অবসাদের গভীর আঁধারে, হতাশার অকূল পাথারে আশার টিম টিমবাতিঘরহয়েও যিনি জ্বলছেন তাঁর নাম বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
বিচারপতিদের আরেক নাম ন্যায়াধীশ- অর্থাৎ যিনি ন্যায়ের অধীশ বা কর্তা। মানুষকে ন্যায় দান করাই যাঁর কাজ। ন্যায়ের আরেক নাম সত্য। যা সত্য তাকে প্রতিষ্ঠা করাই বিচারপতির কাজ। এইজন্যই মর্ত্যের বিচারপতিদের আমরা বলি ধর্মাবতার। বিচারপ্রার্থীকে ন্যায় দান করা জগতের সব থেকে শক্ত কাজ। মানুষকে যিনি ন্যায় দান করার গুরু দায়িত্ব পালন করেন তাঁর চরিত্রে চারটি গুণ থাকা আবশ্যক- নির্লোভ, সততা, সাহস ও নিরপেক্ষতা। অসৎ, ভীরু, লোভী এবং পক্ষপাত দুষ্ট বিচারক কখনও কাউকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দিতে পারেন না। মানুষ ন্যায়ের জন্য বিচারালয়ে যান কিন্তু কতটুকু ন্যায় পান? প্রভাবশালীদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার নামই কি বিচার? দিনের পর দিন ধরে মামলা ঝুলে থাকে। শুনানির পর শুনানি চলতে থাকে। এক শুনানি থেকে আরেক শুনানির ব্যবধান দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। কিন্তু রায় মেলে না। যিনি বিচারকের আসনে বসেন মানুষ তাঁর কাছ থেকে সততা, সাহস ও নিরপেক্ষতা আশা করেন। কিন্তু বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভাগ্য ধর্মাবতারদের কাতারে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়দের সংখ্যা চিরকালই হাতে গোনা।
একটা রাজ্যে নিয়োগের পর নিয়োগে দুর্নীতি। শিক্ষক-অশিক্ষক-গ্রুপ সি- গ্রুপ ডি এমনকি আধিকারিক প্রত্যেকটি নিয়োগের বিরুদ্ধে ভুড়ি ভুড়ি দুর্নীতির অভিযোগ। মামলার পর মামলা। এবং ঝাঁপি খোলা মাত্রই দুর্নীতির দুর্গন্ধ। টাকা দিয়ে অযোগ্যরা চাকরি পাচ্ছে। যোগ্যরা বাতিল হচ্ছে। পরীক্ষায় কারচুপি। মূল্যায়নে জল। ওএমআর শিটে ভেজাল। নিয়োগের সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ পদাধিকারীরা পর্যন্ত আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। গোটা একটা প্রজন্ম সরকারি চাকরির নিয়োগ পত্রের প্রত্যাশায় থাকতে থাকতে যৌবনকাল খোয়াতে চলল কিন্তু বিচার মিলছে না। বিচারকের আসনে বসে একজন মানুষ সব দেখছেন। বুঝছেন। নিয়োগ পক্রিয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে নগ্ন ভ্রষ্টাচার। চাকরি বঞ্চিত সন্তান তুল্য ছেলেমেয়েদের দীর্ঘশ্বাস তাঁর বিবেকককে দংশিত করছে। তিনি পদক্ষেপ করতে চান। পদক্ষেপ করছেনও। অন্যায়ের একটা প্রতিবিধান চান। প্রতিবিধান করছেনও। তাঁর কলম ন্যায়ের পক্ষে রায় দিচ্ছে। কিন্তু এই ধর্মযুদ্ধে তিনি বড় একলা। তিনি অন্যায়ের একটা শেষ দেখতে চান। কিন্তু তাঁর হাত থেকে বারে বারে ন্যায়দন্ড কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। পর্দার পেছনে কারা কোন অধর্মের কলকাঠি নাড়াচাড়া করছে তিনি সব বুঝছেন। কিন্তু অধর্মের কুলোর বাতাসে সবাই টলে গেলেও তিনি টলছেন না। তিনি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। অবসাদের গভীর আঁধারে, হতাশার অকূল পাথারে আশার টিম টিম বাতিঘর হয়েও যিনি জ্বলছেন তাঁর নাম বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
