বিশেষ প্রতিবেদন : রবিবার কলকাতা পুরসভার ১৪৪টি ওয়ার্ডে ভোট। রাজ্যে ১১৪টি পুরসভার মেয়াদ বহু আগেই পেরিয়ে গেলেও পুরভোট হচ্ছে কেবল কলকাতায় । বিজেপি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট দাবি করলেও সেই দাবি কানে তুলে নি নির্বাচন কমিশন। প্রথমে সব পুরসভায় একসাথে ভোট ও পরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবিতে ভোট চেয়ে রাজ্য বিজেপি আদালতে গেলেও শেষতক কোনওটাতেই সুরাহা পায় নি। কলকাতার পুরভোট হচ্ছে কলকাতা ও রাজ্য পুলিশের নিয়ন্ত্রণেই । পশ্চিমবঙ্গে ভোট মানেই অশান্তি, মারামারি আর রক্তারক্তি – এমন একটা ধারণা মানুষের মনে গেঁথে গেছে। বাংলায় বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের পর্যন্ত কালঘাম ছুটে যায়। আর রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোট এলেই আঠারোর পঞ্চায়েত নির্বাচনের কথা সকলের মনে পড়ে যায়। ২০১৫ তে পুরভোট করতে গিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এমন নাকাল অবস্থা হয়েছিল যে শেষে নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় মাঝপথে পদত্যাগ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।
মানুষ শান্তিতে নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে চান । নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব তা নিশ্চিত করা। রাজ্য নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচন কমিশনের তুলনায় যথেষ্ট দুর্বল , রাজ্য নির্বাচন কমিশন অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট করাতে অক্ষম – এই রকম একটি ধারণা পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়ে গেছে। আঠারোর পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকে এই ধারণাটা আরও দৃঢ় হয়েছে। আবার রাজ্য পুলিশের পাহারায় নিরপেক্ষ ভোট হয় না, ভোট শান্তিপূর্ণ করতে হলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের দরকার – এই রকম একটি ধারণাও পশ্চিমবঙ্গবাসীর মনে চেপে বসেছে। পঞ্চায়েত ভোটের সময় পুলিশের চোখের সামনেই এমন সব ঘটনা ঘটেছে যে এই আস্থাহীনতার জন্য মানুষকে দোষারোপ করার উপায় নেই।
রবিবার কলকাতার পুরভোট রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও রাজ্যের পুলিশ – উভয়ের কাছেই কলঙ্ক মোচনের একটা বড় সুযোগ। দেশের বহু রাজ্যেই এখন সিভিক ভোট তো বটেই এমনকি লোকসভা-বিধানসভা নির্বাচনও সেই রাজ্য পুলিশের নিয়ন্ত্রণে বিনা রক্তপাতে অনুষ্ঠিত হয় । অন্যান্য রাজ্যেও নিয়মিত পুরসভা ও পঞ্চায়েত নির্বাচন হয় । এখন আর কোনও জায়গা থেকেই মারামারির খবর পাওয়া যায় না। ব্যতিক্রম বাঙালির দুই রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা। সোমবার কলকাতায় রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও কলকাতা আর রাজ্য পুলিশ দেখিয়ে দিক তাদের অধীনেও অবাধ , সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব।
শুধু নিরাপত্তার কড়াকড়ির উপরেই যদি ভোটের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তবে বলতে হবে গণতন্ত্রের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলির দায়বদ্ধতার অভাব আছে। দলগুলি ভোটে গায়ের জোর দেখাতে চায় বলেই তা থামাতে কঠোর নিরাপত্তা বলবৎ করতে হয় নির্বাচন কমিশনকে। গত পঞ্চায়েত ভোটে শাসকদল এতটাই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল যে সেই কথা মনে পড়লে এখন শাসকদলের নেতারা লজ্জায় জিভ কাটেন । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি তৃণমূলের অন্দরে বলে দিয়েছেন, এবারের ভোটে কোনও গোলমাল বরদাস্ত করা হবে না। দলের কেউ অশান্তি পাকালে নিজের রিস্কে পাকাবে, দল দায়িত্ব নেবে না। অর্থাৎ পুরভোটে গোলমাল চাইছে না শাসক তৃণমূল। শাসক দলের শুভ বুদ্ধির উদয় হলে খুব ভাল হয় । এবং এটাই প্রত্যাশিত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেরিতে হলেও হয়তো বুঝেছেন, জোর জবরদস্তি করে পঞ্চায়েতে কটা আসন বেশি পাওয়ার পরিণাম আখেরে ভাল হয় নি। দেশে বাংলার বদনাম ছড়িয়েছে। আর মানুষ ঘটনাগুলো মনে রাখে । ঊনিশের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের খারাপ ফলের পেছনে আঠারোর পঞ্চায়েত ভোট যে একটা কারণ তা ভোটের পর ঠাহর করতে পেরেছেন মমতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এখন জাতীয় স্তরে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোই টার্গেট । তাই কলকাতা পুরসভার ভোটে তাঁর দলের কর্মী-সমর্থকদের এমন কিছু তিনি করতে দেবেন না , যার ফলে সর্বভারতীয় স্তরে তৃণমূলের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয় ।
কলকাতা কর্পোরেশনের ভোটে আরও একটি কারণে বড় ধরণের কোনও গন্ডগোল হবে না বলে রাজনৈতিক মহল আশাবাদী। সেটা হল নগর কলকাতার রাজনীতিতে তৃণমূলের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত । কলকাতায় রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল বিজেপির সংগঠন ও জনভিত্তি বরাবরই দুর্বল। বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পর অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। কলকাতা পুরসভার ভোট যদি বিশের এপ্রিল মে মাসে হত তবে বিজেপি তৃণমূলকে যেই টক্করটা দেওয়ার জায়গায় ছিল এখন তার ধারেকাছেও নেই । একসময় কলকাতায় ভোটের দিন যেই বামেরা অলিগলিতে দাপাতো আজ ইতিউতি তাদের পোস্টার-ফ্লেক্স চোখে পড়ছে মাত্র। এই পরিস্থিতিতে জয় যখন প্রায় হাতের মুঠোয় তখন খামোখা আর কেন রণদেহী মেজাজে মাঠে নামতে যাবে তৃণমূলের প্লেয়াররা । রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হোক কলকাতার শান্তিপ্রিয় জনগনের প্রত্যাশা একটাই – রবিবার অশান্তি ও রক্তপাত ছাড়াই তারাই নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন।
Feature Image- Symbolic ( Credit-PTI ).