প্রকৃতি ,পরম্পরা ও জীবনধারাকে জুড়ে নতুন পর্যটনের নাম ‘ গুরুবাস ‘। নিছক ঘোরা নয় প্রকৃতি,পরম্পরা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ এখন আপনার সামনে । গুরুবাস থেকে ফিরে এসে জীবন সম্পর্কে আপনার স্থূল ধারণাটিও পাল্টে যেতে পারে । লিখেছেন অরুণ কুমার –
চলুন যাই গ্রামে । কিছু দিন কাটিয়ে আসি মাটি , শুদ্ধ বাতাস , শ্যামল প্রকৃতি আর দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের সান্নিধ্যে । আপনার পাতে পড়বে বিষমুক্ত জৈব খাদ্য আর আপনি পাবেন হাতেকলমে কিছু পরম্পরাগত শিক্ষা । আমাদের শেকড়ের মধ্যে আছে গ্রাম । কংক্রিটের জঙ্গল যখন আমাদের গ্রাস করতে আসে । শহরের কোলাহল আর নিরন্তর যান্ত্রিক শব্দে যখন পাগল পাগল লাগে তখন হাঁফ ছাড়তে আমরা শেকড়ে ফিরি , গ্রামের দিকে পা বাড়াই । আপনি যদি মন থেকে সত্যিই ভারতবর্ষের শাশ্বত , সনাতন গ্রামের দিকে পা বাড়িয়ে থাকেন , তবে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে ‘ গুরুবাস ‘ । করোনা অতিমারির জেরে বিশ্ব জুড়ে খাদের কিনারায় পর্যটন শিল্প । এই পরিস্থিতিতে পর্যটন শিল্পকে আলো দেখাতে জোর দেওয়া হচ্ছে গ্রামীণ পর্যটনে । অন্ধকারে ডুবতে বসা দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটন শিল্পের জন্য সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলে দিতে চলেছে গ্রামীণ পর্যটন – এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা । গ্রামীণ পর্যটনকেই আবার নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে আগ্রহী গুরুবাস প্রকল্প ।
প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যের মধ্যে গ্রামে বাস । গ্রামকে কেন্দ্র করেই শিক্ষালাভ , জীবনযাপন এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন । আবার গ্রামের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন সাধন । এই রকম ভাবতেন মহাত্মা গান্ধী এবং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গুরুদেব কলকাতা মহানগরী ছেড়ে স্থিত হয়েছিলেন বোলপুর শান্তিনিকেতনে । গড়ে তুলেছিলেন তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প বিশ্বভারতী। গুরুবাস পর্যটন প্রকল্পের অনুপ্রেরণার উৎস রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির গ্রামীণ ভারতের আদর্শ । ২০২১ এর বাইশে শ্রাবণ কবির তিরোধান দিবসে গুরুবাস প্রকল্পের যাত্রা শুরু ভারতের প্রাক্তন জাতীয় ফুটবলার ও জাতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক ভাইচুং ভুটিয়ার গ্রাম দক্ষিণ সিকিমের ‘ তিনকিতাম ‘ থেকে । গুরুবাস পর্যটন প্রকল্পের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ভাইচুং নিজেই । গুরুবাস পর্যটন প্রকল্পের ভাবনাটা আসলে অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন এন্ড ট্যুরিজম এর আহ্বায়ক রাজ সুপ্রতীম বসুর । রাজ সুপ্রতীম বসু দেশের পর্যটন বিশেষজ্ঞদের একজন, যিনি হিমালয় সংলগ্ন উত্তরবঙ্গ , তরাই-ডুয়ার্স , দার্জিলিং পাহাড় এবং সিকিম সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পযটন শিল্পের বিকাশে নানা ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন। ভারতের তরাই-ডুয়ার্স , সিকিমের পাশাপাশি হিমালয়ের দেশ নেপাল এবং চিরসবুজের দেশ বাংলাদেশেও গুরুবাস প্রকল্প বাস্তবায়িত করার পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ বসুর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
গুরুবাস পর্যটন প্রকল্পের মূল ভাবনাটি হল, নিছক ঘোরা নয় বরং গ্রামে থেকে কিছু শেখা এবং শিক্ষাটাকে জীবনে ও সমাজে প্রয়োগ করা । গ্রামকে কেন্দ্র করে কৃষি , শিল্প , সংস্কৃতি এবং বাণিজ্যের যে ধারা এই উপমহাদেশে বহমান তাকে পর্যটনের ভেতর দিয়ে উজ্জীবিত করাই গুরুবাস প্রকল্পের লক্ষ্য । গুরুবাস প্রকল্পের উদ্ভাবক রাজ সুপ্রতীম বসু বলেন, ” অতিমারি আমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছে । আবার শিখিয়েছে , শুদ্ধ জল , মাটি আলো এবং বাতাস দিয়ে ঘেরা এই অকৃত্রিম ধরিত্রীর কোনও বিকল্প নেই। শহর থেকে তো প্রকৃতি প্রদত্ত বিশুদ্ধতা হারিয়েই গেছে এমনকি দূষণের থাবা পড়েছে গ্রামেও । ” এই পরিস্থিতিতে গ্রামে জীব বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষ করার পাশাপাশি শহরের সঙ্গে গ্রামের সমন্বয় সাধন জরুরী বলে মনে করেন পর্যটন বিশেষজ্ঞ রাজ সুপ্রতীম বসু। গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার করতে প্রয়োজন শহরের সহযোগিতা। আমরা যদি শেষ পর্যন্ত নগরজীবনকে বিষাক্ত গ্যাসের চেম্বারে পরিণত করতে না চাই তবে গ্রামকে তার আদি ও অকৃত্রিম চেহারায় রক্ষা করা ব্যতীত মানুষের সামনে দ্বিতীয় কোনও রাস্তাই নেই। ঠিক এই জায়গা থেকেই গুরুবাস প্রকল্প নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভাবনা ।
