রাজ্যের শাসকদলের একজন জেলা সভাপতিকে স্রেফ জেরা করার জন্য এক বছর ধরে চড়কি পাক খেতে হচ্ছে সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিকে। এরপরেও সিবিআই-এর তদন্তে আস্থা রাখতে পারবে মানুষ?
কলকাতা :পঞ্চমবারও সিবিআই-কে কলা দেখালেন কেষ্ট! বুধবার বেলা এগারোটায় নিজাম প্যালেসে সিবিআই-এর দফতরে পৌঁছানোর কথা ছিল অনুব্রতর। সকাল সোওয়া দশটা নাগাদ মাথায় লাল বাতি লাগানো কালো এক্সইউভিতে চেপে চিনার পার্কের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়েও ছিলেন অনুব্রত মন্ডল। কিন্তু সাংবাদিকদের চোখের সামনে দিয়েই নিজাম প্যালেসের রাস্তা না ধরে অনুব্রতর গাড়ি বাঁক নিল এসএসকেএম-এর দিকে। অনুব্রতর গাড়ি নিজাম প্যালেসের রাস্তা এড়িয়ে যেতেই চিত্রনাট্যের পরবর্তী ধাপ পরিস্কার হয়ে যায় সবার কাছে। যথারীতি এবারও উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে সিবিআই-এর জেরা এড়ালেন বীরভূম জেলা তৃণমূলের দাপুটে সভাপতি।
গরুপাচার মামলায় অনুব্রত মণ্ডলকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় সিবিআই। কিন্তু এক বছরেও মানুষটার নাগাল পেল না কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। প্রথম তলবের এক বছর পরে পঞ্চম তলব-সিবিআইয়ের দুঁদে গোয়েন্দাদের যেন নাকে রশি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন বোলপুরের কেষ্ট! এর আগে পর পর তিনবার কখনও অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তো কখনও ভোট প্রচারে ব্যস্ত থাকার দোহাই দিয়ে সিবিআই-এর জেরা এড়িয়েছেন অনুব্রত। চতুর্থ বার সিবিআইয়ের ডাক এলে রক্ষা কবচ চেয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন তিনি। সিঙ্গেল বেঞ্চের পর ডিভিশন বেঞ্চও আর্জি ফেরালে পঞ্চমবারের জন্য অনুব্রত মণ্ডলকে নোটিশ পাঠায় সিবিআই।
মঙ্গলবার বিকেলে অনুব্রত যখন বোলপুরের বাড়ি থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেন তখন থেকেই তাঁর উপর নজর সংবাদ মাধ্যমের । সবার একটাই প্রশ্ন- এবার কি সিবিআইকে দেখা দেবেন কেষ্ট? বুধবার দুপুর গড়ানোর আগেই নিজাম প্যালেসকে এড়িয়ে কেষ্ট এসএসকেএম-এর উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে যাওয়ার পর একটা বিষয় পরিস্কার-সিবিআইকে ধোঁকা দেওয়ার নিখুঁত পরিকল্পনা সাজানো হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। রাতেই অনুব্রতর তরফে এসএসকেএম কর্তৃপক্ষকে সমস্ত বিষয়টা খুলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে খবর। অনুব্রত বাড়ি থেকে রওনা দেওয়ার খবর পাওয়া মাত্রই ভিভিআইপি রোগীকে সামাল দেওয়ার জন্য উডবার্ন ওয়ার্ডে প্রস্তুত হয়ে যান চিকিৎসকের দল। ডিভিশন বেঞ্চে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টে না গিয়ে আইন-আদালতের মাধ্যমে সিবিআই-এর জেরা এড়ানোর রাস্তা বন্ধ অনুব্রতর। ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গেলেই যে সিবিআই-এর হাত থেকে বাঁচা যাবে- এমন গ্যারান্টি আইনজীবীদের কাছ থেকে না পাওয়ায় এখনও ও মুখো হন নি কেষ্ট। কিন্তু যার মাথায় স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হাত তিনি কি সিবিআই-এর মুখোমুখি হওয়ার কষ্ট করতে পারেন?
