বগটুই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কলকাতায় বড় মিছিল বিজেপির, আক্রমণাত্মক মেজাজে শুভেন্দু-সুকান্ত - nagariknewz.com

বগটুই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কলকাতায় বড় মিছিল বিজেপির, আক্রমণাত্মক মেজাজে শুভেন্দু-সুকান্ত


বিধানসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর থেকেই একের পর এক ধাক্কায় রাজ্য বিজেপির মনোবল তলানিতে ঠেকেছিল। সম্প্রতি ইউপি সহ চার রাজ্যের ভোটে দলের সাফল্য বঙ্গ বিজেপিকে উদ্দীপ্ত করে। এরপর রামপুরহাট কান্ডে তৃণমূল বেকায়দায় পড়তেই বিজেপি যেন দুর্বলতা ‌ঝেড়ে ফেলে সরকারের বিরুদ্ধে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে চাইছে। সোমবার বিধানসভার ভেতরে-বাইরে পদ্ম শিবিরের সক্রিয়তা সেই ইঙ্গিত‌ই দিল বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।

ডেস্ক রিপোর্ট :বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্য বিজেপির সবথেকে বড় কর্মসূচি দেখল কলকাতা। সোমবার বিকেলে রামপুরহাটের বগটুইয়ে পুড়িয়ে গণহত্যার প্রতিবাদে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে রাণী রাসমণি রোড পর্যন্ত বিরাট মিছিল করল বিজেপি। প্রত্যাশা জাগিয়েও বিধানসভা ভোটে বিপর্যয়ের পর থেকে কলকাতায় তেমন কোনও চোখে পড়ার মতো‌ কর্মসূচি নিতে পারে নি বিজেপি। এদিনের মিছিলে ভিড় কিন্তু ছিল চোখে পড়ার মতোই।

বগটুই গণহত্যার প্রতিবাদে কলকাতায় বিজেপির মিছিল।

ঘটনাচক্রে সোমবার সকাল থেকেই সংবাদ শিরোনামে বিজেপি। বিধানসভার ভেতরে বগটুইকান্ড নিয়ে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে বক্তব্য পেশ করার অনুমতি দেন নি অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পর বিজেপির বিধায়কেরা ওয়েলে নেমে এসে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলে বিধানসভার ভেতরে নজিরবিহীন গোলমালের সূত্রপাত। অধিবেশন কক্ষে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন তৃণমূল ও বিজেপির বিধায়কেরা। এতে দুই পক্ষের বেশ কয়েকজন আঘাত পান। চুঁচুড়ার তৃণমূল বিধায়ক অসিত মালের নাকে আঘাত লাগে। অসিতের চিকিৎসা চলছে এস‌এসকে‌এম-এর উডবার্ন ওয়ার্ডে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মেরে তাঁর নাক ফাটিয়ে দিয়েছে বলে অসিতের অভিযোগ। যদিও যদিও অসিত মালের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন শুভেন্দু। বিরোধী দলনেতার পাল্টা বিস্ফোরক অভিযোগ- পরিকল্পনা করে কলকাতা পুলিশের কর্মীদের সাদা পোশাকে অধিবেশন কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়ে বিজেপির বিধায়কদের পেটানো হয়েছে। পরে তৃণমূলের বিধায়কেরাও তাদের উপর হাত চালান।” বিরোধী দলের মুখ্য সচেতক মনোজ টিগ্গাকে ঘুসি মারা হয় বলে অভিযোগ। তাদের মহিলা বিধায়কদের গায়েও পুরুষ নিরাপত্তারক্ষীরা হাত দেয় বলে‌ শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ।

চোট‌আঘাত পাওয়া বিজেপির বাকি বিধায়কদের প্রাথমিক চিকিৎসার পর অ্যাপেলো হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হলেও মনোজ টিগ্গাকে কল্যাণী এইমসে স্থানান্তর করা হয়েছে। মঙ্গলবার তাঁকে চিকিৎসার জন্য দিল্লি এইমসে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। এদিকে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম শুভেন্দু অধিকারী এবং মনোজ টিগ্গা সহ পাঁচ বিজেপি বিধায়ককে সাসপেন্ড করার প্রস্তাব আনলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, দিনহাটার তৃণমূল বিধায়ক উদয়ন গুহ সহ ট্রেজারি বেঞ্চের কয়েকজন বিধায়ক প্রস্তাব সমর্থন করেন। তৃণমূলের প্রস্তাব মেনে বিজেপির পাঁচ বিধায়ককে গোটা অধিবেশনের জন্য সাসপেন্ড করেন অধ্যক্ষ। বিজেপির বাকি সাসপেন্ডেড বিধায়কেরা হলেন শিলিগুড়ির বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ, ফালাকাটার বিধায়ক দীপক বর্মণ এবং পুরুলিয়ার বিধায়ক নরহরি মাহাতো।

