চল্লিশ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের জন্য সহানুভূতি দেখানোর লোকের অভাব নেই ভারতে। এদিকে সাড়ে এগার লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিয়ে মহা ফাঁপরে বাংলাদেশ সরকার । রোহিঙ্গা শিবিরে জাঁকিয়ে বসেছে জঙ্গি সংগঠন আরসা । সঙ্গত কারণেই এই খবর স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না সাউথ ব্লককে । বিশেষ প্রতিবেদনে জানুন বিস্তারিত –
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মায়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ মৌলবাদী জঙ্গিদের দলে নাম লিখিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের আশঙ্কা। কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির এমনিতেই অপরাধী ও মাদক পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য । সাম্প্রতিক সময়ে শুধু সাধারণ অপরাধ নয় জঙ্গি নাশকতার দিকেও ঝুঁকে পড়েছে রোহিঙ্গারা । আর এতে মদত দিচ্ছে পাকিস্তানের আইএসআই। রোহিঙ্গারা একযোগে মায়ানমার , বাংলাদেশ ও ভারতের মাথাব্যথার কারণ । মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বানানোর লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়ে আসছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি ( আরসা ) । ২০১৮ পর্যন্ত মাঝেমধ্যেই রাখাইন প্রদেশে মায়ানমারের পুলিশ ও সেনা শিবিরের উপর অতর্কিত হামলা ও রাখাইন জনগোষ্ঠীর উপর চড়াও হত আরসার জঙ্গিরা । কিন্তু এই উপদ্রব গোড়াতেই ঠান্ডা করে দিতে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে দেরি করে নি মায়ানমারের সামরিক সরকার ।
সামরিক অভিযানের মুখে আরসার জঙ্গিরা পালিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে গাঢাকা দেয় । হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুর ঢল নামে সীমান্তে । বাংলাদেশের উপকূলবর্তী কক্সবাজার জেলায় ছড়িয়ে পড়ে তারা । শরণার্থীদের ভিড়ে আত্মগোপনের কাজটা সহজ হয়ে যায় জঙ্গিদের জন্য । রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে শিবির খোলে বাংলাদেশ সরকার। রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ ভারত-মায়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চল হয়ে রাজধানী দিল্লি , কাশ্মীর সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনুপ্রবেশ করে । বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদেরও ধান্ধা হল যে কোনও উপায়ে ভারতে ঢুকে পড়া । এবং তারা ঢুকেছেও । বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ , অসম ও ত্রিপুরায় বহু রোহিঙ্গা বিএসএফ ও পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে । যারা ধরা পড়ে নি তাদের সংখ্যা ধৃতদের থেকে কয়েক গুণ বেশি বলেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের অনুমান। বাংলাদেশে তিনটি শরণার্থী শিবিরে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা আছে বলে দেশটির সরকারের হিসেব । ভারতে বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গার সংখ্যা চল্লিশ হাজারের কম হবে না।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে রীতিমতো ফাঁপরে পড়েছে শেখ হাসিনার সরকার। আধুনিক শিক্ষাদীক্ষার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংশ্রব নেই বললেই চলে । পুরো জাতিগোষ্ঠীটাই ভীষণ রকমের অনগ্রসর , দরিদ্র , গোঁড়া , এবং ধর্মান্ধ । এই সব কারণে স্বাভাবিকভাবেই এদের মধ্যে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেশি। নারীদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের বালাই নেই । এক-একজন বিবাহিত রোহিঙ্গা নারী তাঁর প্রজননক্ষমতা অটুট থাকা পর্যন্ত সন্তানের জন্ম দিয়েই যান এবং কেউ কেউ সারাজীবনে ১১-১২টি পর্যন্ত বাচ্চার জন্ম দেন ! ধর্মীয় প্রভাবে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ এখনও জন্মনিয়ন্ত্রণকে এখনও তেমন সুনজরে দেখে না। রোহিঙ্গা শিবিরের জন্মহার দেখে তাদেরও চক্ষু চড়কগাছ । ইউএনএইচসিআর এর পপুলেশন শিট ও হেলথ সেক্টরের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতি বছর নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর হার ৩০ হাজার ৪৩৮ জন । প্রতি বছর শরণার্থী শিবির গুলিতে অন্তঃসত্ত্বা হন ৩৫ হাজার ৪ জন নারী । শিবির গুলিতে এক থেকে চার বছরের শিশুর সংখ্যা ১ লক্ষ ৩৩ হাজার ৪১৪টি । পাঁচ থেকে এগার বছরের শিশু ১ লক্ষ ৯৪ হাজার ৭৬৯ জন ।ইউএনএইচসিআর প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মহার সাড়ে তিন শতাংশেরও ( ৩.৫ ) বেশি । এহেন বিস্ফোরক জন্মহার দেখে বাংলাদেশ সরকারের মাথায় হাত । অবস্থা বেগতিক বুঝে রোহিঙ্গা শিবির গুলিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কর্মসূচি নিয়েছে প্রশাসন । যদিও সেসবের সাফল্য নিয়ে যথেষ্টই সন্দিহান সরকারি মহল । কেননা, রোহিঙ্গা পরিবারের কর্তাদের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ হারাম । তাছাড়া রাজনৈতিক কারণে বেশ সচেতনভাবেই জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে একটা অস্ত্র হিসেবে নিয়েছে রোহিঙ্গারা ।
