন কয়েক আগে বগটুই গণহত্যা কান্ডের তদন্তভারও সিটের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সিবিআইয়ের হাতে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। বগটুই নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায় নি রাজ্য। তপন কান্দু হত্যা মামলায় সিঙ্গেল বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার ডিভিশন বেঞ্চে আবেদন করবে কিনা এখনও স্পষ্ট নয়।
২৭ ফেব্রুয়ারির পুরভোটে ঝালদা পুরসভা ত্রিশঙ্কু হয়। ১২ সদস্যের ঝালদা পুরসভায় তৃণমূল ও কংগ্রেস- পাঁচটি করে আসন জেতে। নির্দল জেতে দুটি ওয়ার্ডে। বোর্ড তৃণমূলকে পাইয়ে দিতে ঝালদার আইসি সঞ্জীব ঘোষ আসরে নামেন বলে কংগ্রেসের অভিযোগ। ঘটনার তিনদিন আগে তপন কান্দুকে থানায় ডেকে এনে তৃণমূলে যোগ দিতে আইসি জোরাজুরি করেন এমনকি হুমকি দেন বলে স্ত্রী পূর্ণিমা কান্দুর অভিযোগ। তপনের ভাইপো মিঠুন কান্দুর সঙ্গে আইসির ফোনে কথোপকথনের অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়। তৃণমূলে যোগদানের ব্যাপারে আলোচনা করতে কাকা যাতে পুরোনো থানায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে ফোনে সে’সব নিয়ে মিঠুনকে চাপ দিতে শোনা যায় ভাইরাল হওয়া অডিও ক্লিপে।
অডিও ক্লিপ ভাইরাল হওয়ার পরেও বিধানসভায় দাঁড়িয়ে আইসিকে প্রকারান্তরে আড়াল করতে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রীকে। যদিও মান বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত সঞ্জীব ঘোষকে ঝালদা থানার আইসির পদ থেকে সরিয়ে দেয় রাজ্য পুলিশ। এখনও পর্যন্ত তপন কান্দু খুনের ঘটনায় ভাইপো দীপক ও দাদা নরেন ছাড়াও আরও দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। একজনের নাম কলেবর সিংহ, তাকে গত ৩১ মার্চ ঝাড়খন্ড থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের আরেকজনের নাম আশিক খান। পারিবারিক বিবাদের জেরেই তপন খুন হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। যদিও নিহতের স্ত্রীর অভিযোগ- তাঁর স্বামীকে খুনের নেপথ্যে মূল ষড়যন্ত্রী ঝালদা থানার অপসারিত আইসি সঞ্জীব ঘোষ। রবিবারই এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আইসিকে নির্দোষ বলে দাবি করেন পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার।
আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় খুশি পূর্ণিমা কান্দু। এবার স্বামী খুনের তদন্ত সঠিক পথে এগোবে বলে আশা পূর্ণিমার। তিনি বলেন, ” স্বামীর হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই আমি। এই ঘটনায় আইসিও জড়িত আছে। আইসিরও যেন ফাঁসি হয়।” হাইকোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় আশার আলো দেখছেন পুরুলিয়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নেপাল মাহাতোও। নেপাল মাহাতো বলেন, ” আইসিকে ক্লিনচিট দিতেই রবিবার সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন এসপি। রাজ্যের হাতে থাকলে পুলিশ এই মামলাকে প্রভাবিত করতই। হাইকোর্টের রায়ে আমরা খুশি। আশা করি সুবিচার মিলবে।”
Photo Crediit- Facebook and File.