দিন দুয়েক আগেও আসানসোলের উপনির্বাচনে দলের প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিনহার হয়ে প্রচারে দেখা গেছে অনুব্রত মণ্ডলকে। বগটুইয়ের গণহত্যার পর মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে যথারীতি পাশে ছিলেন কেষ্ট। আনারুল গ্রেফতারের পর ডেপুটি স্পিকার আশিস ব্যানার্জির সঙ্গে চাপান-উতরের সময় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জবাবও দিয়েছেন সপাটে। পঞ্চমবার সিবিআইয়ের নোটিশ পাওয়ার পরেও কেষ্টর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক-ঠাক থাকায় অনেকরই ধারণা ছিল- এবার বোধ হয় গরু পাচারকান্ডে সিবিআইকে তদন্তে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত অনুব্রত মণ্ডল। মুখে তেমন আভাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু মাহেন্দ্রক্ষণ আসার আগেই ফের নেতিয়ে পড়লেন সেই নেতা, যাঁর দাপটে বীরভূমে মাথাই তুলতে পারে না বিরোধীরা।
বুধবার সকাল থেকেই নিজাম প্যালেসে সিবিআইয়ের অফিসারেরা সেজে গুজে বসেছিলেন অনু্ব্রতর সঙ্গে শুভ দৃষ্টি বিনিময় করবেন বলে। কেষ্টকে জেরা করার জন্য দিল্লি থেকে এসেছিলেন সংস্থার জয়েন্ট ডিরেক্টর পঙ্কজ শ্রীবাস্তবও। প্রশ্নপত্র তৈরিই ছিল। শুধু ছাত্র আসার অপেক্ষা। কিন্তু বাঘা বাঘা গোয়েন্দাদের প্রতীক্ষাই সার। এগারো পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছোঁয়ার আগেই কেষ্টর গাড়ি এসএসকেএম-এর গেট পেরিয়ে সোজা উডবার্নে। শোনা যাচ্ছে, রাতেও তবিয়ত ঠিকই ছিল। কিন্তু সকাল থেকেই বুকের বামদিকে টিপ টিপ একটা ব্যথা অনুভব করতে থাকেন অনুব্রত মণ্ডল। এরপর তো আর নিজাম প্যালেসে যাওয়া চলে না। তিনি গেলেন এসএসকেএম-এর উডবার্ন ব্লকে, যা ইতিমধ্যেই রাজ্যর মানুষের কাছে ইডি-সিবিআই ওয়ার্ড হিসেবে পরিচিত।
সিবিআই অনুব্রতকে দৌড় করাচ্ছে না অনুব্রত সিবিআইকে?
মক্কেলকে এসএসকেএম-এর নিরাপদ বলয়ে স্থানান্তরিত করে দিয়ে দুপুরের পর চিঠি হাতে অনুব্রতর আইনজীবীরা ছোটেন সিবিআই দফতরে। আইনজীবীর মাধ্যমে অনুব্রত সিবিআইকে জানিয়েছেন- ” তদন্ত সহযোগিতা করতে তাঁর আন্তরিক ইচ্ছে। কিন্তু তবিয়ত আচমকাই বিগড়ে যাওয়ায় তিনি হাসপাতালে। চাইলে হাসপাতালে এসেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে সিবিআই।” বিরোধী নেতা থেকে আম জনতা সকলেরই প্রশ্ন- সিবিআই-এর ডাক এলেই কি স্বাস্থ্যহানি হয় বীরভূমের ডাকাবুকো নেতার? কেষ্টদার সুগার-প্রেসার-পালসরেট-অক্সিজেন লেভেল-বিপি-কোলস্টেরল, সবই কি ওঠানামা করে সিবিআইয়ের ইশারায়? সিবিআই দফতর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে অনুব্রত মণ্ডলের আইনজীবী স্বীকার করে নিয়েছেন- ” সিবিআই-এর অপমান সইতে না পেরেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন মানী নেতা কেষ্টদা।”
বুধবার দুপুর সিবিআই দফতরে অনুব্রত মণ্ডলের আইনজীবীরা এক পাতার যে চিঠি জমা দিয়ে এসেছেন, তাতে অনুব্রতকে পরবর্তী জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২৮ দিন সময় চাওয়া হয়েছে। অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলা হয়েছে। দিনভর সবকিছু দেখার পর রাজনৈতিক মহলের একটাই প্রশ্ন- সিবিআই অনুব্রতকে দৌড় করাচ্ছে না অনুব্রত সিবিআইকে? রাজ্যের শাসকদলের একজন জেলা সভাপতিকে স্রেফ জেরা করার জন্য এক বছর ধরে চড়কি পাক খেতে হচ্ছে সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিকে। এরপরেও সিবিআই-এর তদন্তে আস্থা রাখতে পারবে মানুষ?
Photo Sources- Collected and archives.