রোহিঙ্গাদের শিবির গুলিতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খায় পুলিশ । বিশেষ করে উখিয়ার শরণার্থী শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ । চার বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে খুন হয়েছে ১০৮ জন । শিবির গুলি মাদক পাচার , নারী পাচার , শিশু পাচার এবং আদম ব্যবসায়ীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে । ঘরে ঘরে বেআইনি অস্ত্রের ভান্ডার । নিজেদের মধ্যে মারামারি , খুনোখুনি তো লেগেই রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গেও রোহিঙ্গাদের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে । শিবির সংলগ্ন এলাকা গুলিতে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় রোহিঙ্গাদের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে । ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে স্থানীয়দের প্রাণহানি পর্যন্ত হয়েছে । প্রথমদিকে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ উপচে পড়লেও এখন তাদের ঘাড়ের উপর চেপে বসা আপদ বলেই মনে করে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ। শরণার্থী শিবিরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি না থাকলেও সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা । সস্তায় শ্রম দিয়ে বহু ক্ষেত্রেই বাংলাদেশীদের কাজ খেয়ে নিচ্ছে তারা । বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগেও প্রত্যেক মাসে গড়ে দশজন করে রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করছে পুলিশ।
এতদিন পর্যন্ত কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসনকে চিন্তায় রাখত রোহিঙ্গা শিবিরে সক্রিয় সংগঠিত -অসংগঠিত নানা অপরাধচক্রের কার্যকলাপ । এখন খোদ শেখ হাসিনার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গাদের মৌলবাদী জঙ্গি সম্পৃক্ততা । রোহিঙ্গা শিবির গুলিতে জঙ্গি সংগঠন আকসার দাপট দ্রুত বাড়ছে এবং সমান্তরালভাবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক সমাধানে বিশ্বাসী ও মায়ানমারে প্রত্যাবর্তনে ইচ্ছুক নেতৃত্বের প্রভাব কমছে । সাম্প্রতিক সময়ে পর পর দুটি ঘটনা বাংলাদেশ সরকারের টনক নাড়িয়ে দিয়েছে । গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা মুহাম্মদ মুহিবুল্লাহকে গুলি করে মারে দুষ্কৃতীরা । মুহিবুল্লাহ ছিলেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান । বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে চলা ত্রিপাক্ষিক আলোচনায় যুক্ত ছিলেন তিনি । প্রত্যাবর্তনে অনিচ্ছুক জঙ্গি সংগঠন আরসার সদস্যরা মুহিবুল্লাহকে খুন করেছে বলে জানতে পেরেছে তদন্তকারী সংস্থা । ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। গত ২২ অক্টোবর ভোরে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ১৮ নম্বর ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা শিবিরে এক মাদ্রাসার ভেতরে হামলার ঘটনায় ছয়জনের মৃত্যু হয় । হামলার জন্য জঙ্গি সংগঠন আরসার দিকেই আঙ্গুল তুলেছেন মৃতদের স্বজনেরা । যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ হাতে পেলেও রোহিঙ্গা শিবির গুলিতে আরসার সক্রিয়তার কথা এখনও সরাসরি সেভাবে স্বীকার করেছে না বাংলাদেশ সরকার। আরসার নাম ব্যবহার করে শরণার্থী শিবিরের ভেতরে গজিয়ে ওঠা সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী গুলিই এইসব ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সরকারি বাহিনীর দাবি । তবে রোহিঙ্গা শিবিরে যে বাইরে থেকে এমনকি মায়ানমার থেকেও আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকছে তা স্বীকার করে নিয়েছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান । মাত্র চার বছরের মধ্যে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নিয়েছে ১৪ টিরও অধিক পৃথক পৃথক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী । খুন-খারাবি , চুরি-ডাকাতি , মাদক পাচার , নারী পাচার সহ রকমের অপরাধের সঙ্গে এরা জড়িত । পাশাপাশি গোষ্ঠী গুলির নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের জেরে সারা বছরই উত্তপ্ত থাকছে রোহিঙ্গা শিবির ।
রোহিঙ্গা শিবির গুলিতে জন্ম নেওয়া দুর্বৃত্ত গোষ্ঠীদের কোনও কোনওটি যে জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির খপ্পরে ইতিমধ্যেই পড়ে যায় নি সেই ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারছে না বাংলাদেশ প্রশাসন । বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে জঙ্গিদের প্রভাব বৃদ্ধি ভারতের জন্য যথেষ্টই উদ্বেগের। আরসা কট্টর ইসলামিক মৌলবাদে বিশ্বাসী । বাংলাদেশের হাসিনা সরকার ও ভারতকে উত্যক্ত করার লক্ষ্যে আরসাকে মদত দিতে চেষ্টার ত্রুটি রাখে না পাকিস্তান । এদিকে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে জঙ্গি সংগঠন আরসার দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যাপারে মায়ানমার সরকার যে আরও শক্ত অবস্থান নেবে এই ব্যাপারে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই । রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার আর কোনও নামই করবে না মায়ানমার । এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে স্থায়ী ঝামেলায় পড়বে বাংলাদেশ । ভুগতে হবে ভারতকেও । এমনিতেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে জ্বালার শেষ নেই সাউথ ব্লকের । ২০১৭ সালের হিসেব অনুযায়ী ৪০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে ভারতে । এরপরেও আরও অসংখ্য রোহিঙ্গা যে নিরাপত্তা বলয়ের ফাঁক ফোকর গলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে তা নিয়ে সংশয় নেই গোয়েন্দাদের । ভারতেও রোহিঙ্গাদের মদত দেওয়ার মতো এলিমেন্টসদের অভাব নেই । পশ্চিমবঙ্গেই ঘুপেচুপে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ । বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের মধ্যে জঙ্গি কার্যকলাপ বৃদ্ধি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আইনশৃংখলার জন্য বড় হুমকি । তাই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার উপর্যুপরি হামলার খবরে উদ্বেগ বাড়ছে দিল্লিরও ।
Photos Credits – Bangladesh Post / AFP/ Reuters / PBS and Twitter.