বাংলাদেশে ইসকনের উপর আক্রমণ নতুন নয়। প্রত্যেকটি আক্রমণের পর আরও শক্তিশালী হয়েছে ইসকন। বাংলাদেশের কোনঠাসা সংখ্যালঘু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নতুন একটি ভরকেন্দ্র হয়ে উঠতে চলেছে প্রভুপাদের আন্তর্জাতিক সংগঠনটি। বিশেষ প্রতিবেদন –
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রীল অভয়চরণাবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ প্রতিষ্ঠিত ইসকনের ( International Society for Krishna Consciousness ) প্রভাব বাড়ছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা বরাবরই অসংগঠিত। কমতে কমতে মাত্র আট শতাংশে এসে হিন্দুরা এখন এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক গাঁটছড়া বরাবরই আওয়ামি লিগের সঙ্গে। পাকিস্তান আমল থেকেই তার সূত্রপাত। একমাত্র আওয়ামি লিগের আশ্রয়েই সংখ্যালঘুরা নিরাপদে বাস করতে পারে- এই কথাটা বাংলাদেশে প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে। যদিও রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে এই মিথের মিলমিশ কতটুকু তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামি লিগ হিন্দুদের জন্য একধরণের আশ্রয় হয়ে উঠলেও তাদের মধ্যে সামাজিক ও ধর্মীয় ঐক্য কোনও দিনই সেভাবে পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের একাধিক সংগঠন আছে বটে, স্বজাতির বিপদের দিনে তারা কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করে তা নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই যথেষ্ট সংশয় আছে। ইসকন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারক একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। ৬৯ বছর বয়সে একা আমেরিকায় পৌঁছে বাঙালি প্রভুপাদ কীভাবে মহাপ্রভু মুখ নিঃসৃত “হরে কৃষ্ণ হরে রাম” নামমন্ত্রে পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ সমাজকে উদ্বেলিত করে তুললেন তা গল্পকেও হার মানায়। ইসকনের আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও ব্যাপ্তির কথা আজ সকলের জানা। বাংলাদেশেও গত দশ বছরে ইসকনের প্রচার , প্রসার ও প্রভাব চোখে পড়ার মতো।
দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যে প্রবল ঝটিকা আক্রমণ নেমে এসেছে তাতে প্রতিষ্ঠানগতভাবে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রভুপাদের ইসকন। নবমীর বিকেলে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে ইসকনের মন্দিরে হামলার ঘটনায় তিনজন ভক্ত প্রাণ হারান। গোটা মন্দির তছনছ করে দেয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মান্ধ দুর্বৃত্তরা। বাংলাদেশে ইসকনের উপর আক্রোশ এবং আক্রমণ নতুন নয়। ২০০৯ এ ইসকন পরিচালিত চট্টগ্রামের শ্রীশ্রী রাধামাধব মন্দির কর্তৃপক্ষের অনাথ আশ্রমে হামলা দিয়ে শুরু। ২০১৫‘য় দিনাজপুরের ইসকন মন্দিরে জামায়েত-উল-মুজাহিদিন গোষ্ঠীর সন্ত্রাসবাদীদের হানা। ষোলোয় সিলেটের ইসকন মন্দিরে ধর্মান্ধ সংখ্যাগুরু জনতার আক্রমণ। ঘটনায় দশজন ভক্ত আহত হন। আঠারোয় রাজধানী ঢাকায় ইসকনের রথযাত্রায় হামলা। ছয়জন ভক্ত রক্তাক্ত। উনিশে গুজব ছড়িয়ে ইসকনের ফুড ফর লাইফ কর্মসূচীকে অযথা কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা। বিশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার উল ইসলাম বাংলাদেশে ইসকনের স্থাপনা গুলিতে বড়সড় হামলা চালানোর ষড়যন্ত্র করলেও পুলিশের তৎপরতায় ভেস্তে যায়। একুশে দুর্গা পুজোর নবমী তিথিতে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে মন্দির রক্ষা করতে গিয়ে ধর্মোন্মাদদের হাতে প্রাণ দিলেন ইসকনের তিন সেবক। আহত অনেক কৃষ্ণভক্ত।
