সঙ্কটের মুহুর্তে প্রশাসনের প্রধানের মুখে রাজনৈতিক ভাষণবাজি বেমানান এবং তা সুশাসনের অন্তরায়- এটা যত দ্রুত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পারেন ততই তাঁর সরকারের জন্য মঙ্গল।
ডেস্ক প্রতিবেদন :মঙ্গলবার সকালে বগটুইয়ের ঘটনা চাউর হতেই অনুব্রত মণ্ডল বলে দেন-শর্টসার্কিটের ফলে টিভি ব্লাস্ট করে অগ্নিকান্ড থেকে মৃত্যু। যখন আর চাপা দেওয়ার উপায় নেই, তখন রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালব্য বললেন, আগুন লাগানো হয়েছে ঠিকই কিন্তু এর সঙ্গে কোনও রাজনীতির যোগ নেই। একটু বেলা বাড়লে গোটা রাজ্যের মানুষের কাছেই যখন পুরো ব্যাপারটা পরিস্কার, তখন প্রথমে মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পরে তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষ আওয়াজ তুলে দিলেন- শান্ত বাংলাকে অশান্ত করতে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র। পেছন থেকে পার্থ-কুণালের গলায় এই সুরটি ধরিয়ে দিয়েছেন কে তা অনুমান করতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছিল না রাজনৈতিক মহলের। বুধবার আর দলের অন্যদের মুখ দিয়ে নয় স্বয়ং স্বমুখেই ষড়যন্ত্রের ধুয়ো তুললেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
সোমবাররাত আটটা নাগাদ বগটুই গ্রামে প্রথমে তৃণমূলের উপপ্রধান ভাদু শেখ বোমা হামলায় নিহত হন। ভাদু বগটুইয়ের পূর্বপাড়ায় বাস করতেন। এর দেড়ঘণ্টা বাদে ভাদুর অনুগামীরা পশ্চিমপাড়ায় হামলা চালানো শুরু করে। নিহত ভাদু শেখের পরিবার কিম্বা পশ্চিমপাড়ায় হামলার ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সদস্য- কারও মুখেই অবশ্য বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নেই। একুশের জানুয়ারিতে ভাদুর ভাই বাবরও খুন হয়। ভাদুর স্ত্রী কেবিলা বিবির অভিযোগ, ভাশুরের খুনিরাই স্বামীকে খুন করেছে। স্বামীর খুনিরাও তৃণমূল করে বলে কেবিলা বিবি জানিয়েছেন। বগটুইয়ের পশ্চিমপাড়ায় ঘরে আগুন লাগিয়ে গ্রামবাসীদের পুড়িয়ে মারার ঘটনায় মৃতদেহ পরিবারের সদস্যদের অভিযোগের তীর তৃণমূলের ব্লক সভাপতি আনারুল হোসেনের বিরুদ্ধে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানতে নারাজ- তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই উপপ্রধান খুন ও তার জেরে গণহত্যা হয়েছে।
কী বলছেনমমতা? বুধবার কলকাতার নেতাজি ইন্ডোরে এক সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন,“আমরা সরকারে। আমরা কি চাইব কোথাও কেউ বোমা মারুক। বদনামের চেষ্টা করা হচ্ছে। যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তারা কেউ ছাড় পাবে না। ” অর্থাৎ মমতা বোঝাতে চাইছেন তাঁর সরকারকে বদনাম করতেই খুন-গণহত্যা ঘটানো হয়েছে। পরের লাইনে কারা চক্রান্ত করতে পারে তার একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন ঠিক এইভাবে-“আমরা সিপিএম-কংগ্রেসের মতো চক্রান্তকারী দল নই।” মমতা কি বলতে চাইছেন সিপিএম আর কংগ্রেস হাত মিলিয়ে বগটুইয়ে গণহত্যা করেছে? এরপরেই মমতা বলেন,“আসলে দাঙ্গা করতে পারছে না। লোকে খেতে পারছে না, তাও বলতে পারছে না। মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারছে না, একথাও বলতে পারছে না। মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না, এ কথা বলতে পারছে না। তাই দেশলাই জ্বালানো খুব সহজ, তাই না। দেশলাই জ্বালাতে চক্রান্তকারীদের জুড়ি নেই। “ বগটুইয়ে আগুন তাহলে জ্বালালো কারা? সবশেষে মমতা খোলসা করলেন এই ভাষায়- “কালকেও দেখেছেন গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। পেট্রোলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এটা নিয়ে যাতে কেউ বলতে না পারে, তাই হট করে এমন এমন একটা ঘটনা ঘটিয়ে দিচ্ছে। “ এতক্ষণে পাবলিক বুঝলো বগটুই গণহত্যার দায় ঠিক কাদের ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন মুখ্যমন্ত্রী। অর্থাৎ পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতেই বিজেপি বগটুইয়ে গণহত্যা ঘটিয়েছে- এমনটাই জানান দিতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতাবন্দ্যোপাধ্যায় শুধু তৃণমূলের সুপ্রিমোই নন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও। রাজনৈতিক মহল বলেছে, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে তাঁর কি দায়িত্ব নয় এই ধরণের সংবেদনশীল বিষয়ে কোনও দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার আগে প্রাথমিক প্রমাণ মানুষের সামনে রাখা? বিরোধী দলের কেউ উপপ্রধান খুন বা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত থাকলে তা তদন্ত করে সামনে আনার দায়িত্ব তো সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের। অনেকেই মনে করেন, কোন মমতা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আর কোন মমতা তৃণমূলের কান্ডারী- চাপে পড়লেই তা গুলিয়ে ফেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্কটের মুহুর্তে প্রশাসনের প্রধানের মুখে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক ভাষণ বেমানান এবং তা সুশাসনের অন্তরায়- এটা যত দ্রুত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পারেন ততই তাঁর সরকারের জন্য মঙ্গল।
Photo- Collected.