প্রত্যেকটা গ্রামের একটা নিজস্ব জৈব বৈচিত্র্য আছে । এই জৈব বৈচিত্র্যকে রক্ষা করা এবং তার সঙ্গে পর্যটকদের পরিচয় করিয়ে দেবে গুরুবাস প্রকল্প। একটা গ্রামের মাটি ,জল , কৃষি এবং খাদ্য সমস্ত কিছুই ‘ ব্যাক ইয়ার্ড বায়ো ডাইভার্সিটি রিসোর্সেস ‘এর দান। এই বৈচিত্র্য নষ্ট হওয়ার পথে । এখনই সময় এর সংরক্ষণে উদ্যোগী হওয়া । গুরুবাস পর্যটন গ্রামীণ জৈব বৈচিত্র্য রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাজ বসু । প্রকৃতির পাশাপাশি গ্রামীণ ঐতিহ্য-পরম্পরা , শিল্প , সংস্কৃতি ও ভেষজ জ্ঞানকেও বাঁচিয়ে রাখা জরুরী । শতশত বছরের অভিজ্ঞতায় , বংশানুক্রমিক ধারায় এইসব অর্জন করেছেন গ্রামের মানুষেরা । ভারতবর্ষের এক-একটি গ্রাম লোকসংস্কৃতি ও হস্তশিল্পের খনি । গ্রামীণ শিল্পীরা মাটি , পাথর ও কাঠ , বাঁশ ও বেত দিয়ে কতরকমের সূক্ষ্ম নিদর্শন তৈরি করেন। গ্রামে গ্রামে কত রকমের লোকসঙ্গীত , বাদ্যযন্ত্র চোখে পড়ে। স্থানভেদে গ্রামবাসীদের পোশাকের বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয় । কত বিচিত্র রকমের খাদ্যাভ্যাস ও রন্ধন প্রণালী। গ্রামের মানুষের জীবন , জীবিকা , সংস্কৃতি , শিল্প , সঙ্গীত এবং জ্ঞানের সঙ্গে পর্যটনকে জুড়ে দিয়েছে গুরুবাস । দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা গ্রামে আসবেন । থাকবেন । গ্রামের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা , মত বিনিময় করবেন । তাদের শিল্প সংস্কৃতি , কৃষি , খাদ্যাভ্যাস ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচিত হবেন এবং কিছু শিখবেনও । ফলে গ্রাম গুলি অর্থনৈতিকভাবে যেমন লাভবান হবে তেমনি পর্যটকেরা এমন কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেদের পরিবেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবেন , যা তাঁদের জীবনধারা ও মূল্যবোধকে পাল্টে যেতে সাহায্য করবে।
গ্রামবাস না হয়ে প্রকল্পটির নাম গুরুবাস কেন , মানুষের মনে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক । ভারতবর্ষ গুরু পরম্পরার দেশ । সমস্ত বিদ্যা আমরা লাভ করতাম গুরুর মুখ থেকে শুনে শুনে । গ্রামীণ ভারত থেকে উঠে আসা প্রায় সমস্ত বিদ্যাই গুরুমুখী। প্রাচীন ভারতে গুরুকুল ছিল জ্ঞানলাভের কেন্দ্র । বাল্য থেকে কৈশোর গুরুগৃহে জ্ঞানলাভ অন্তে সংসার জীবনে প্রবেশ করত মানুষ। গুরুবাস পর্যটনে এক-একটি গ্রামের প্রবীণ ও অভিজ্ঞ মানুষদের খুব মূল্য দেওয়া হচ্ছে । কৃষি , শিল্প , কারিগরি বিদ্যা , লোকসঙ্গীত , ভেষজগুণযুক্ত গাছগাছড়া সম্পর্কে জ্ঞান সম্পন্ন লোকেদের অনুসন্ধান করে গুরুবাস পর্যটনকেন্দ্র গুলিতে শিক্ষকের পদে বসানো হচ্ছে। আপনি গ্রামে বাস করতে করতে এই সমস্ত জ্ঞানী , গুণী এবং অভিজ্ঞ মানুষদের গুরু হিসেবে লাভ করবেন এবং পরম্পরাগত জ্ঞান , যা থেকে আপনি বঞ্চিত তা অর্জন করার সুযোগ আপনার হবে । গুরুবাস যাপন করে আপনি যখন শহরে , কংক্রিটের জঙ্গলে নিজের ঘরে চার দেওয়ালের ভেতরে ফিরে যাবেন জীবন সম্পর্কে আপনার ধারণা পাল্টে যেতেও পারে ।
ভাইচুং ভুটিয়ার গ্রাম দক্ষিণ সিকিমের ‘ তিনকিতামে ‘ গুরুবাস পর্যটনের প্রথম প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার চারিপাড়া গ্রামে গুরুবাসের দ্বিতীয় প্রকল্পটি চালু হয়েছে গত পয়লা সেপ্টেম্বর। ভারত , বাংলাদেশ , নেপাল , ভূটান এবং শ্রীলংকায় গুরুবাস প্রকল্প বাস্তবায়িত করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকৃতি , পরম্পরা ও জীবনধারা নির্ভর এই পর্যটনের প্রসারে যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে ভারতের অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন এন্ড ট্যুরিজম এবং বাংলাদেশের ‘ বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশন ।’
ছবি – লেখক ও গুরুবাস ফেসবুক পেজের সূত্রে প্রাপ্ত।