বাংলাদেশে ইসকনের উপর হামলা হচ্ছে এটা যেমন সত্যি। তেমনি এটাও সত্যি প্রত্যেকবার হামলার পর ইসকনের সংগঠন আগের থেকে আরও বেশি মজবুত হচ্ছে। বাংলাদেশের ৮টি প্রশাসনিক বিভাগের প্রত্যেকটিতেই ইসকনের অস্তিত্ব আছে। বাংলাদেশ জুড়ে ৭১টি মন্দির ও কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে ইসকন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আর কোনও সংগঠনের এত ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে নি বাংলাদেশে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের একটি বড় অংশ ইতিমধ্যেই ইসকনের সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে একাত্ম হয়ে পড়েছেন। নোয়াখালীতে সাম্প্রতিকতম হামলার পরে বাংলাদেশে ইসকনের শক্তি আরও বেশি সুসংহত হওয়ার সুযোগ পেল বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। আক্রান্ত হয়ে ইসকন গুটিয়ে যায় নি। রক্তাক্ত বৈষ্ণব সাধু-সন্ন্যাসী-সেবক-ভক্তরা প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। সামাজিক মাধ্যম মুখরিত হয়ে উঠেছে ঘটনার নিন্দায়। দলে দলে মানুষ আক্রান্ত ইসকনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে আক্রান্ত অন্যান্য হিন্দুদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে ইসকনকেও। ভয় পেয়ে ইসকন, বাংলাদেশের ট্যুইটার হ্যান্ডেল পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে সরকার। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ, মন্দিরে হামলা ও তিন বৈষ্ণবের নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে ২৩ অক্টোবর বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদ দিবস পালন করছে ইসকন।
মহাপ্রভু স্বকন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ” পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম / সর্বত্র প্রচার হইবে মোর নাম ।। ” ইসকনের প্রচারেকেরা বলছেন, ” মহাপ্রভুর ভবিষ্যদ্বাণী সফল করতে জাপান থেকে জামাইকা যেই উৎসাহ নিয়ে তাঁরা হরে কৃষ্ণ হরে রাম মহামন্ত্র প্রচার করে চলেছেন সেই একই উৎসাহ নিয়ে বাংলাদেশের গ্রামে-শহরে মহাপ্রভুর নাম বিলিয়ে চলেছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোনও ভেদভাব তাঁরা করেন না। ” কোনও রকম হামলা-আক্রমণ-কুৎসা-অপপ্রচার বাংলাদেশে তাদের ধর্মপ্রচার , আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড ও শান্তিপূর্ণ কার্যক্রমকে স্তব্ধ করতে পারবে না বলে স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে ইসকন কর্তৃপক্ষ। কোনও সন্দেহ নেই যে, ইসকন আজ বাংলাদেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের চক্ষুশূল , যারা বাংলাদেশে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মাচরণের অধিকারটুকু পর্যন্ত স্বীকার করে না। বাংলাদেশে ইসকনকে নিয়ে কুৎসা-অপপ্রচারের শেষ নেই। ইসকনকে কখনও সিআইএ, কখনও মোসাদ, কখনও বা র’এর এজেন্ট বানিয়ে দিচ্ছে এরা। তবে একটা কথা পরিস্কার। সংখ্যালঘুদের উপর মৌলবাদীদের আগ্রাসন-অত্যাচার যত বাড়বে বাংলাদেশের সনাতনী সমাজে ইসকনের প্রভাব ততই বাড়বে।
ফিচার ফটো-চট্টগ্রামে নব নির্মিত ইসকন মন্দিরের।
Photos Credits – ISKCON FB page . Video Source – ISCKON Bengal Youtube Channel.