৭২ শতাংশ কলকাতাবাসী যখন ৯৩ শতাংশ আসন একটি দলকেই দান করার পক্ষে তখন কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভোট করার দরকারটা কী?লিখলেন উত্তম দেব-
পেশীশক্তি খাটিয়ে কলকাতার পুরভোটকে প্রভাবিত অবশ্যই করেছে শাসক তৃণমূল। কিন্তু নিছক পেশীশক্তি আর দলদাস প্রশাসনের প্রভাবেই এমন বিধ্বংসী ফল হাসিল করে নি শাসকদল। ভোটদান নির্ভেজাল হলে বড়জোর আরও কুড়ি-বাইশটা ওয়ার্ড হয়তো খোয়াতো জোড়াফুল। গণতন্ত্রে ক্ষমতা লাভের জন্য নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে বলা হয়ে থাকে ব্রুট মেজোরিটি। পরিষদীয় গণতন্ত্রে ব্রুট মেজোরিটি হল শাঁখের করাতের মতো। ব্রুট মেজোরিটি যেমন সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারকে অহেতুক প্রতিবন্ধকতা ও বিলম্বের হাত থেকে রক্ষা করে তেমনি অহঙ্কার-ঔদ্ধত্যে বেপরোয়াও করে তোলে শাসককে। সিঙ্গুর আন্দোলন পর্বে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একবার বলে ফেলেছিলেন আমরা দুশো তিরিশ ওরা তিরিশ। এরপর হুগলি নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ব্রুট মেজোরিটির দৌলতে দিনের পর দিন যাবতীয় পরিষদীয় রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েও কীভাবে দিব্যি পার পাওয়া যায় তা দেখিয়ে দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদল। দেখিয়ে পারও পেয়ে যাচ্ছে। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যবাসী এই অরাজকতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন।
বাংলার শাসকদল এখন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাতেও তুষ্ট নয়। কলকাতা পুরসভার ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৯৬টিতে জিতলেই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হয়ে যায়। এই মুহুর্তে কলকাতার রাজনৈতিক এবং সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং তৃণমূলের এতটাই অনুকূলে যে ভোটে বিন্দুমাত্র কারচুপি না করেও এরা ১১০টা ওয়ার্ড জিতে নিতে পারত। কিন্তু ৩৪টা বিরোধীদের দখলে গেলেও নেত্রীর অহং আহত হয়। তাই কলকাতার ৯৩ শতাংশ ওয়ার্ড তৃণমূলের দখলে! ভোট গণনা শেষ হওয়ার পর দেখা গেল ৭২ শতাংশ ভোট একা তৃণমূলের! মুখ্যমন্ত্রী বলছেন উৎসবের মেজাজে ভোট হয়েছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই ১৯ ডিসেম্বর কলকাতার পুরভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে , তবে আমি বলব কলকাতায় ভোটের দরকার কী? ৭২ শতাংশ কলকাতাবাসী যখন ৯৩ শতাংশ আসন একটি দলকেই দান করার পক্ষে তখন কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভোট করার দরকারটা কী? দেশের স্বাধীনতার পর বাহান্নর প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জওহরলাল নেহেরুও তো এই ম্যাজিক দেখাতে পারেন নি। ইন্দিরার মৃত্যুর পর সহানুভূতি হাওয়াতেও ৯৩ শতাংশ আসন আর ৭২ শতাংশ ভোট কামিয়াব করতে পারেন নি রাজীব গান্ধী। একমাত্র উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ং এর পুরসভা নির্বাচনে এমন রেজাল্ট সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের যদি টোটালেটেরিয়ান রেজিমই পছন্দ হয় তবে রাজ্য থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র তুলে দিলে হয় না?
কলকাতা পুরসভার ভোটের ইতিহাসে এমন একতরফা ফল এই প্রথম। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর কলকাতা সহ রাজ্যের পুরসভা গুলিতে নিয়মিত নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৮৫‘র মে মাসে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই ভোটে অনেক কষ্টে ম্যাজিক ফিগার জোগাড় করেছিল বামফ্রন্ট। কলকাতার সিভিক পলিটিক্স বা নগর রাজনীতির অধিকাংশ হেভিওয়েট নেতাই কিন্তু বরাবর কংগ্রেসের। আজ যেই পেশীশক্তির রাজনীতিটা শাসকদল করছে পূর্বতন শাসকদল সেটা নির্বিচারে প্রয়োগ করলে শোভন চট্টোপাধ্যায়, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ ঘোষ, পরেশ পাল, অতীন ঘোষের মতো জনপ্রিয় পুরনেতারা ( civic leaders ) উঠে আসার সুযোগ পেতেন কী? এমন তো নয় ভোটের দিন সিপিএমের ছেলেরা হাত গুটিয়ে বসে থাকত। ২০০৫-এর কলকাতা পুরসভা নির্বাচনেও যথেষ্ট হাঙ্গামা হয়েছিল। বহু জায়গায় তৎকালীন শাসকদলের ক্যাডারদের পেশী শক্তির আস্ফালনে ভোট সুষ্ঠু হয় নি। কিন্তু প্রতিপক্ষকে মাঠেই নামতে দেবো না। ছলে-বলে-কৌশলে-ফাউল করে একতরফা ভোট করানোর মানসিকতা তো সিপিএমও দেখায় নি। দেখালে ঘোর বাম রাজত্বে ২০০০ সালে কলকাতার ছোট লালবাড়ি দখল করতে পারত তৃণমূল?
যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না যদি আমরা গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিকে মোটের উপর কার্যকর রাখতে চাই। আর না চাইলে গণতন্ত্রের নামে এই সব তামাশা চলতে দেওয়ার চাইতে জলাঞ্জলি দিয়ে দেওয়াই ভাল। পুরসভা, পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদ, বিধানসভা, লোকসভা – সবই হচ্ছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এক-একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলিতে গণতন্ত্র বিপন্ন হলে তো বিপদই, তার থেকেও বড় বিপদ সমাজের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মৃত্যু ঘটলে। পিটিয়ে,রক্তচক্ষু দেখিয়ে জনাদেশ নিজের পক্ষে আনাই যদি শাসকদলের, ক্ষমতাবানদের আদত হয়ে যায়। এবং লোভে-ভয়ে-ভক্তিতে জনগণ যদি মুখবন্ধ,চোখবন্ধ করে বসে থাকাই নিরাপদে দিনযাপনের সবথেকে ভাল উপায় বলে মনে করে থাকে তবে তাদের সেই অলীক সুখের দিন অস্ত যেতে বেশি সময় লাগবে না।
Photo Credit- Scoopwhoop ( Feature Photo) / AFP and Twitter.