চার উপনির্বাচনে তৃণমূলের বিপুল জয় নয় বিরোধীদের তুমুল পরাজয় ভাবাচ্ছে রাজনৈতিক মহলকে । আসলে শাসকদলের দানবীয় জয়,বিরোধীদের শোচনীয় পরাজয়-গণতন্ত্রের জন্য দুটোই অশনিসংকেত। উপনির্বাচন নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন –
শান্তিপুর ছাড়া বাকি তিন বিধানসভা আসনে তৃণমূলের বিজয় প্রত্যাশিতই ছিল । শান্তিপুর বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। জেতা আসন বিজেপি ধরে রাখলেও রাখতে পারে , এমন ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখেছিলেন কেউ কেউ । উপনির্বাচনে দিনহাটা যে ফের উদয়ন গুহর করতলগত হচ্ছেই এটা ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার আগেই বলে দেওয়া গেছে । কিন্তু মঙ্গলবার সকালে ইভিএম খোলার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে যায়, চার আসনের উপনির্বাচনে যে ফল আসতে চলেছে তা রীতিমতো তাজ্জব হয়ে যাওয়ার মতো । ভোটে জয় যেমন চোখ ধাঁধানো হয় পরাজয়ও তেমনি সম্মানজনক হয় । চার আসনে তৃণমূলের বিরাট জয় রাজনৈতিক মহলকে বিস্মিত করে নি । কিন্তু সবাই টাস্কি খেয়ে গেছেন বিরোধীদের পরাভবের বিশালতা দেখে । সরকারের জনপ্রিয়তায় বিশাল কোনও ধস না নামলে উপনির্বাচনে শাসকদলের পরাজয় বিরল ঘটনা। বাম আমলেও উপনির্বাচনে শাসকদলের হার হয়েছে কদাচিৎ । ২০০৯এর লোকসভা নির্বাচনের পর যখন রাজ্যপাট থেকে বামেদের বিদায়ের পূর্বাভাস দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট তখন বিধানসভার দুটি উপনির্বাচনে সিপিএমকে পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়েছিল । কিন্তু দিনহাটা , খড়দহ , গোসাবা এবং শান্তিপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের যে ফল সামনে এল , তারপর বলাই চলে পশ্চিমবঙ্গের গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার তৃণমূলায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দিনহাটায় উদয়ন গুহর জয় নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ ছিল না । বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র ৫৭ ভোটে নিশীথ প্রামাণিকের কাছে হেরেছিলেন উদয়ন । উপনির্বাচনে উদয়ন গুহ শুধু জিতলেনই না প্রদত্ত ভোটের ৮৪.১৫ শতাংশ একাই সাবাড় করলেন ! বিধানসভায় বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ১৬ হাজার ৩৫ টি ভোট , যা প্রদত্ত ভোটের ৪৭.৬ শতাংশ । তৃণমূলের উদয়ন গুহ পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ১৫ হাজার ৯৭৮টি ভোট , যা প্রদত্ত ভোটের ৪৭.৫৮ শতাংশ । বিজেপির ৪৭.৬ শতাংশ ভোট উপনির্বাচনে নামতে নামতে ঠেকল ১১.৩১ শতাংশে । তৃণমূলের ৪৭.৫৮ শতাংশ ভোট বাড়তে বাড়তে চড়ল ৮৪.১৫ শতাংশে। উদয়ন গুহ পেয়েছেন ১ লক্ষ ৮৯ হাজার ৫৭৫টি ভোট । বিজেপির অশোক মন্ডলের ঝুলিতে মাত্র ২৫ হাজার ৪৮৬টি ভোট। রাজ্য বিধানসভার প্রধান ও একমাত্র বিরোধী দল , বিধানসভা নির্বাচনে যাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ৩৮.১৩ শতাংশ , দিনহাটা আসনে তাদের প্রার্থী জামানত টুকুও বাঁচাতে ব্যর্থ !
