১ কোটি ১৩ লক্ষ বাঙালিহিন্দু মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত। গড়ে প্রতিদিন ৬৩২জন হিন্দু বাংলাদেশ ত্যাগ করে। বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে তথ্যপূর্ণ ফিল্ম কোথায়? প্রশ্ন তুললেন তসলিমা।
ডেস্ক রিপোর্ট :শুধু দেশ নয় উপমহাদেশ জুড়েই সাড়া এবং বিতর্ক- দুটোই ফেলে দিয়েছে বিবেক অগ্নিহোত্রীর দ্য কাশ্মীর ফাইলস। দ্য কাশ্মীর ফাইলসের প্লট- উপত্যকায় কাশ্মীরি পন্ডিতদের উপর নির্যাতন এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ। হিন্দু কাশ্মীরি পন্ডিতরা কাশ্মীর উপত্যকার ভূমিপুত্র। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অত্যন্ত উন্নত উপত্যকার এই হিন্দু ব্রাহ্মণ জনগোষ্ঠী কীভাবে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে নির্যাতনের শিকার হল সেই কাহিনীই সেলুলয়েডে বন্দী করেছেন বিবেক অগ্নিহোত্রী। কাশ্মীর ফাইলস দেখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন- চেপে রাখা ইতিহাস এতদিনে সামনে এল। যদিও বামপন্থীদের অভিযোগ- বিভাজনের রাজনীতিকে চাগিয়ে তুলতেই সংঘ পরিবারের মদতে ঘটনা অতিরঞ্জিত করেছেন পরিচালক।
অথচ সত্যিই ইতিহাসকে চেপে রাখার সুযোগ নেই। ১৯৮৯-৯০ সালে কাশ্মীর উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীগুলি অভিযান শুরুর প্রথম পর্বেই নিশানা করে কাশ্মীরি পন্ডিতদের। হুমকিতে কাজ না হলে হত্যা। ঘরের মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া। হয় ধর্মান্তরিত হও নচেৎ উপত্যকা ছাড় – পন্ডিতদের কাছে এই ছিল দুটি বিকল্প। ৮৯ থেকে ৯১- তিন বছরের মধ্যে দেড় লক্ষ কাশ্মীরি পন্ডিত উপত্যকা ত্যাগ করে দিল্লিতে আশ্রয় নেয়। নিজের দেশেই বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থীর জীবন যাপনে বাধ্য হওয়া কাশ্মীরি পন্ডিতদের নির্যাতনের কথা এতদিন সামনে আসতে দেওয়া হয় নি বলে বিজেপির অভিযোগ।
দ্য কাশ্মীর ফাইলস রিলিজ হওয়া মাত্রই বক্স অফিসে সুপার হিট। ফিল্মটি রিলিজ হয়েছে ১১ মার্চ। ১৫ কোটি বাজেটের ফিল্ম প্রিমিয়ার শোতেই টাকা তুলে ফেলেছে। কাশ্মীর ফাইলস এখনও পর্যন্ত ১১৬.৪৫ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে বলে জানা যাচ্ছে। অঙ্কটা প্রতিদিন বাড়ছে। দ্য কাশ্মীর ফাইলস দেখেছেন নির্বাসিত বাংলাদেশী লেখিকা তসলিমা নাসরিনও। ফিল্মটি দেখার পর ট্যুইটারে তসলিমার প্রতিক্রিয়া- “আমি বুঝি না বাংলাদেশ থেকে বাঙালি হিন্দুদের বিতাড়ণ নিয়ে কেন এই ধরণের ফিল্ম তৈরি হচ্ছে না।” তসলিমার ট্যুইটটি ইতিমধ্যেই ভাইরাল। তসলিমা ট্যুইটে লিখেছেন- ” আজ কাশ্মীর ফাইলস দেখলাম। যদি কাহিনী ১০০ শতাংশ সত্য হয়। যদি কোনও অতিরঞ্জন এবং অর্ধসত্য না থাকে তাহলে বাস্তবিকই এটা একটা মর্মান্তিক কাহিনী। এবং উপত্যকায় ফিরে গিয়ে সেখানে বাস করার অধিকার কাশ্মীরি পন্ডিতদের অবশ্যই আছে। তার পরেই নির্বাসিত লেখিকার প্রশ্ন- “আমি বুঝি না বাংলাদেশ থেকে বাঙালি হিন্দুদের বিতাড়ণ নিয়ে কেন এই ধরণের ফিল্ম তৈরি হচ্ছে না।”
প্রতি রাতে বাংলাদেশ ছাড়ে ৬৩২ জন হিন্দু!
কাশ্মীর থেকে দেড় লক্ষ পন্ডিত বিতাড়িত হয়েছে। একটি হিসেব বলছে গড়ে প্রতিদিন ৬৩২ জন হিন্দু বাংলাদেশ ত্যাগ করছে। বছরে ২ লক্ষ ৩০ হাজার ৬১২ জন! ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ১ কোটি ১৩ লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছে। ৬৪ থেকে ৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পরেও বাঙালিহিন্দুরা ভিটেমাটি ত্যাগে বাধ্য হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর বাংলাদেশ প্রশাসনের কাছে নেই। বাংলাদেশ সরকার যে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ তার সবথেকে বড় প্রমাণ- বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে ধারাবাহিক ভাবে হিন্দুদের সংখ্যা হ্রাস। ১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ১৩.৫০ শতাংশ। ২০১১-র সেনশাসে তা নেমে দাঁড়ায় মাত্র ৮.৫৪ শতাংশে। কোভিড অতিমারির কারণে একুশে কোনও জনগণনা হয় নি। বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে হিন্দুর সংখ্যা ১০ শতাংশ দাবি করলেও বিশেষজ্ঞ মহলের মতে তা ৮.৯৬ শতাংশের বেশি নয়। ,১৯৪১-এর আদমশুমারিতে পূর্ববঙ্গে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশ। দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গে ২৯ শতাংশ হিন্দু ছিল বলে অনুমান। ১৯৬১ সালের সেনশাস অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু ছিল ১৮.৫০ শতাংশ। ধর্মাশ্রয়ী পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা মেনে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশেও যে সংখ্যালঘুর উচ্ছেদ অব্যাহত আছে তা গোপন করার সুযোগ নেই।
যে উপন্যাস লেখার কারণে বাংলাদেশে তসলিমা মৌলবাদীদের বিষনজরে পড়েন তার নাম ‘লজ্জা’। লজ্জার বিষয়বস্তু ছিল একটি হিন্দু পরিবারের উপর নির্যাতন এবং পরিবারটির দেশত্যাগ। এক পর্যায়ে প্রাণভয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন তসলিমা। বাংলাদেশ সরকার লজ্জা নিষিদ্ধ করে দেয়। সুইডেনের নাগরিকত্ব পেলেও ভারতে থাকতে ভালবাসেন তসলিমা নাসরিন। আসলে এই বাঙালি লেখিকা পশ্চিমবঙ্গে থাকতে চান। বাংলাদেশ ত্যাগের পর পশ্চিমবঙ্গকেই নিজের মাতৃভূমি মনে করে কলকাতায় তসলিমা বাসও করেছিলেন বেশ কয়েক বছর। কিন্তু কলকাতার মৌলবাদী গোষ্ঠী তসলিমার বিরুদ্ধে পথে নামলে ২০০৯ সালে তাঁকে কলকাতা ত্যাগে বাধ্য করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দীর্ঘ মেয়াদী ভিসায় বছরের একটা বড় সময় এখন দিল্লিতেই কাটান তসলিমা।
Feature Image is representational. Photo Sources- File and Facebook.