অদূর ভবিষ্যতে বগটুই হত্যাকান্ড মামলায়ও সিবিআই অনুব্রত মণ্ডলকে ডাকাডাকি শুরু করতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
কলকাতা :পাঁকাল মাছের মতোই বহুবার সিবিআইয়ের হাত থেকে ফস্কে গিয়েছেন তিনি। কখনও অসুস্থতার কথা বলে, কখনও ভোট প্রচারে ব্যস্ত থাকার অজুহাতে কখনও বা আদালতকে ঢাল করে সিবিআইয়ের দফতরে হাজিরা এড়িয়েছেন তিনি। নির্বাচন পরবর্তী হিংসা থেকে গরু পাচার মামলা- তাঁকে নোটিশ পাঠাতে পাঠাতে ক্লান্ত কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দুঁদে আধিকারিকেরাও। তিনি অনুব্রত মণ্ডল। বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি। জেলায় জেলায় তৃণমূলের সভাপতি অনেকেই আছেন। কিন্তু অনুব্রত একজনই। কেষ্ট নামে বীরভূম কাঁপান তিনি । পদ জেলা স্তরের হলেও গোটা বাংলা কেষ্টদাকে এক ডাকে চেনে। গরম গরম সংলাপের জন্য অনুব্রতকে রীতিমতো সেলিব্রেটি বানিয়ে ছেড়েছে এই রাজ্যের মিডিয়া। বোলপুরের অনুব্রতও নিজেকে সেলিব্রেটি ভাবতেই অভ্যস্ত। যদিও দিন কারও সমান যায় না। বোলপুর বাজারের মাছ বিক্রেতা থেকে বীরভূম জেলার দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে ওঠা কেষ্টর সময়টা ইদানিং খুব একটা ভাল যাচ্ছে না।
মঙ্গলবার সকালে আদালত খুলতেই কেষ্ট মন্ডলের জন্য দুঃসংবাদ- সিবিআইয়ের জেরার হাত থেকে বাঁচতে চেয়ে তাঁর দায়ের করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। আদালতের নির্দেশেই গরু পাচার মামলার তদন্ত করছে সিবিআই। তদন্তের স্বার্থে অনুব্রত মণ্ডলকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। গরু পাচারচক্রের মূল পান্ডা এনামুল হক এখন সিবিআইয়ের হেফাজতে। এনামুলকে জেরা করেই অনুব্রতের নাম জানতে পেরেছেন সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা। কিন্তু কেষ্ট সিবিআই-কে দেখা দিতে নারাজ।
গরু পাচারকান্ডের তদন্তে জিজ্ঞাসাবাদ করতে অনুব্রতকে চারবার তলব করেছে সিবিআই। চারবারই সিবিআইয়ের ডাক এড়িয়ে গেছেন অনুব্রত। রোগ আর ভোটের নাম করে ডাক এড়িয়েছেন তিন বার। যখন চার নম্বর বার সিবিআই ডাকল তখন কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চে ‘রক্ষাকবচ’ চেয়ে আবেদন করলেন কেষ্ট। যার দাপটে বীরভূমে বিরোধীরা মাথা তুলতে পর্যন্ত ভয় পায় সেই অনুব্রত মণ্ডলের ভয়- জেরার জন্য নিজাম প্যালেসে হাজির হলেই যদি তাঁকে ধরে গারদে পুড়ে দেয় সিবিআই। সে’বার অনুব্রতের মামলা খারিজ করে দেয় বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার সিঙ্গেল বেঞ্চ। এরপর একই আর্জি নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হন অনুব্রত। দিন কয়েক আগেই মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার ছিল রায়। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব ও বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চও অনুব্রত মণ্ডলকে তাঁর কাঙ্ক্ষিত ‘রক্ষাকবচ’ দিতে অস্বীকার করে। ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছে- সিঙ্গেল বেঞ্চ যে রায় দিয়েছে তাই বহাল থাকবে। অর্থাৎ সিবিআই ডাকলে কোনও রকম শর্ত ছাড়াই হাজিরা দিতে হবে বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতিকে।
এর আগে ভোট পরবর্তী হিংসা মামলায় ইলমবাজারে এক বিজেপি কর্মীর খুনের ঘটনায় সিবিআই অনুব্রত মণ্ডলকে তলব করতেই অনুব্রত বোলপুর থেকে কলকাতায় এসে এসএসকেএম-এর উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে যান। হাইকোর্টে মামলা ঠুকে হাজিরা থেকে রেহাই পাওয়া মাত্রই সুস্থ হয়ে উডবার্ন ওয়ার্ড ছেড়ে ঘরে ফিরে যান কেষ্টদা। এরপর গরু পাচার মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিবিআই অনুব্রতকে নিজাম প্যালেসে হাজির হওয়ার নোটিশ দিতেই অনুব্রত তড়িঘড়ি বোলপুরের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান। এমনিতে সারা বছর বেশ সুস্থই অনুব্রত। দলের সংগঠনের কাজে বীরভূম জেলা তো বটেই বীরভূমের বাইরেও চষে বেড়ান। ভোট এলে কেষ্টর দায়িত্ব বাড়ে বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েত-পুরসভা, লোকসভা-বিধানসভা দলনেত্রীকে উপহার দেওয়ার তাগিদে। বক্তৃতার মঞ্চ থেকে সাংবাদিক সম্মেলন- সবেতেই কেষ্ট সাবলীল। রাজনৈতিক বিরোধীদের ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না। মাথায় মুখ্যমন্ত্রীর হাত। জেলায় তিনি সর্বেসর্বা। জেলাশাসক পর্যন্ত ঘরে এসে অনুব্রতকে তোয়াজ করে যায়। ভোটের সময় কীভাবে বিরোধীদের গুড়-জল-বাতাসা আর নকুল দানা খাইয়ে ঠান্ডা রাখতে হবে এই কৌশল অনুব্রত মণ্ডলের ভালই জানা। এহেন দাপুটে অনুব্রত সিবিআইয়ের নাম শুনলেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনুব্রতের বিপি-সুগার-কোলস্টেরল এমনকি অক্সিজেনের লেভেলও কি সিবিআই নিয়ন্ত্রণ করে?
ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের পর পঞ্চমবারের জন্য অনুব্রত মণ্ডলকে ডাকতে সিবিআইয়ের বাধা রইল না। ডাকলে অনুব্রত কী করবেন? সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া ভিন্ন আইনি পথে সিবিআইকে এড়ানোর আর কোনও রাস্তা খোলা নেই অনুব্রত মণ্ডলের সামনে। নিজাম প্যালেসে দর্শন দেওয়ার আগে আগাম জামিনের জন্য একবার আদালতের দ্বারস্থও হতে পারেন। রামপুরহাটের গণহত্যা মামলা ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে সিবিআইয়ের হাতে যাওয়ায় এমনিতেই কেষ্টর টেনশনের শেষ নেই। বগটুইকান্ডের শেকড় খুঁজতে নাকি গরু, বালি এবং পাথর পাচার নিয়েও নাকি খোঁজখবর শুরু করেছেন সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা। বিরোধীদের দাবি- অনুব্রত মণ্ডলের কল লিস্ট ছানবিন করলেই অনেক তথ্য জানা যাবে। শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগের তীর তো সরাসরি অনুব্রতের দিকে। ভাদু শেখের খুনের পর পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার পেছনে বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতির মদত আছে বলে শুভেন্দুর অভিযোগ। নৃশংস হত্যাকান্ড সব হারিয়েছেন বগটুই গ্রামের বাসিন্দা শেখলাল শেখ। শেখলালের অভিযোগ- “নিহত উপপ্রধান ভাদু শেখ ছিল ক্রিমিনাল। তার তোলাবাজির টাকার ভাগ অনুব্রত মণ্ডলও পেতো।” অদূর ভবিষ্যতে বগটুই হত্যাকান্ড মামলায়ও সিবিআই অনুব্রত মণ্ডলকে ডাকাডাকি করতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
Feature photo is representational. Photo source-File.