ন্যায়ের পথে সহযাত্রীর সংখ্যা চিরকালই কম। এই পথে বিবেকের ডাকে একলা চলতে হয়। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ও একলা। শুধু একলাই নয় ন্যায়ের মঞ্চে তিনি কোনঠাসাও। তিনি নিয়োগ দুর্নীতির শেষ দেখতে চান। আবার তাঁরও শেষ দেখতে চায় অনেকেই। হয়তো দুর্নীতি-অনিয়মের শেষ দেখার মোটেই ইচ্ছা নেই তাদের। বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়গুলি মানুষের মনে ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা জাগালেও রায়গুলির আয়ু বড়ই স্বল্প। এমনকি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ জারি হয়ে যাচ্ছে। ন্যায় বিচার বড় দুর্লভ। কলকাতা হাইকোর্টের অলিন্দে অসহায় বিচারপ্রার্থীরা সবাই জাস্টিস অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসের খোঁজ করছেন। সবাই তাঁর কাছে বিচার চান। এবার তাই বিচারদাতার বিচারকার্যেই বাধা!
জাস্টিস অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের অপরাধটা কী? তাঁর সকালে দেওয়া রায়ের উপর ডিভিশন বেঞ্চ বিকেলেই স্থগিতাদেশ দিচ্ছে দেখে তিনি অসন্তুষ্ট এবং বিষয়টি দেশের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন। বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে বিচারপতিদের মধ্যে এই ধরণের ক্ষোভের নজির আছে। কিন্তু তার জন্য একজন বিচারপতির এজলাস জোর করে পন্ড করার ঘটনা দেশের আর কোনও উচ্চ আদালতে ঘটেছে বলে মনে হয় না। আইনজীবীদের একাংশের বিক্ষোভের জেরে বুধবার শুনানিই চালাতে পারেন নি বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু এতে বিচলিত নন জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বিক্ষোভ রত আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে সবিনয়ে বলেছেন- “আপনাদের যদি মনে হয় আমি ডিভিশন বেঞ্চের বিরুদ্ধে বলে ভুল করেছি, তা হলে সুপ্রিম কোর্টে যান। এ ভাবে বিক্ষোভ কেন?” এর পরেই তাঁর চরম অঙ্গীকারটি ঘোষণা করেন ন্যায়াধীশ- “মাথায় বন্দুক ধরতে পারেন। মারতে পারেন। মরতে রাজি আছি। কিন্তু দুর্নীতি দেখলে চুপ করে থাকব না। আওয়াজ তুলবই।” হাইকোর্টের অলিন্দে যারা রাজনীতি করছে তাদের উদ্দেশ্যে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন- “দয়া করে রাজনীতি করবেন না। আমি তো কোনও রাজনীতি করছি না। শুধু একটা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হতে চেয়েছি।”
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়; বাংলার বিচারপ্রার্থীরা আপনাকে আর কতদিন পাবে আমরা কেউ জানি না। কিন্তু পাপ ও দুষ্কর্মের প্রবল স্রোতের মুখেও আপনি যেভাবে ন্যায়দন্ড হাতে একা দাঁড়িয়ে বিচারপ্রার্থীদের অভয় দিচ্ছেন তা ইতিহাসে লেখা থাকবে। প্রবল ক্ষমতাশালীদের আপনি চক্ষুশূল কিন্তু উপায়হীন অসহায় অযুত মানুষের কাছে আপনি অবলম্বন। মামলা করতে করতে শেষ সম্বলটুকুও হারায় মানুষ। তবু বিচার মেলে না। বিচারের বাণীকে নিভৃতে কাঁদতে দেখলে যে বিচারকের বিবেক কেঁদে ওঠে মানুষ তাঁকে কুর্নিশ করবে না তো করবে কাকে?
Feature image is representational. Photo credit- stock.adobe.com