গোসাবা আসনেও তৃণমূলের জয় নিয়ে কারও সংশয় ছিল না। কিন্তু জয়ের মার্জিন যে এমন গগনচুম্বী হবে তা বোধ হয় তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব ছাড়া আর কেউ ভাবতে পারেন নি । অথবা তা তৃণমূলের নেতাদেরও কল্পনাতীত । বিধানসভা নির্বাচনে গোসাবায় তৃণমূল প্রার্থী প্রয়াত জয়ন্ত নস্কর জিতেছিলেন ১ লক্ষ ৫ হাজার ৭২৩ টি ভোট পেয়ে । তাঁর প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৫৩.৯৯ শতাংশ। বিজেপি প্রার্থী পেয়েছিলেন ৮২ হাজার ১৪টি ভোট , যা ছিল প্রদত্ত ভোটের ৪১.৮৮ শতাংশ। উপনির্বাচনে তৃণমূলের সুব্রত মন্ডলের প্রাপ্ত ভোট ১ লক্ষ ৬১ হাজার ৪৭৪টি । বিজেপি প্রার্থী পলাশ রানা পেয়েছেন সাকুল্যে ১৮ হাজার ৪২৩ টি ভোট। উপনির্বাচনে তৃণমূলের ৫৩.৯৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়াল ৮৭.১৯ শতাংশে । বিজেপির ৪১.৮৮ নামল ৯.৯৫ শতাংশে । উত্থান-পতন দুটোই অবিশ্বাস্য ! গোসাবাতেও জামানত হারালেন বিজেপির প্রার্থী ।
তৃণমূলের হেভিওয়েট এবং জনপ্রিয় নেতাদের মধ্যে অন্যতম শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। গোসাবা ও দিনহাটার তুলনায় শোভনদেবের খড়দহে তৃণমূলের জয়ের জেল্লা কিঞ্চিৎ ম্লান । বিধানসভা নির্বাচনে খড়দহ আসনে তৃণমূলের প্রয়াত কাজল সিনহা পেয়েছিলেন ৪৯.০৪ শতাংশ ভোট। বিজেপির শীলভদ্র দত্ত পেয়েছিলেন ৩৩.৬৭ শতাংশ ভোট। সিপিএমের দেবাশিস ভৌমিকের ছিল ১৪.৭ শতাংশ। উপনির্বাচনে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় পেলেন ৭৩.৫৯ শতাংশ ভোট। বিজেপির ভোট কমে দাঁড়াল ১৩.০৭ শতাংশে । সিপিএমের দেবজ্যোতি দাশ পেয়েছেন ১০.৩৯ শতাংশ ভোট। খড়দহে জামানত খুইয়েছে বিজেপি-সিপিএম দু’দলই।
যেই শান্তিপুর নিয়ে বিজেপির কিঞ্চিৎ আশা ছিল সেই শান্তিপুরে গোহারা হারলেও বিজেপির সান্ত্বনা ,জামানত অন্ততঃ বাঁচানো গেছে শক্ত ঘাঁটিতে । বিধানসভা নির্বাচনে শান্তিপুর আসনে বড় ব্যবধানে জিতেছিলেন সাংসদ জগন্নাথ সরকার। তিনি পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ৯ হাজার ৭২২টি ভোট , শতাংশের হিসেবে যা ৪৯.৯৪ । তৃণমূলের প্রয়াত অজয় দে পেয়েছিলেন ৯৩ হাজার ৮৪৪ টি ভোট , শতাংশের হিসেবে যা ছিল ৪২.৭২ । জোটের রিজু ঘোষাল পেয়েছিলেন মাত্র ৪.৪৮ শতাংশ ভোট। উপনির্বাচনে বিজয়ী তৃণমূল প্রার্থী পেয়েছেন ১ লক্ষ ১২ হাজার ৮৭টি ভোট । ৪২.৭২ থেকে তৃণমূলের ভোট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪.৮৯ শতাংশে। বিজেপি প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ৪৭ হাজার ৪১২ টি ভোট। প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ থেকে বিজেপির ভোট কমে দাঁড়িয়েছে ২৩.২২ শতাংশে। শান্তিপুরে উল্লেখ করার মতো বিষয় হল , সিপিএমের ভোটের নজরকাড়া বৃদ্ধি । বিধানসভা নির্বাচনে জোট প্রার্থীর বরাতে জুটেছিল মাত্র ৪.৪৮ শতাংশ ভোট। উপনির্বাচনে সিপিএম প্রার্থী সৌমেন মাহাতো পেয়েছেন ৩৯ হাজার ৯৫৮টি ভোট । সিপিএমের প্রাপ্ত ভোটের হার ১৯.৫৭ শতাংশ। উপনির্বাচনে কংগ্রেস পৃথকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পেয়েছে মাত্র ১.৪১ শতাংশ ভোট। জোট প্রার্থীর ৪.৪৮ থেকে সিপিএমের ১৯.৫৭ – উপভোটে ১৫.০৯ শতাংশের এই উল্লম্ফন এই ঘোর দুঃসময়েও বাম শিবিরকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে । এই ১৫ শতাংশ ভোট যে বিজেপির থেকে বামে ফেরত এসেছে ভোটের পরিসংখ্যান থেকেই তা স্পষ্ট ।
শাসকদলের দানবীয় জয় , বিরোধীদের শোচনীয় পরাজয় – গণতন্ত্রের জন্য দুটোই অশনিসংকেত। বাম জামানায় সিপিএমও কিছু কিছু আসনে বিস্ময়কর মার্জিনে জিতত । কোনও দলের রেকর্ড মার্জিনে জেতার বিজিগীষা , জনগণের কোনও দলকে রেকর্ড মার্জিনে জেতানোর মানসিকতা – দুটোই সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য ব্যধি ছাড়া আর কিছু নয়। বিধানসভায় অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পর থেকেই রাজ্য বিজেপির সংগঠনের হাড়ির হাল । তৃণমূল থেকে আসা নেতারা রোজ ঘর ওয়াপসি করছেন । টপাটপ বিজেপির বিধায়ক গিলে নিচ্ছে তৃণমূল। উপনির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের ধাক্কায় আরও ক’জন বিধায়ককে রাজ্য বিজেপি হারায় , এখন এটাই দেখার । বুথ স্তরে মজবুত সংগঠন ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে জনভিত্তি ধরে রাখা মুশকিল । আবার শুধু সংগঠনে হয় না জনপ্রিয় সেনাপতি এবং লাগাতার কর্মসূচি ছাড়া মানুষের মনে দাগ কাটা কঠিন। পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী শিবিরের অবস্থা সত্যিই শোচনীয় এবং ছন্নছাড়া। সামনেই রাজ্য জুড়ে পুরসভা নির্বাচন। পুরভোটের আগে উপনির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় যে রাজ্য বিজেপিকে যথেষ্টই হতোদ্যম করবে সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
Photo Credits – AITC website. Feature image- symbolic.