দিনভর প্রচারের আলো টেনে নিল বিজেপি

রামপুরহাটকান্ডের প্রতিবাদে সোমবার বিধানসভার বাইরে বিজেপির পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি ছিল‌ই। কিন্তু বিধানসভার‌ ভেতরেও বগটুই হত্যাকান্ড নিয়ে বিজেপি বিধায়কদের ঝাঁঝালো প্রতিবাদ সামাল দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না শাসক শিবির। এদিকে বিধানসভায় গোলমাল ও বিরোধী দলনেতা সহ দলের পাঁচ বিধায়ক সাসপেন্ড হ‌ওয়ার পর থেকেই চ্যানেলে চ্যানেলে প্রচারের বেশিরভাগটাই টেনে নেয় বিজেপি। দার্জিলিঙে মুখ্যমন্ত্রীর কর্মসূচি ও বামেদের বনধের খবরকেও ঢেকে দেয় বিধানসভার ঘটনা।

বিধানসভা থেকে বেরিয়েই সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে দলের মিছিলে যোগ দিতে যান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। মিছিলে ছিলেন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, প্রাক্তন সভাপতি রাহুল সিনহা সহ রাজ্য বিজেপির প্রায় সকল শীর্ষ নেতাই। কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকা তো বটেই মিছিলে যোগ দিতে দুরের জেলা থেকেও বিজেপির বহু কর্মীসমর্থক এসেছিলেন। মিছিল ‌শেষে রাণী রাসমণি রোডে সংক্ষিপ্ত সভায় ভাষণ‌ও দেন শুভেন্দু অধিকারী ‌ও সুকান্ত মজুমদার। মঞ্চ থেকে তীব্র ভাষায় তৃণমূল সুপ্রিমো ও তাঁর সরকারকে আক্রমণ করেন বিরোধী দলনেতা। তৃণমূল সরকার গোটা রাজ্যে গুন্ডারাজ কায়েম করেছে বলে অভিযোগ করেন শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দু বলেন, ” এই এগার মাস ধরে পশ্চিমবাংলায় তৃতীয় বারের জন্য যে সরকার তৈরি হয়েছে, সেই সরকার গোটা রাজ্যটাকে গুন্ডাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে।” নির্বাচন পরবর্তী তৃণমূলের সন্ত্রাসে দলের প্রার্থী সহ বিজেপির ৫৬ জন কর্মী-সমর্থক খুন হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।‌ শুভেন্দু অধিকারী বলেন, “২৫ হাজার বিজেপি নেতা-কর্মী-সমর্থকের বাড়িঘর-দোকন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ১২ হাজার এফ‌আইআর হয়েছে সারা রাজ্যে।” শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ- ” স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশরা যে অত্যাচার করে নি, মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে গুন্ডারা, যারা পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশ-টু বানাতে চায়। যারা পশ্চিমবঙ্গকে কার্যত ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় সেই লোকেরা গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করেছে।”

রাণী রাসমণি রোডে বিজেপির সভায় ভাষণ দিচ্ছেন শুভেন্দু অধিকারী।

সভায় রামপুরহাট কান্ড নিয়ে রীতিমতো বিস্ফোরক অভিযোগ- করেন শুভেন্দু। বিরোধী দলনেতা বলেন,” আপনারা দেখেছেন রামপুরহাটের ঘটনা। ভাদু শেখ খুন হল। তারপরে রামপুরহাটে অনুব্রত মন্ডলের নির্দেশে‌, মমতা ব্যানার্জির চক্রান্তে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রেখে দেড় ঘণ্টা ধরে নারীদের, শিশুদের ‌জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।” বিজেপির বিধায়কদল বুধবার বগটুই গ্রামের গণহত্যাস্থল পরিদর্শনে যাওয়ার পথে শক্তিগড়ে খেতে নামায় মুখ্যমন্ত্রী কটাক্ষ করে বলেছিলেন, বিজেপির লোকেরা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ল্যাংচা খেতে গিয়েছে। সোমবার রাসমণি রোড থেকে মমতার কটাক্ষের পাল্টা জবাব দিলেন শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দু বলেন, ” আরে আমরা ল্যাংচাই নি। ভোটের সময় ভালো‌ পায়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে আপনিই লেংচে লেংচে গোটা রাজ্য ঘুরে বেড়িয়েছেন।”

আক্রমণাত্মক মেজাজে শুভেন্দু

নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গ তুলেও এদিন ফের মুখ্যমন্ত্রীকে খোঁচা দেন বিরোধী দলনেতা। শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ” নন্দীগ্রামের লোক আপনার টুপি পরেন নি। ১৯৫৬ ভোটে ‌আপনি হেরেছেন।” মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের সংখ্যালঘুদের টুপি পরিয়েছেন বলে কটাক্ষ করেন শুভেন্দু। শুভেন্দু বলেন,” আপনি টুপি পরিয়েছেন কাকে? সংখ্যালঘু মুসলমানদের টুপি পরিয়েছেন। আনিস খানকে খুন করেছে কে? মমতা ব্যানার্জির পুলিশ, আবার কে। রামপুরহাটে নয়জন মহিলা। দুইজন শিশু। ১১ জন‌ই কিন্তু সংখ্যালঘু মুসলমান। মারল কে? তৃণমূল। মেরেছে কাকে? তৃণমূলকে। জেলে কে? তৃণমূল। ক্ষতিপূরণ কে পাচ্ছে? তৃণমূল।” এরপরেই শুভেন্দু অধিকারী রাজ্যের সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্যে বলেন- ” আজকে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুরা একটু ভাবুন। কাদেরকে দল বেঁধে ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন।”

রামপুরহাটের সংখ্যালঘু পরিবারের নিহত নারী ও শিশুদের জন্য বলতে গিয়ে তিনি সহ বিজেপির পাঁচ বিধায়ক নজিরবিহীনভাবে এক বছরের জন্য বিধানসভা থেকে সাসপেন্ড হয়েছেন বলে সভায় দাবি করেন শুভেন্দু অধিকারী। বিরোধী দলনেতা বলেন,” যারা আমাদের ভোট দিয়ে জিতিয়ে বিধানসভায় পাঠিয়েছেন, তাদের জন্য নয়। যারা আমাদের ভোট দেয় না। যারা ভোটের সময় সুকান্ত মজুমদার, দিলীপ ঘোষদের তাদের মহল্লায় ঢুকতে দেয় নি তাদের পক্ষ নিয়ে বলতে গিয়ে, তাদের জন্য লড়তে গিয়ে আমরা এক বছরের জন্য সাসপেন্ড হলাম।” পাঁচ বিরোধী বিধায়কের সাসপেন্ড হ‌ওয়ার কারণ‌ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শুভেন্দু বলেন- ” সাসপেন্ড কারা হয়েছেন? যে সম্প্রদায়গুলি বিজেপির ভোটার। তৃণমূলকে ভোট দেয় না। তাদের বিধায়কদেরকেই সাসপেন্ড করা হয়েছে। আমি শুভেন্দু অধিকারী উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ। উচ্চবর্ণের হিন্দু তৃণমূলকে ভোট দেয় না। তাই সাসপেন্ড। মনোজ টিগ্গা আদিবাসী। আদিবাসীরা তৃণমূলকে ভোট দেয় না। তাই সাসপেন্ড। দীপক বর্মণ রাজবংশী। রাজবংশীরা তৃণমূলকে ভোট দেয় না। তাই সাসপেন্ড। পুরুলিয়ার কুর্মীরা তৃণমূলকে ভোট দেয় না। তাই নরহরি মাহাতো সাসপেন্ড। ওবিসি হিন্দুরাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দেন না। তাই শঙ্কর ঘোষ সাসপেন্ড। “

ফের তেড়েফুঁড়ে নামল বঙ্গ বিজেপি?

রামপুরহাট কান্ডে সংখ্যালঘুদের হত্যার বিরুদ্ধে রাজ্যের গন্ডি ছাড়িয়ে দেশজুড়ে বিজেপির প্রতিবাদ। এবং রাজ্য বিধানসভায় সেই ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে‌ বিজেপির বিধায়কদের সাসপেন্ড হ‌ওয়া- সোমবার প্রত্যেকটি ইস্যুকেই সুকৌশলে এমনভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন শুভেন্দু, যাতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষোভ আরও তীব্র হ‌ওয়ার সুযোগ পায়।

বিধানসভা ভোটে হারার পর থেকেই উপর্যুপরি নির্বাচনে ভরাডুবি এবং দলভাঙার ধাক্কায় রাজ্য বিজেপির আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছিল। রাজনৈতিক মহল বলছে, উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যে বিজেপির জয়ের পর থেকেই বঙ্গ বিজেপিতে ফের অক্সিজেনের সঞ্চার। আর রামপুরহাট কান্ডে তৃণমূল কোনঠাসা হতেই ঝিমুনি কাটিয়ে বঙ্গ বিজেপি যে বেশ তরতাজা হয়ে উঠেছে সোমবারের মিছিল ও নেতাদের আক্রমণাত্মক মেজাজ‌ই তার প্রমাণ। বালিগঞ্জ বিধানসভা ও আসানসোল লোকসভার উপনির্বাচনে এর ফলে বিজেপি বাড়তি মনোবল পাবে বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ভিডিওতে দেখুন-

Photo Credit- BJP WB official FB page.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *