বঙ্কিমচন্দ্র কি মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন ? মিথ ও মিথ্যার আবরণ সরিয়ে ' বঙ্কিম দর্শন ' - nagariknewz.com

বঙ্কিমচন্দ্র কি মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন ? মিথ ও মিথ্যার আবরণ সরিয়ে ‘ বঙ্কিম দর্শন ‘


তিনি বিশ্বমানব ছিলেন না । তিনি একান্ত‌ই বাংলার । বাঙালির । বাংলা গদ্যসাহিত্য সাবালকত্ব অর্জন করেছে তাঁর হাত ধরেই । বাঙালির কাছে তাই তিনি সাহিত্যসম্রাট । কিন্তু তাঁর প্রতি মহাকাল আরোপিত দায়িত্ব এখানেই শেষ নয় । আমাদের জাতীয়তাবাদের মহামন্ত্রদাতা গুরুও তিনিই । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সবথেকে বড় অভিযোগ – তিনি মুসলমান বিদ্বেষী ! সত্যিই কি তাই ? মিথ ও মিথ্যার খোসা সরিয়ে প্রকৃত ‘ বঙ্কিম দর্শন ‘ করালেন ডঃ তমাল দাশগুপ্ত

সেই ক্লিশে প্রশ্ন, আবার। বঙ্কিম কি মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন? বঙ্কিম সম্বন্ধে প্রায়ই বলা হয়, তিনি মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষী ছিলেন। এ বক্তব্যটি প্রায় মিথিক্যাল হয়ে গেছে। অন্য সমস্ত মিথের মতই, এ কথাটা কতটা যথার্থ ইতিহাস, আর কতটা কল্পনা, এই প্রবন্ধে আমরা সেটা খোঁজার চেষ্টা করব। বঙ্কিম উদারমনস্ক ছিলেন, জাতীয়তাবাদী ছিলেন অবশ্যই। তিনি আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের নির্মাতা (বন্দে মাতরম বঙ্গমাতার উদ্দেশ্যেই লেখা হয়েছিল; সপ্ত কোটি কণ্ঠ নয়ত লিখতেন না)। তাঁর অসামান্য অবদান আছে বাংলার হিন্দু পুনর্জাগরণ বা হিন্দু রিভাইভালে। তবে প্রশ্ন হল, তিনি সঙ্কীর্ণভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি কোনও বিদ্বেষ পোষণ করতেন কি ?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে অনেকগুলো ডাইমেনশন চলে আসে। যে জায়গাগুলোকে সাধারণভাবে মুসলিম বিদ্বেষ হিসেবের নজির হিসেবে দেখা যায়, সেগুলোর যথাযথ বিচার করলে প্রায়শই দেখা যাচ্ছে, আসলে তিনি বহিরাগত আগ্রাসনের বিরোধিতা করছেন। বাংলার দেশজ মুসলমানের প্রতি নয়, বঙ্কিম বিরোধিতা করছেন তুর্কি আর মোগল আগ্রাসনের, বহিরাগত শাসকের। যে কোনও আগ্রাসনের বিরোধিতা করা, বিদেশী-বিজাতীয় শাসকের বিরোধিতা করাটা সৎ জাতীয়তাবাদীর কাজ, তাই তিনি করেছেন, এ বিষয়ে তাঁর কোনও বিশ্বমানবিক ভণ্ডামি ছিল না। বিস্তারিতভাবে এই প্রসঙ্গে আমরা আসব। প্রশ্ন হল, এই আগ্রাসনের বিরোধিতা করার জন্য তাকে সাধারণভাবে মুসলমান বিদ্বেষী বলা যায় কি ? এখানে আরেকটা প্রশ্ন চলে আসে। সাহিত্যের আলোচনায় এই কি বিবেচ্য হবে যে সে সাহিত্যে কোনওপ্রকার বিদ্বেষ আছে কি নেই? এটা কি মাপকাঠি হতে পারে সাহিত্যগুণের, যে সাহিত্যকে হতে হবে পলিটিক্যালি কারেক্ট? বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ গ্রন্থে রেজাউল করীম বলছেন- ‘ তুমি কাহাকে আক্রমণ করিয়াছ, কাহার বিরুদ্ধে লেখনী চালনা করিয়াছ, তাহা দেখিবার বিষয় নহে। সেই আক্রমণের মধ্যে তুমি রসসৃষ্টি করিতে পারিয়াছ কি না, তাহাই দেখিতে হইবে। … ঠিক এইভাবে বঙ্কিম- সাহিত্যকে আলোচনা করিতে হইবে। বঙ্কিমচন্দ্র কতকগুলি নবাব-বাদশাহ্‌ সম্বন্ধে কি কথা বলিয়াছেন, তাহা বড় কথা নয়, তাহা মোটেই ধর্ত্তব্যের বিষয় নহে। তিনি রসসৃষ্টি করিতে পারিয়াছেন কি না, কেবল তাহাই দেখিতে হইবে; যদি পারিয়া থাকেন, তবে তিনি প্রত্যেক যুগের সাহিত্য-রসিকের নিকট চির- আদরণীয়, চির-বরণীয় হইয়া রহিবেন ‘। (১৬-১৭)

যুক্তিটি সাহিত্য সমালোচকদের কাছে সুপরিচিত। এই যুক্তির উৎস “আর্ট ফর আর্টস সেক” তত্ত্বে। শিল্পকলাকে শুধু শৈল্পিক মাপকাঠিতেই বিচার করতে হবে, সেখানে এই জাতীয় বিষয় গৌণ। কিন্তু এখানে তিনটি সমস্যাজনক প্রশ্ন চলে আসে, যেগুলো নিয়ে রেজাউল সচেতন নন –

এক, বঙ্কিম যেগুলো বলছেন, সেগুলো কি ভুল? এইসব নবাব-বাদশাহ্‌ নিয়ে যা যা বলেছেন, সেগুলো বলে বঙ্কিম কি অন্যায় করেছেন? এইসব নবাব-বাদশাহ্‌দের কি হিন্দুবিদ্বেষ ছিল? তারা কি অত্যাচারী ছিলেন এ দেশের মানুষদের প্রতি? তারা কি বহিরাগত, বিদেশী শাসক হিসেবে এ দেশের মানুষ ও এ দেশের সংস্কৃতির প্রতি হোস্টাইল থেকেছেন? যদি থেকে থাকেন, সেক্ষেত্রে বঙ্কিমের পক্ষে তাদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হওয়াটা কতটা অন্যায় হয়েছে ?
দুই, বঙ্কিমের সাহিত্যের রাজনৈতিক ব্যবহার বহুলভাবে হয়েছে । কোনও বিমূর্ত শৈল্পিক আলোচনা হতে পারে বন্দেমাতরমকে নিয়ে, তার ইনটেন্‌স্‌ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে এড়িয়ে? বস্তুতঃ, কোনও সাহিত্যই কি রাজনীতি বিচ্যুত? এভাবে সাহিত্যের সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক কনটেক্সট এড়িয়ে গিয়ে কেবল রসের আলোচনা এমনিতেও সাহিত্যচর্চায় বহুদিন যাবৎ বাতিল হয়ে গেছে। অতএব, এই যুক্তিটি ব্যবহার করা আমাদের পক্ষে আজকে কতটা যুক্তিযুক্ত?
তিন, এভাবে কি রেজাউল প্রকারান্তরে বঙ্কিমের লেখায় মুসলমান বিদ্বেষ আছে, সেটা স্বীকার করে নিলেন ? যদি নিলেন, তাহলে আলোচনা ফুরোয়, তাহলে আর তিনি লিগপন্থীদের আনন্দমঠ পোড়ানোর বিরোধিতা করবেন কীভাবে ?

বিরোধিতা যদি শুধু রসের যুক্তিতে করেন, সে বিরোধিতা বলা বাহুল্য জোরদার নয়, এবং মুষ্টিমেয় সাহিত্যরসিকের বাইরে সে যুক্তিতে কেউ কর্ণপাত করবে না। বস্তুত সাহিত্যরসিকদের মধ্যেও ওই রসের যুক্তিতে আনন্দমঠের সর্বজনগ্রাহ্য কোনও পাঠ নেই। বঙ্কিমের এই উপন্যাসটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক মূল্যায়ন কিন্তু খুব একটা উঁচু ছিল না, তিনি এটিকে প্রচারধর্মীই মনে করেছিলেন, চরিত্রগুলো খুব একটা খোলতাই হয়নি, তারা রক্তমাংস পায়নি, স্রেফ একটা আদর্শের ধারক বাহক হয়েই থেকে গেছে, এরকমটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের মত। রবীন্দ্রনাথের এই মতের বিস্তারিত সমালোচনা বর্তমান প্রবন্ধের আওতার বাইরে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই মতামত উদ্ভূত হচ্ছে পশ্চিমী ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে। আনন্দমঠ একদল সঙ্ঘবদ্ধ বিপ্লবীর কথা বলছে, অর্থাৎ এখানে সমষ্টি ব্যক্তির ওপরে স্থান পাচ্ছে। সেরকমটা না হলে কোনও পরাধীন দেশে স্বাধীনতার লড়াই করা সম্ভবপর নয়। এখানে ইতিহাস ও রাজনীতির কষ্টিপাথরে সাহিত্যকে যাচাই করার প্রয়োজন আছে। ব্যক্তিনির্ভর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গত কারণেই সমষ্টিনর্ভর আনন্দমঠ ভালো লাগার কথা নয়, কিন্তু তার মানে এই না যে সাহিত্যের বিচারে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত মতামতই আনন্দমঠকে খরচের খাতায় লিখে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ।

প্রসঙ্গে ফেরা যাক। আমরা দেখি, রেজাউল কিন্তু এই প্রবলেম্যাটিকস্‌ নিয়ে একদমই ভাবছেন না। তার এই বিষয়ে একটা সরলীকরণ আছে, সেটা তার বক্তব্যকে দুর্বল করেছে। বঙ্কিম হলেন রসস্রষ্টা, স্রেফ এই যুক্তিতে একদল উন্মত্ত বন্দেমাতরম-বিদ্বেষী, বঙ্কিম-বিদ্বেষীকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না, আজও সম্ভব নয়। রেজাউল এক অর্থে প্রতিপক্ষের কাছে পরাজয় স্বীকার করেই বসে আছেন- ‘ বঙ্কিম সাহিত্যে মুসলিম-বিদ্বেষ আছে! থাকিলই বা, তাহাতে কি আসিয়া যায়? তাহা অতি সামান্য বিষয়। রুশো, ভল্‌টেয়ারকে যেমন আমরা ক্ষমা করিয়াছি, বঙ্কিমকেও সেইরূপ ক্ষমা করিতে হইবে। কারণ বঙ্কিম-সাহিত্যের চারিদিকে হীরা জহরৎ এমনভাবে ছড়াইয়া আছে যে, তাহার প্রলোভনে সামান্য একটু কাদাময়লাকে ভয় করিলে চলিবে না (১৭) ।

বঙ্কিমে কাদাময়লা আছে, এই কথা বলে ফেলার পরে রেজাউল যদি আশা করেন তার সওয়াল জবাবে খুব একটা কাজ দেবে, তাহলে তাঁর সারল্যের প্রশংসাই করতে হয়। কিন্তু তাহলে সত্যিই কি বঙ্কিম সাহিত্যে মুসলমান বিদ্বেষের “কাদাময়লা” আছে ?

এই জাতীয় আরেকটা বক্তব্য রেখেছেন রেজাউল, এইবার আনন্দমঠের অন্তর্ভুক্ত বন্দেমাতরম সঙ্গীতের জাতীয় আন্দোলনের প্রতীকী স্লোগান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার প্রসঙ্গে – ‘ পারস্যের অমর কবি হাফেজ যখন তাঁহার অমর গ্রন্থের প্রথম একটি লাইন পাপাত্মা এসিজের কবিতা হইতে গ্রহণ করিয়াছিলেন, তখন অনেকেই তাহাতে রাগান্বিত হন। তদুত্তরে কবি বলেন, মুক্তা কুড়াইয়া লইতে হইলে স্থানের বিচার করিতে হয় না। আমরা ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত সম্বন্ধেও সেই কথাই বলিতে পারি ‘ (৬২)। মুক্তো যত্রতত্র থেকে কুড়িয়ে নিতে হবে, এটা এক লুণ্ঠক সভ্যতার আদর্শ মোটো হতেই পারে । কিন্তু বঙ্কিমের আনন্দমঠের সঙ্গে পাপাত্মা এজিদের তুলনা করে রেজাউল কাদের খুশি করতে চাইছিলেন, বুঝতে অসুবিধে হয় না। রেজাউল এভাবে আলগোছে বঙ্কিমের নিন্দা করে কাদের মন পেতে চাইছেন, কাদের তোষণ করছেন, সেটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়। তিনি বন্দেমাতরমকে ডিফেণ্ড করছেন শুধুমাত্র “অন্তর্নিহিত মাধুর্য্যের কারণে” (৬৩)। সেটাও অত্যন্ত ব্যতিক্রমী, যখন আমরা মনে রাখি যে বঙ্কিম, আনন্দমঠ, বন্দেমাতরম এগুলোর প্রতি একটা নিরবচ্ছিন্ন বিরোধিতা এসেছে মুসলমানদের মধ্য থেকে, বাংলার ভেতরে ও বাইরে।

রেজাউল কিন্তু এখানে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন । সেটা হল, মুসলমান শাসক, মুসলমান নবাব-বাদশাহ্‌দের বিরুদ্ধে লিখলে সেটাকে কোনও মতেই ইসলাম বিরোধিতা বলা যায় না । ‘ কেহ কি দেখাইতে পারিবেন যে, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার সমগ্র গ্রন্থে কোথাও ইস্‌লাম ধর্ম্মকে আক্রমণ করিয়াছেন? ইস্‌লামের শিক্ষা, সভ্যতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্ম্মগ্রন্থ – এ সকলকে কি তিনি কোথাও আক্রমণ করিয়াছেন? হজরত মহম্মদের প্রতি কি তিনি কোথাও অশ্রদ্ধার ভাব দেখাইয়াছেন? ইস্‌লামের রীতিনীতি, সৌন্দর্য্য প্রভৃতির প্রতি তিনি কি ব্যঙ্গোক্তি করিয়াছেন? তাহা যদি না করিয়া থাকেন, তবে তাঁহাকে ইস্‌লাম বিদ্বেষী অথবা মুসলমানের শত্রু মনে করিবার কোন কারণই থাকিতে পারে না। তিনি যদি কাহাকেও আক্রমণও করিয়া থাকেন, তবে তাহারা ত এক-একজন ব্যক্তি। ভারতে মুসলমান নৃপতিদের কয়েকজন, তাঁহাদের শাসন-পদ্ধতির কয়েকটি নীতি, সেনা-বিভাগের কয়েকজন কর্ম্মচারী, অথবা নবাব-বাদশাহ্‌দের কুমার-কুমারী – ইহারাই তাঁহার আক্রমণের বিষয়। ইহাদিগকে লইয়া কি সমস্ত ইস্‌লামের কাঠামো রচিত যে, ইহাদের সম্বন্ধে বিরুদ্ধ মন্তব্য প্রকাশ করিলেই লেখককে ইস্‌লাম-বিরোধী বলিতে হইবে ‘ ? (১৮)

রেজাউলের যুক্তি এক্ষেত্রে অকাট্য, যদিও বেশ ইন্টারেস্টিংভাবে এবার আর রসের যুক্তির অবতারণা করা হচ্ছে না। অর্থাৎ ইসলামের সমালোচনা বঙ্কিম যদি সত্যিই করে থাকতেন, তাহলে সম্ভবত রেজাউলও রসের কথা বলে বঙ্কিমকে ডিফেণ্ড করতেন না। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল, সত্যিই বঙ্কিমের কোনও লেখায়, কোথাও ইসলাম বিদ্বেষের বিন্দুমাত্র নমুনা নেই। আনন্দমঠ বা বঙ্কিমের অন্য যে কোনও লেখার বিরুদ্ধেই ইসলাম বিদ্বেষের অভিযোগ আনা যায় না ।

দ্বিতীয় একটা কথা বলছেন রেজাউল, যে মুসলমানদের প্রতি বঙ্কিমের কোনও “ব্যক্তিগত আক্রোশ” ছিল না (১৮) । আমরা এই প্রবন্ধে দেখব, এ কথাটাও সত্যি, এবং এর প্রমাণ আছে । রেজাউল আরেকটা কথা বলছেন- ‘ বন্দে মাতরম সঙ্গীতটি হিন্দুয়ানি প্রচারের জন্য নয়, দেশভক্তি প্রচারের জন্য লেখা। রেজাউল একজন মুসলমান হিসেবে লিখছেন যে তিনি দেশের বন্দনা করাকে পৌত্তলিকতা বলার বিরোধী : “’বন্দেমাতরমে’ কোনও দেবদেবীর পূজাও করা হয় নাই, অথবা তাহাদের স্তব-স্তূতিও করা হয় নাই। উহাতে দেশমাতৃকার বন্দনা করা হইয়াছে মাত্র। … ইহা ইস্‌লামের দৃষ্টিতে আদৌ নিন্দনীয় নহে ‘(৬২) ।

সমস্যা হল, ইসলামে শির্ক্‌ বিষয়টা সহ্য করা হয় না ( হয়ত আরও বেশ কিছু জিনিস সহ্য করা হয় না )। বন্দেমাতরমে শির্ক্‌ আছে, এটা একটা বড় অভিযোগ। করীম সরাসরি শির্কের উল্লেখ করেন নি, কিন্তু বিষয়টা ছুঁয়েছেন। বিষয়টা মোটামুটি এরকমঃ হিন্দুধর্মে বহুত্ববাদ স্বীকৃত, অনেকের পূজা করা যায়, না-ও করা যায়। কিন্তু ইসলামে আল্লা ছাড়া অন্য কারও পূজা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আল্লার সঙ্গে অন্য কোনও দেব-দেবীর পুজো করাকে বলা হয় শির্ক্‌।

‘মুসলমানকে বিশ্বের সর্বত্রই কেবল যদি আরবী ভাষা ব্যবহার করিতে হইত, তাহা হইলে শব্দ নির্ব্বাচনে এইরূপ কড়াকড়ি নিয়ম পালন করা সম্ভব হইত। কিন্তু বিভিন্ন দেশে গিয়া সে যখন তত্রত্য ভাষাকে নিজের ভাষা বলিয়া গ্রহণ করিল, তখন … মুসলমানকে ভাষার সেই দেশ-প্রচলিত বিধি মানিয়া চলিতে হইবে। উদাহরণস্বরূপ একটি শব্দের উল্লেখ করিতেছি। ‘পূজা’ কথাটা বাংলা ভাষায় নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়। … কিন্তু আরবী ভাষায় ঈশ্বর বা খোদাতালাকে পূজা করার অর্থে একটা বিশেষ শব্দ আছে, যাহা অন্য কাহারও জন্য ব্যবহৃত হয় না – সে শব্দটা হইতেছে ‘এবাদত্‌’। কোনও মানুষের ‘এবাদত্‌’ করা হয় না, ‘এবাদত্‌’ কেবল খোদার জন্য। প্রত্যেক হিন্দু সন্তান জানে যে, ঈশ্বরপূজা, দুর্গাপূজা, দেশপূজা, আর পিতৃপূজা এক বস্তু নয়, বা এক অর্থে ব্যবহৃত শব্দ নয়। এখানে একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। প্রত্যেক ইংরাজ সন্তান জানে যে, ঈশ্বরকে worship, আর রাজাকে worship এক বিষয় নহে। ফারসী ভাষায় বন্দেগী শব্দটাও ঠিক এই ধরণের। মুসলমান যখন বাংলা, ইংরাজী প্রভৃতি ভাষাকে মাতৃভাষা বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে, তখন সেই সব ভাষার বিধি-নিষেধ ও দোষগুণ সবই তাহাকে মানিতে হবে। … মাতাপিতা ও গুরুজনের পূজা কর – একথা যেমন সে ব্যবহার করিতে পারে, সেইরূপ ঈশ্বরের বা খোদাতালার পূজা কর, ইহাও তাহাকে বলিতে হইবে। এরূপ করিলে ইস্‌লামের দৃষ্টিতে সে পাপী বলিয়া বিবেচিত হইবে না ‘। (৬৯)

রেজাউল করীমের এই যুক্তি অকাট্য নয় । কারণ হিন্দুধর্মের বহুপূজক বা পলিথেইস্ট চরিত্রটি করীম সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছেন। বস্তুত, গুরু বা মাতাপিতাকে দেবতার মর্যাদা সরাসরি দেওয়া হয়ে থাকে। এবং দেবত্ব ওরকম কঠিন কঠোর বেড়াজালে আবদ্ধ নয় এই দেশের সংস্কৃতিতে, “প্রিয়েরে দেবতা করি, দেবতারে প্রিয়” হল আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। দেশমাতৃকার অবশ্যই দেবীজ্ঞানে পুজো হচ্ছে, এবং বঙ্কিম কোনও ‘সাম্প্রদায়িক’ অন্যায় করেন নি, তিনি এই প্রকৃতিপূজক দেশের আদি ঐতিহ্যকে সেলিব্রেট করেছেন, তার জন্য তাঁকে কৈফিয়ত দিতে হলে বড় অপমানজনক হয়। এই ভূমিতে মাতৃপূজার দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে, এর শেকড় সাংখ্যের পুরুষ প্রকৃতি দ্বৈতবাদে। যাই হোক, করীমও বলছেন, এ দেশের ভাষা (ধরে নিতে দোষ নেই যে ফরম্যালিস্ট বা স্ট্রাকচারালিস্ট অর্থে মাতৃপূজা একটি ভাষা বা রেজিস্টার) গ্রহণ করতে হবে মুসলমানকে। কিন্তু এক্ষেত্রে আরেকটা প্রশ্ন জাগে। করীম বলছেন যে মুসলমান যেখানকার অধিবাসী, তাকে সেই দেশের ভাষা গ্রহণ করতে হবে। এখন যদি কেউ একধাপ এগিয়ে বলেন, যে সেখানকার সংস্কৃতিও গ্রহণ করতে হবে (কারণ একটি জাতির সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে হয় একটি জাতির ভাষাকে গ্রহণ করতে গেলে, যেমন ইংল্যাণ্ডে বসে ইংরেজি ভাষাকে গ্রহণ করতে গেলে ইংরেজি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে হবে, নয়ত সে ভাষাটির সঠিক প্রয়োগ করাই যাবে না), তাহলে যে সমস্যার উৎপত্তি হবে, সেটাই তো ওয়াহাবি বা ফারাজি আন্দোলনের উত্থানের কারণ। অর্থাৎ ইসলাম আর বিশুদ্ধ থাকছে না, অতএব ইসলামের চ্যাম্পিয়ন ওয়াহাবি আবির্ভূত হচ্ছে, সমস্ত কাফের মিশ্রণ ও অশুদ্ধতা থেকে ইসলামের রক্ষার্থে। করীম এই জটিলতায় যান নি। কিন্তু একটি কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য দিয়েছেন। বন্দেমাতরম সঙ্গীতের সে যুগে প্রধান বিরোধী, মৌলানা আকরম খাঁ, যিনি সম্ভবত দেশকে মাতৃজ্ঞানে বন্দনা করাকে কাফিরি প্রথা বলে নিন্দামন্দ করে থাকতেন, সেই ব্যক্তি নিজেই তার একখানা কাব্যগ্রন্থ, ‘মোস্তাফা চরিত’-এ লিখেছেন ‘ধরিয়াছ বক্ষে মাগো, কার পদলেখা/ হে আরব, মানবের আদি মাতৃভূমি ‘ (করীম ৭০)। অর্থাৎ আরব দেশকে মাতৃজ্ঞানে পুজো চলতে পারে। বোঝাই যাচ্ছে, কোন ধরণের মানসিকতা কাজ করেছে বন্দেমাতরমের বিরোধিতায়।

আমাদের বিষয়ে আবার ফিরি। হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তকে যিনি সমদৃষ্টিতে দেখেন, তিনি আনন্দমঠে কেন “ভাই, ইংরাজ ভাঙিতেছে, এস আক্রমণ করি” পালটে “ভাই, নেড়ে ভাঙিতেছে, এস আক্রমণ করি” লিখেছিলেন, সেই ইতিহাসও মোটামুটিভাবে আমাদের জানা আছে। যখন রেজাউল করীম ওঁর বইটি লেখেন, তখনও সেটা দেখা যাচ্ছে কমন নলেজ ছিল, তাই রেজাউল বলছেন- মুসলমানদের উদ্দেশ্যে কথিত বাক্যগুলি বাহিরের আবরণ মাত্র – আইনের বেড়া -জাল হইতে পুস্তকটিকে বাঁচাইবার কৌশল মাত্র ‘ (৪৯)। এছাড়া, স্বদেশপ্রীতি বা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সরাসরি ইংরেজবিরোধিতার মাধ্যমে প্রচারিত হওয়া ছিল বেশ কঠিন, রেজাউল সেটাও আমাদের মনে করাচ্ছেন – পাঠকগণের হয়ত স্মরণ আছে যে, বহুদিন পর্য্যন্ত স্বর্গীয় গিরীশচন্দ্র ঘোষের সুপ্রসিদ্ধ নাটক ‘সিরাজদ্দৌলার’ অভিনয় বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। স্বর্গীয় সখারাম গণেশ দেউস্করের ‘দেশের কথা’ বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল। এই সেদিন পর্য্যন্ত শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ নিষিদ্ধ পুস্তকের মধ্যে গণ্য হইয়াছিল। এই সব কারণে একটু বুদ্ধিমান লেখকগণ এমন কৌশলে গ্রন্থ রচনা করিতেন যে তাহা সহজে আইনের ধারায় পড়িত না। স্বর্গীয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘মেবার পতন’, দুর্গাদাস’, ‘প্রতাপসিংহ’ এই শ্রেণীর গ্রন্থ। বঙ্কিমের লেখাও এই ধরণের ছিল। এই সব লেখক সাক্ষাৎভাবে আক্রমণ করিতেন মুসলিম যুগের অনাচারকে। সেই অনাচারের বিরুদ্ধে যাহারা লড়িত, তাহাদিগকেই “হিরো” করিয়া সমগ্র গ্রন্থ রচিত হইত। কিন্তু ইহাদের অন্তর্নিহিত ভাব ছিল স্বদেশপ্রীতির আদর্শ (৩৪)

এ বক্তব্য সারযুক্ত, যদিও বঙ্কিমের সঙ্গে তাঁর অনেক পরে আবির্ভূত সাহিত্যিক নাট্যকারদের তুলনা করা উচিত নয়, বঙ্কিমের সময়টা অন্যরকম ছিল, ইংরেজের প্রকাশ্য সমালোচনা বা স্বাধীনতার প্রকাশ্য ঘোষণা প্রায় অসম্ভব ছিল বলা যায়। কিন্তু বঙ্কিম সাক্ষাৎ ভাবে ইংরেজকে কিছু আক্রমণ করেছিলেন আনন্দমঠের প্রথম সংস্করণে, আমরা জানি। তাই আনন্দমঠ লেখার অব্যবহিত পরেই বঙ্কিমকে কলকাতা থেকে কটকে বদলি করে দেওয়া হয়, এবং এ ছিল ইংরেজের “অসন্তোষের” ফল , অমিত্রসূদন বলছেন বঙ্কিমচন্দ্রজীবনীতে (৬১৫)।

রেজাউল কিন্তু সেই অর্থে বঙ্কিমের আদর্শে দীক্ষিত, বা অগ্নিযুগের বিপ্লবী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন না। তার বইতে একজায়গায় তিনি লিখছেনঃ ‘ আজ রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী এবং জওহরলালকে দেখিয়া মনে হইতেছে, বঙ্কিমচন্দ্র কেন সেরূপ হন নাই ‘? (৩৫)। যখন দেখি এই বাক্য রচিত হয়েছিল ১৯৩৮ সালে , যে সময়ে সারা বাংলার সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষ এক হয়েছিল সুভাষের পেছনে, এবং সুভাষ কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন যেটা বোঝা যায়, রেজাউল বঙ্কিম সাহিত্যের একজন অনুরাগী এবং কংগ্রেসের সমর্থক হলেও বঙ্কিমের আদর্শের প্রতি সেভাবে সহমর্মী ছিলেন না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বাংলার মুসলমান লেখকদের মধ্যে আজ পর্যন্ত আবির্ভূত বঙ্কিমের সবথেকে বড় সমর্থকও বঙ্কিমের আদর্শ সম্পূর্ণ গ্রহণ করেন নি। কোথাও একটা সমস্যা আছে, কিন্তু সে সমস্যার জন্য বঙ্কিম দায়ী নন সম্ভবত।

শেষ বিচারে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী ।

আমরা এখন জানি যে বঙ্কিম এই উপন্যাসটি লিখে রাজরোষে পড়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ উৎস সন্ধানে বইটি আমাদের এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছে। এই উপন্যাসের প্রথম সংস্করণে একাধিক জায়গায় ইংরেজবিরোধিতা আছে বলেই তদানীন্তন ইংরেজ শাসক মনে করেছিল। এবং চিত্তরঞ্জন বলছেন, মারাঠি স্বাধীনতা সংগ্রামী বাসুদেব বলবন্ত ফাড়কের জীবন সম্পর্কে অবহিত হয়েই বঙ্কিম সন্তানদলের আদর্শটি অঙ্কন করেছিলেন, বস্তুত এটাই চিত্তরঞ্জনের বইটির প্রধান বক্তব্য। বঙ্কিমের চাকরি জীবন এই উপন্যাস লেখার ফলে পাকাপাকিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং তাকে কেশব সেনের কাছে ছুটতে হয়েছিল (কেশব সেন ইংরেজদের বিশেষ আস্থাভাজন ছিলেন, যেটা ইংরেজের চাকরি করেও বঙ্কিম কখনও হতে পারেন নি) এই মর্মে শংসাপত্র যোগাড় করতে যে উপন্যাসটি সত্যি সত্যি ইংরেজ শাসনের অবসান চেয়ে লিখিত নয়। শেষে কেশবের ভাই কৃষ্ণবিহারী সেন আনন্দমঠের প্রশংসামূলক একখানা রিভিউ করেন, এবং তাতে ইংরেজবিদ্বেষ নেই এই মর্মে সার্টিফিকেট দেন। তাই বঙ্কিম যখন রামকৃষ্ণের পরিহাস ‘ বঙ্কিম! তুমি আবার কার ভারে বাঁকা গো ‘? -এর উত্তরে বলেন ‘ ইংরেজের জুতোর চোটে ‘ (ভট্টাচার্য প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ ৩৪০-১), তার মর্মার্থ আমরা আনন্দমঠের প্রেক্ষিতে যেভাবে ফুটে উঠতে দেখি, অন্য কোনও উপন্যাসে সম্ভবত এতটা হয়নি। উপন্যাসটি পরবর্তী সংস্করণগুলি বিদেশী শাসকের জুতোর চোটে বেঁকে গেছে। এই উপন্যাসের জন্য বঙ্কিম চাকরি জীবনে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তার ডিমোশন ঘটেছে (অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির পদ হারিয়েছিলেন), এবং প্রচুর তিক্ততা নিয়ে চাকরি থেকে সময়ের আগেই অবসর নিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, বঙ্কিম নাকি এই উপন্যাসের সমাপ্তিতে ইংরেজের প্রতি রাজভক্তি দেখিয়েছেন, এ জাতীয় একটা কথা হাল্কা করে বাজারে চালু করেছেন কেউ কেউ। সপ্তডিঙা সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা বঙ্কিমকে বাঙালির বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের জনক হিসেবে তুলে ধরেছি, এবং সেই জাতীয়তাবাদকে পোজিট করেছি বাঙালির মধ্যে দীর্ঘ কম্প্রাদর আধিপত্যের বিরুদ্ধে, তখন কফি হাউস থেকে কিছু তাচ্ছিল্য শোনা গেছে, বঙ্কিম নিজেই তো কমপ্রাদর। ইংরেজের চাকরি করতেন। আনন্দমঠের শেষে ইংরেজ আনুগত্য দেখিয়েছেন। এইরকমভাবেই নানা কুযুক্তি বঙ্কিমের বিরুদ্ধে দেওয়া হয় (অর্থাৎ রামে না মারলেও রাবণে মারবে। মুসলমান বিদ্বেষ না থাকলে ইংরেজ আনুগত্য খুঁজে পাবেন এরা)।

মজার কথা হল, যে যুক্তিতে আনন্দমঠের শেষে ইংরেজের জয় দেখানো আছে বলে ওটি ইংরেজ অনুগত টেক্সট হয়ে যায়, ওই একই যুক্তিতে সীতারামের শেষে মোগলের জয় দেখানো হয়েছে বলে সেটিকে মুসলমান অনুগত টেক্সট বলা যায়। আসলে এই যুক্তিতে যেটা ধরা নেই সেটা হল ইতিহাসনির্ভর উপন্যাসে শেষটা কিরকম হবে সে ব্যাপারে ঔপন্যাসিকের হাত আগে থেকেই বাঁধা আছে, এক যদি না তিনি ম্যাজিক রিয়েলিজম জাতীয় কিছু একটা ডিভাইস ব্যবহার করেন। বঙ্কিমের সময়ে মধ্যগগনে ভিক্টোরিয়ান ধ্রুপদী রিয়েলিস্ট চিন্তাভাবনার সূর্য, সেযুগে ওইজাতীয় কিছু দেখানো সম্ভব ছিল না, যে এক অদ্ভুত ম্যাজিকের মাধ্যমে ইতিহাসই বদলে গেছে, এবং ভারতে ইংরেজ রাজত্বের বদলে সন্তান রাজত্বের স্থাপনা হয়েছে। আনন্দমঠের শেষে ইংরেজ জিতে যায়, কারণ ইতিহাসেও তারাই জিতেছিল।

হ্যাঁ, বঙ্কিম ইংরেজের চাকরি করতেন। কিন্তু এটাকে কনটেক্সটের বাইরে নিয়ে গিয়ে দেখাটা অত্যন্ত হাস্যকর। সেযুগে তার মত ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে অন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না। এবং এ দেশের ভাগ্য যে তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও স্বদেশের টানে ধরা দিয়েছিলেন। বস্তুত, শিক্ষিত বাঙালিকে সে যুগে অ্যাড্রেস করতে গেলে বঙ্কিমের মত প্রতিভারই প্রয়োজন ছিল, যিনি প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দুটি সভ্যতাকেই অধ্যয়ন করেছেন। ফলেন পরিচয়তে বলে একটা কথা আছে। বঙ্কিম কমপ্রাদর কি না, সে তার লেখা পড়লে, আর তার সাহিত্যের ফলাফল হিসেবে বিপ্লবী আন্দোলনের উত্থান বিচার করলেই জানা যাবে। বঙ্কিমের সমস্ত লেখা পড়ার পরে নিতান্তই গুণ্ডামি আর গা-জোয়ারি প্রয়োজন এ কথা বলার জন্য যে তিনি কম্প্রাদর ছিলেন। বরং ইংরেজের চাকরি করে বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানোর কাজটা কি অসামান্য কঠিন ছিল, তার লেখকজীবন সেটারই সাক্ষ্য দিচ্ছে ।

শেকসপিয়ারের লেখায় ইহুদী বিদ্বেষ পাওয়া যায় (মার্চেন্ট অভ ভেনিস, অবশ্য ইহুদীদের প্রতি সহানুভূতিও পাওয়া যায় ওই লেখাতেই), কিন্তু সেজন্য তার মুণ্ডুপাত করা হয় না, তার লেখাও জ্বালানো হয় নি। ইউরোপের বিখ্যাত লেখক এজরা পাউন্ড বা নুট হামসুন নাজি সিমপ্যাথাইজার ছিলেন। সেজন্য এদের লেখার বাপান্ত করা হয় না, বা তাদেরকে সাহিত্যসভা থেকে ঠেলে বের করে দেওয়ার অভিনব প্রস্তাব বিবেচিত হয় না পশ্চিমে। বঙ্কিম নাজি নন, ফ্যাসিস্ট নন। বঙ্কিমের চিন্তাভাবনা উদার, যুক্তির আস্তরণ তাঁর লেখার পরতে পরতে। বঙ্কিম নেহাতই বাঙালি জাতীয়তাবাদী, কিন্তু সেটুকুও, দুর্ভাগ্য এই জাতির, সেটুকু সহ্য করাও আমাদের লেফট লিবেরালদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলে যিনি বাঙালি আত্মপরিচয়ের হোতা, তাকেই এরা একযোগে উচ্ছেদ করতে ব্রতী হন।

তবে এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য, চিরাচরিতভাবেই রাবীন্দ্রিক। সাহিত্য থেকে লেখকের ব্যক্তিগত পছন্দকে নির্বাসন দেওয়া যায় না, বলছেন রবীন্দ্রনাথঃ “বঙ্কিমবাবুর মতো লেখকের গ্রন্থে মুসলমান বিদ্বেষের পরিচয় পাইলে দুঃখিত হইতে হয়, কিন্তু সাহিত্য হইতে ব্যক্তিগত সংস্কার সম্পূর্ণ দূর করা অসম্ভব। থ্যাকারের গ্রন্থে ফরাসি-বিদ্বেষ পদে পদে দেখা যায়, কিন্তু ইংরেজ সাহিত্যপ্রিয় ফরাসি পাঠক থ্যাকারের গ্রন্থকে নির্বাসিত করতে পারেন না। আইরিশদের প্রতি ইংরাজের বিরাগ অনেক ইংরাজ সুলেখকের গ্রন্থে পরিস্ফুট হইয়া উঠে” (অলোক রায় ১৮৫)। কিন্তু লেখকের বক্তব্যগুলো যে নিছক, নিতান্তই ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ থেকে উদ্ভূত, সেটা বলাটা অত্যন্ত অনৈতিহাসিক। লেখক হাওয়ায় বিচরণ করেন না। মজার ব্যাপার হল, এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আমাদের পশ্চিমবাংলায় আজও চলেছে বামপন্থার নামে। ফলে ব্যক্তি বঙ্কিমের মুণ্ডুপাত করেন দেবেশ রায়, বঙ্কিম সৃষ্ট সাহিত্য কেন সাবলীল লৌকিক নয়, কেন তা পশ্চিমী প্রভাব বহন করে, এই তার অভিযোগ। বঙ্কিমের ওপরে ভিক্টোরীয়, পশ্চিমী প্রভাব নিয়ে মূলত এই সমালোচনা। দেবেশ রায় বলেছেন – ‘ বাংলা উপন্যাসে সঞ্চারিত হয়নি লোকায়তের পৌরুষ, বাংলা উপন্যাসের কাহিনীতে আসেনি পুরাণ বা মিথ ভাষার লোকায়তিক পেশি, বাংলা উপন্যাসের সংলাপে আসেনি আমাদের প্রতি ক্রোশে আলাদা উপভাষার খর চলিষ্ণুতা ও ব্যঙ্গশেষরসিকতার মান ‘ । (অলোক রায় ১৮৮)। সে যুগে সাবলীল লৌকিক আর্ট ফর্ম কবিগান নিয়ে কাজ করেছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত, তিনি শেষ খাঁটি বাঙালি কবি ছিলেন, বঙ্কিম বলছেন। খাঁটি বাঙালি কবি আর জন্মাতে পারে না যে যুগে, সেই যুগের লেখক বঙ্কিম লৌকিক আর্ট ফর্ম নিয়ে কাজ করবেন কি ভাবে? বলা দরকার, দেবেশ রায়ের এই যে সমালোচনা, এও নেহাতই ব্যক্তির হুইম থেকে উদ্ভূত, এর পেছনে কোনও ইতিহাস পাঠ কাজ করছে না, এ হল ‘দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’ ধরণের সমালোচনা। এইজাতীয় বঙ্কিম সমালোচনা সুনীলও করেছেন। ১৯৭৮ সালে দেশ পত্রিকায় বঙ্কিমউপন্যাস পাঠের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া সুনীল ব্যক্ত করেছিলেন পর পর কয়েকটি সংখ্যায়। সুনীলের মনে হয়েছিল বঙ্কিমের কয়েকটি উপন্যাস নিছক মনোরঞ্জক, বাকিগুলি প্রচারধর্মিতায় ইতোভ্রষ্ট স্ততো নষ্টঃ ন পূর্বং ন পর। দুর্গেশনন্দিনী রূপকথা ছাড়া আর কিছু নয়, কপালকুণ্ডলায় মতিবিবির কাণ্ডকারখানা রোমাঞ্চকর, সেই সঙ্গে বিরক্তিকরও বটে – ‘এটি অত্যন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ ব্যর্থ বই।’ বঙ্কিমের উপন্যাসে লেখকের অভিজ্ঞতা ও সমকাল চেতনা নেই, এটাও অভিযোগের কারণ। ‘বঙ্কিমের ভাবমূর্তিতে কলঙ্ক লেপন করছি’ এমন অভিযোগে দেশ পত্রিকার কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিক লেখাটি মাঝপথে বন্ধ করে দেন। (অলোক রায় ১৮৮)

আসলে বঙ্কিমকে খুন না করলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে বন্দেমাতরমের অবদান মোছা যায় না, অগ্নিযুগকে স্মৃতি থেকে উপড়ে ফেলা যায় না। বন্দেমাতরম গানটি স্বাধীন ভারতের অ্যাডিশনাল জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে (এ এক অপূর্ব স্টেটাস)। জন গণ মন গানটির সঙ্গে তার একটা চিত্তাকর্ষক তুলনা করেছেন (সম্ভবত ইচ্ছাপূর্বক নয়, আনকনশাস ভাবেই করেছেন) অমিত্রসূদন – দেশের কোনো কোনো প্রান্ত থেকে বঙ্কিমচন্দ্রকে কখনো-কখনো ভুল বোঝার ইঙ্গিত লক্ষ করা যায়। সেটা দুর্ভাগ্যের। … যে বন্দেমাতরম্‌ সঙ্গীত সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সে তো দেশজননী দেশমাতৃকার বন্দনা। ভারতের ভাগ্যবিধাতা কে তা আমি জানি না; আমার মা-কে আমি জানি – আমার জন্মভূমিই আমার মাতৃভূমি – সন্তানের কাছে মায়ের চেয়ে বড়ো কে? ভারতবর্ষের প্রতিটি সন্তানের জননীই তো ভারতমাতা আমার মা-ই আমাদের দেশ, আমার দেশই আমার মা ‘। (প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ ৪৫৪)

অনস্বীকার্য, বন্দে মাতরম সঙ্গীতে একটা ধরা যায় ছোঁয়া যায় এরকম দেশপ্রেমের আবাহন আছে। জন গণ মন গানটি সেদিক থেকে সম্ভবত বন্দে মাতরমের কার্যকারিতা, জনপ্রিয়তা ও আবেদনের একশো মাইলের মধ্যে আসবে না। এ দুয়ের ফারাক আসলে সিভিক ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদেরই মধ্যেকার বিভাজন। নিরাকার পরমব্রহ্মের সঙ্গে এই হল মা দুর্গার পার্থক্য। এই সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে (অন্যথায় যিনি গোঁড়া রবীন্দ্রানুরাগী) অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। কিন্তু, এই যে ভুল বোঝার কথা বলা হচ্ছে, খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে বঙ্কিমকে ডিফেণ্ডরত সাহিত্যরসিকেরাই এই বিষয়ে ভুল বুঝছেন। রেজাউল করীমের লেখা পড়লে আমরা বুঝতে পারি, বঙ্কিমের বন্দেমাতরমের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ এটা ছিল না যে সেই গান হিন্দুয়ানির প্রচার করছিল। যারা বন্দেমাতরমের বিরোধিতা করেন আজও, গত একশো দশ বছর ধরে করছেন (বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময়েই প্রথম বন্দেমাতরম রাজনৈতিক স্লোগান হয়ে ওঠে, এবং সেইসময় থেকেই এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন শক্তিকে উস্কিয়ে দেওয়ার কাজটা শুরু হয়), তারা প্রাথমিকভাবে এজন্য করেন না, যে বন্দেমাতরম কাফের লেখকের লেখা, কাফের ধর্মের সঙ্গীত। বন্দেমাতরম বলা হচ্ছে, বন্দে দুর্গামাতরম তো বলা নেই। এই গানটির পরের স্তবকগুলোর কথা আলাদা (যেমন, “তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে”), সেখানে সরাসরি ধর্মীয় অনুষঙ্গ আছে, কিন্তু অমিত্রসূদন যেমন বলেছেন, অত বেশি বায়বীয় হতে গেলে গানটি দাঁড়াত না। বাংলার হিন্দু সংস্কৃতি সেযুগের জায়মান জাতীয়তাবাদের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। যারা এতে আপত্তি করেন, তারা ভুলে যান যে পাসপোর্ট জাতীয়তাবাদ, বা সিভিক জাতীয়তাবাদ দিয়ে স্বাধীন স্বাবলম্বী দেশের কাজ চলে গেলেও, পরাধীন দেশে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে তা নিতান্তই অকেজো। সেখানে একটা ঠাসবুনোট চাই। যাই হোক, কথাটা হল, বন্দেমাতরমের বিরুদ্ধে মূল আপত্তি অন্য জায়গায়। শির্ক, যে কথা আমি আগেই বলেছি। হিন্দু উপাসনার কথা বলা আছে এই গানে, অতএব আপত্তি, ব্যাপারটা তা নয়, কারণ সেভাবে হিন্দু উপাসনার কথা নেই, যদিও কাফেরধর্ম, বা বুতপরস্তি (পৌত্তলিকতা) অবশ্যই মেনে নেওয়া সম্ভব নয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পক্ষে। মেনে নিলে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিও বিধান আছে। কিন্তু তার থেকে বড় কথা হল, বন্দেমাতরম শব্দবন্ধেই রয়েছে শির্ক্‌। আল্লার কোনও অংশীদারী হয় না। সত্যিটা হল, দেশকে ইবাদত করা, বা এমনকি নিজের মা-কে ইবাদত করাটাও ইসলাম অনুযায়ী শির্ক্‌।

এই জায়গায় বঙ্কিম যদি ইসলামের দরবারে অপরাধ করেও থাকেন, আগেই বলেছি, সেজন্য তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটা অত্যন্ত অপমানজনক। তিনি স্বদেশকে মাতৃজ্ঞানে পুজো করেছেন, বেশ করেছেন। কিন্তু সেজন্য বলা যায় না তার মনে কোনও রকম ইসলাম বিদ্বেষ ছিল। ইসলাম অনুযায়ী তাঁর বিচার করা যায় না, কারণ তিনি মুসলমান নন, ইসলামের বিধিনিষেধ তাঁর ওপরে আরোপ করাটা অদ্ভুত। প্রকৃতপক্ষে, বঙ্কিমের মনে সমস্ত ধর্মের প্রতি একটা টিপিক্যাল ভারতীয় শ্রদ্ধা ছিল। তার প্রমাণ পাই সীতারামে।

আমরা সীতারামে এরকম দেখি –

উদ্‌ভ্রান্তচিত্তে সীতারাম কতকগুলি নীচ ব্যবসায়ী নীচাশয় অনুচরবর্গকে আদেশ করিলেন, “রাজ্যে যেখানে যেখানে যে সুন্দরী স্ত্রী আছে, আমার জন্য চিত্তবিশ্রামে লইয়া আইস।” তখন দলে দলে সেই পামরেরা চারি দিকে ছুটিল। যে অর্থের বশীভূতা, তাহাকে অর্থ দিয়া লইয়া আসিল। যে সাধ্বী, তাহাকে বলপূর্বক আনিতে লাগিল। রাজ্যে হাহাকারের উপরে আবার হাহাকার পড়িয়া গেল।
এই সকল দেখিয়া শুনিয়া চন্দ্রচূড় ঠাকুর এবার কাহাকে কিছু না বলিয়া তল্পি বাঁধিয়া মুটের মাথায় দিয়া তীর্থযাত্রা করিলেন। ইহজীবনে আর মহম্মদপুরে ফিরিলেন না ।
পথে যাইতে যাইতে চাঁদশাহ ফকিরের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। ফকির জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুরজি, কোথায় যাইতেছেন?”
চন্দ্র। কাশী। – আপনি কোথা যাইতেছেন ?
ফকির। মক্কা।
চন্দ্র। তীর্থযাত্রায়?
ফকির। যে দেশে হিন্দু আছে, সে দেশে আর থাকিব না। এই কথা সীতারাম শিখাইয়াছে। (বঙ্কিম ১, ৭৮৩ )

হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তদের কথা তো আদ্যোপান্ত ইকোনমিক কনটেক্সটে লেখা। সেখানে দুজন রায়তের কথা বলা হচ্ছে। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দুজনেরই শ্রেণী পরিচয় এক। সেটা থেকেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয় না যে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রশ্নে বঙ্কিম হিন্দু মুসলমানের পার্থক্য করতেন না। কিন্তু এই উপরের উদাহরণটি নিঃসন্দেহে বোঝাচ্ছে, বঙ্কিম মক্কা ও কাশীকে সমদৃষ্টিতে দেখছেন, তিনি চন্দ্রচূড় ঠাকুর এবং চাঁদশাহ ফকিরের প্রতি সমদর্শী। আধ্যাত্মিক বিষয়ে ভারতের এই সমদর্শিতার দীর্ঘ উত্তরাধিকার আছে। বস্তুত এ না হয়ে উপায় ছিল না, প্রাচীন কাল থেকে এদেশে বহু সংস্কৃতি, বহু ঈশ্বর, বহু সাধনাপদ্ধতি পাশাপাশি সহাবস্থান করে এসেছে। ইসলামকেও এর অংশ হিসেবেই স্থান দেওয়া হয়েছিল, রিচার্ড ঈটনের রাইজ অভ ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার বইটি এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য। বঙ্কিম সেই কারণেই মক্কা ও কাশীর ইকুইভ্যালেন্স ঘটিয়েছেন। সীতারামের রাজধানীর নাম ছিল মহম্মদপুর, সেও এইপ্রকার সংশ্লেষের উদাহরণ। তবে সেটা কিছুটা রাজনীতিও ছিল, একটা আনুগত্যের বার্তা ছিল মুসলমান বাদশার প্রতি ।

অমিত্রসূদন প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ -এ বলছেন- ‘ প্রচার ‘ পত্রিকায় তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস সীতারামে ফকিরের মুখ দিয়ে গল্পের নায়কের প্রতি বঙ্কিমের উক্তিঃ বাবা। শুনিতে পাই, তুমি হিন্দুরাজ্য স্থাপন করিতে আসিয়াছ, কিন্তু অত দেশাচারের বশীভূত হইলে, তোমার হিন্দুরাজ্য স্থাপন করা হইবে না। তুমি যদি হিন্দু-মুসলমান সমান না দেখ, তবে এই হিন্দু- মুসলমানের দেশে তুমি রাজ্য রক্ষা করিতে পারিবে না। তোমার রাজ্যও ধর্মরাজ্য না হইয়া পাপের রাজ্য হইবে। সেই একজনই হিন্দু-মুসলমানকে সৃষ্টি করিয়াছেন; … উভয়েই তাঁহার সন্তান; উভয়েই তোমার প্রজা হইবে। অতএব দেশাচারের বশীভূত হইয়া প্রভেদ করিও না। প্রজায় প্রজায় প্রভেদ পাপ। পাপের রাজ্য থাকে না। ‘ এমন উদারমনস্ক মুক্তমনা বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যস্রষ্টা যে-কোনো কালের পক্ষেই দুর্লভ । (৪৫৫)

অমিত্রসূদন যথার্থই বলছেন, বঙ্কিমের সীতারাম নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে, যে বঙ্কিমের মুসলমান বিদ্বেষের অভিযোগ মিথ্যা। তিনি বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কোনও পার্থক্য করতেন না। তার ক্ষোভ সমস্তটাই বিজাতীয়, বিদেশী মুসলমানের বিরুদ্ধে। এখানে দ্রষ্টব্য যে বঙ্কিম তার সমসাময়িক মুসলমানের সমালোচনা করেন নি, যদিও ওয়াহাবি আন্দোলনের দাপট তখন মাথাচাড়া দিয়েছে। ঈশ্বর গুপ্ত পূর্ববঙ্গ ভ্রমণ করেছিলেন বিস্তারিতভাবে, সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক হিসেবে। তিনি সমসাময়িক ওয়াহাবির উত্থান (তিতুমীরের পতনের পরে বাংলায় ওয়াহাবি আগ্রাসন পরিচালিত হয়েছে দুদু মিয়ার ফরাজীদলের দ্বারা, এবং তিতু যদিও পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় ছিলেন, অধিকতর সফল দুদু মিয়ার পুরো কাজটাই পূর্ববঙ্গে) সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, তাদের বিভিন্ন আক্রমণ, লুটপাট, অত্যাচার, নারী ধর্ষণ, বলপূর্বক ধর্মান্তর বিষয়ে জানতেন। বঙ্কিমের কোনও লেখায় আমরা সে প্রমাণ পাই না, সম্ভবত পূর্ববঙ্গে কখনও না যাওয়ার কারণে তিনি এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন না (যশোর খুলনা ঠিক পূর্ববঙ্গ নয়)। এটা আরও একটা কারণ, যে বঙ্কিম তার সমসাময়িক মুসলমানের, বা বাংলার দেশজ মুসলমানের প্রতি কোনও বিরূপ সমালোচনা করেন নি। বঙ্কিমের লেখায় যেগুলো মুসলমান বিদ্বেষের উদাহরণ হিসেবে খুঁজে বের করা হয়, সেগুলোর একটাও সমসাময়িক মুসলমানের বিষয়ে নয়। ওয়াহাবি, ফরাজী সম্পর্কে জানতে পারলে তিনি কি বলতেন, সেটা স্বতন্ত্র প্রশ্ন (বা হয়ত খবর পেলেও সেভাবে তার গুরুত্ব অনুধাবন করেন নি, আশ্চর্যের কিছু নয়, সেযুগে কেউই করেন নি)। কথা হল, বঙ্কিম যা বলেছেন সেগুলো সবই মধ্যযুগের মুসলমান সম্পর্কে। এবং তাদের প্রায় সবাই ব্যতিক্রমহীন ভাবে পাঠান মোগল, বা পাঠান মোগলের বংশধর দোয়াঁশলা মুসলমান। তারা যখন নঞর্থকভাবে চিত্রিত হয়, সেগুলোকে বিজাতীয় ভ্রাতৃগর্বে গর্বিত দেশজ মুসলমান অনেকটা “বাঁশ কেন ঝাড়ে, আয় আমার ঘাড়ে” বলেই নিজেদের গায়ের ওপরে নিয়ে ফেলেছেন।

কিন্তু অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য এই খুঁতটুকুও রাখতে রাজি নন। বঙ্কিম যে মোগলের প্রতিও এমনকি বিদ্বিষ্ট নন, সেটাও তিনি প্রমাণ করতে চান। “সংস্কার-মুক্ত চিন্তাধিনায়ক এই বঙ্কিমচন্দ্রই বলতে পারেন – ব্রাহ্মণ শাসিত প্রাচীন ভারতবর্ষ ছিল পরাধীন, আর মুঘল-সম্রাট-মহামতি-আকবরের রাজত্বকালই ছিল প্রকৃত স্বাধীন ভারতবর্ষ।” (প্রবন্ধ পঞ্চাশৎ ৪৫৫)। এখানে অমিত্রসূদনের বক্তব্যের ভিত্তি হল বঙ্কিমের প্রবন্ধ “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা”। অমিত্রসূদন এটাও বলে রেখেছেন – ‘ যদি হিন্দুর রাজত্বে (sic) দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক না হয় তবে সে রাজত্বের প্রতিষ্ঠা বঙ্কিমচন্দ্র চান না। যদি মুসলমানের রাজত্ব (sic) দেশ সুখী ও সমৃদ্ধ হয় তবে সেই রাজত্বকে সমাদরপূর্বক বরণ করে নিতেও বঙ্কিমচন্দ্র কিছু মাত্র দ্বিধা করেন না; আবার হিন্দু নয় মুসলমান নয়, ইংরেজের শাসনকার্যই যদি দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক হয় তো,(sic) তবে ইংরেজকেই দেশের রাজা করতে হবে বলে বঙ্কিম দাবি তোলেন ‘ (৪৫৪)।

এখানে কতগুলি কথা বলার আছে। এক, বঙ্কিম কিন্তু সেখানে ঠিক এইভাবে ব্রাহ্মণশাসিত ভারতের সঙ্গে আকবরের ভারতকে তুলনা করেন নি। বক্তব্যটা সেখানে এরকম। বঙ্কিম বলেছেন,‘ পরতন্ত্রতা মানেই পরাধীনতা নয়। “শাসনকর্ত্তা ভিন্ন জাতীয় হইলেই রাজ্য পরতন্ত্র হইল না। পক্ষান্তরে, শাসনকর্ত্তা স্বজাতীয় হইলেই রাজ্য যে স্বতন্ত্র হয় না, তাহারও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে ‘ (বঙ্কিম রচনাবলী ২, ২১৫)। এরপরে বলছেন, ‘ পরতন্ত্র রাজ্যকেও কখন স্বাধীন দেশ বলা যাইতে পারে। যথা, প্রথম জর্জের সময় হানোবর, মোগলদিগের সময়ে কাবুল। পক্ষান্তরে কখন স্বতন্ত্র রাজ্যকেও পরাধীন বলা যাইতে পারে; যথা নর্ম্মানদিগের সময়ে ইংলণ্ড, ঔরঞ্জেবের সময়ে ভারতবর্ষ। আমরা কুতুবউদ্দিনের অধীন উত্তর ভারতবর্ষকে পরতন্ত্র ও পরাধীন বলি, আক্‌বরের শাসিত ভারতবর্ষকে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বলি ‘ (বঙ্কিম রচনাবলী ২, ২১৫-১৬)। এখানে লক্ষ্যণীয়, আকবরের সঙ্গে প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্যশাসনের তুলনা তিনি করেন নি, করেছেন কুতুবউদ্দিন আইবকের সঙ্গে।

দুই, প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণশাসনের সঙ্গে বরং তুলনা হয়েছে আধুনিক ভারতের ইংরেজশাসনের। এবং সে তুলনায় উভয়েই তুল্যমূল্য। “ইংরেজের রাজ্যে যেমন ইংরেজ দেশী লোক কর্ত্তৃক দণ্ডিত হইতে পারে না, প্রাচীন ভারতেও সেইরূপ ব্রাহ্মণ শূদ্র কর্ত্তৃক দণ্ডিত হইতে হইতে পারিত না” (বঙ্কিম রচনাবলী ২, ২১৭)। হ্যাঁ, বঙ্কিম ব্রাহ্মণ শাসিত প্রাচীন ভারতের তুলনায় ইংরেজশাসিত ভারতে শূদ্রের অধিকার বেড়েছে সেটা বলছেন এই প্রবন্ধে, কিন্তু এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে এই মত তিনি পরিহার করেছিলেন এরপরে। হাসিম শেখ এবং রামা কৈবর্ত যে ইংরেজশাসনে ভালো নেই, সেটাই বঙ্কিমের সর্বশেষ মত বলে ধরতে হবে। বঙ্কিমের ওই “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা” প্রবন্ধে ইংরেজশাসনের প্রশংসা করার পেছনে অনেক মোটিভ কাজ করে থাকতে পারে, কিন্তু তাকে বঙ্কিমের অপরিণত মতামত বলে ধরলেই ভালো। তবে যাই হোক, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে বঙ্কিম যদি মুসলমান বিদ্বেষী হতেন, তবে আকবর সম্পর্কে এমন উচ্চপ্রশংসা করতেন না ।

বঙ্কিম অভিন্ন আইন চেয়েছিলেন, যখন বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ রদ করার জন্য শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্কিম বলছেন যে বাংলার অর্ধেক মুসলমান, সেক্ষেত্রে পুরুষের যদি বহুবিবাহ খারাপ হয়, সেজন্য নৈতিকতার যুক্তি দেওয়া হোক, হিন্দুশাস্ত্রের দোহাই কেন দেওয়া হবে? যদি আইন হয়, শুধু অর্ধেক জনসংখ্যার জন্য কেন হবে, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবার জন্য আইন হওয়া উচিত। বঙ্কিম এখানে আধুনিক আইন চাইছেন। দ্রুত একবার দেখে নেওয়া যাক, বিচারক বঙ্কিমচন্দ্র কোনওরকম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে ভুগতেন কি না। উল্টোটাই জানা যাচ্ছে গোপাল চন্দ্র রায়ের বঙ্কিমচন্দ্রের বিচারক জীবনের গল্প বইটিতে। বঙ্কিম যখন খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট, সেসময় চরডাকাতিয়া গ্রামের হিন্দু জমিদার রামসাগর সেন (প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন জমিদারের প্রতিভূ, জমিদার ছিলেন তার শ্যালক শিবশঙ্কর দাশগুপ্ত, যিনি গ্রামে থাকতেন না, বরিশাল শহরে মোক্তারি করতেন) পার্শ্ববর্তী গ্রাম চিতলমারির মুসলমান জমিদারের হাটে ডাকাতি করান। বঙ্কিম সেই হিন্দু জমিদারকে গ্রেফতার করেন (এর জন্য প্রচুর তল্লাশি চালাতে হয়েছিল কারণ তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন ), এবং দায়রায় সোপর্দ করেন (৯৪-৯৭)। রামসাগর সেন হাজতেই বিচারকালীন অবস্থায় মারা যান। শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করছেন, রহিম উল্লা নামক এক গ্রামবাসী যখন মরেল নামক কুখ্যাত নীলকর সাহেবের দলবলের হাতে নিহত হয়, বঙ্কিম তখন নিজে উদ্যোগ নিয়ে ঘটনার তদন্ত করেন, এবং দোষীদের সাজার ব্যবস্থা করেন (১২৪-৫)। খুলনার ঘটনা। এর জন্য বঙ্কিমের প্রাণসংশয় পর্যন্ত হয়েছিল, সে তথ্যও শচীশ দিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য, এই দুজন লেখকেরই কিন্তু কোনও দায় ছিল না বঙ্কিমের মুসলমান বিদ্বেষ অপ্রমাণ করার। এরা কেউই সেই সচেতন উদ্দেশ্য নিয়ে লেখেননি, বঙ্কিমের ডেপুটি জীবনের কাহিনী বর্ণনার সময়ে নিতান্তই ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট হিসেবে এই তথ্য পরিবেশন করেছেন।

মিথ ও মিথ্যার আবরণ সরালে দেখা যায়, বঙ্কিম মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন না। বঙ্কিম রাজসিংহ উপন্যাসে জানিয়েছিলেন – মুসলমান হলেই খারাপ হয় না, হিন্দু হলেই ভালো হয় না। পক্ষান্তরে, হিন্দু হলেই খারাপ হয় না, মুসলিম হলেই ভালো হয় না । আবার সীতারাম বঙ্কিমের এমন একটা উপন্যাস যেখানে বঙ্কিম দেখিয়েছেন, হিন্দুধর্ম সমস্ত আধ্যাত্মিকতাকেই সম্মান দেয়। সীতারাম গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে বঙ্কিম দেখিয়েছেন, মধ্যযুগের ইসলামিক শাসনের মধ্যে যে আগ্রাসী প্রবণতা ছিল, যে দর্প ছিল, তার বিরোধিতা করতে গিয়ে মুসলিম বিদ্বেষী বা ইসলাম বিদ্বেষী হওয়ার প্রয়োজন নেই।

বঙ্কিম শেষবিচারে বাঙালি জাতীয়তাবাদী । বহিরাগত, এলিট মুসলমান নিজেকে বাঙালি ভাবতে শুরুই করেছে অনেক পরে। বঙ্কিমের সমসাময়িক মুসলমান নিজেকে বাঙালি বলে ভাবত কি? রেজাউল করীম এই সময়ের শিক্ষিত মুসলমান সম্পর্কে বলছেন, ‘ সে উর্দ্দু-ফারসীর মোহ ত্যাগ করিতে পারে নাই। বাংলার মৃত্তিকায় সে তখনও আফগানিস্তানের পেস্তা-বাদামের চারা রোপণ করিবার কল্পনায় বিভোর ছিল ‘ (৩৮)। এই তথ্য যেন আমরা বিস্মৃত না হই ।

বঙ্কিম মুসলিম বিদ্বেষী নন, যদি এর এসেনশিয়ালিস্ট অর্থ করা হয়, অর্থাৎ যদি বলা হয় বঙ্কিম মুসলমান সত্তার বিরোধী, ব্যক্তি মুসলমানের বিরোধী, জন্মসূত্রে মুসলমান এমন সমস্ত ব্যক্তির বিরোধী। এ চূড়ান্ত অসত্য । বঙ্কিম সাহিত্যে যেখানে আপাত মুসলমান বিদ্বেষ আছে বলে মনে হয়, সেখানে মুসলমান হল আগ্রাসনের মেটাফর। অর্থাৎ বঙ্কিম রচনায় মুসলমানের উল্লেখ সর্বদাই কোয়ালিফায়েড, তার অনেকগুলি রাইডার আছে, তাকে কনটেক্সটের বাইরে বিচার করা অন্যায়। আবার বলি, বঙ্কিমের মুসলমান হল মধ্যযুগের মুসলমান। বঙ্কিম তার সমসাময়িক বঙ্গদেশের মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ দেখিয়েছেন, এ প্রমাণ বঙ্কিমের লেখা তন্ন তন্ন করে ঘেঁটেও কেউ খুঁজে পাবেন না। যেখানে বঙ্কিম গর্দভস্তোত্রে বলেন, তুমি কলিকালে বৃদ্ধ সেনরাজা, নয়ত বঙ্গদেশে মুসলমান কেন, এ মুসলমান তো স্পষ্টতই বখতিয়ার খিলজি এবং বখতিয়ার খিলজির লেগেসি। অলোক রায় উদ্ধৃত করছেন আহমদ শরীফের মতামত এই প্রসঙ্গে – ‘ মনে হয় বঙ্কিমচন্দ্রের কল্পিত ক্ষোভ ও নিন্দা বাস্তবেও মিথ্যে ছিল না। তুর্কী মুঘলের জ্ঞাতিত্ব-গর্বী দেশী মুসলমান অকারণে এ নিন্দা-গালি নিজেদের গায়ে মাখে ‘ (১৮৫)।

বঙ্কিমকেই, আমরা দেখছি, বারবার অন্যায় বিদ্বেষের শিকার হতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, বঙ্কিম স্বাধীনতাপূর্ব যুগে এক ত্রিফলা আক্রমণের চক্রব্যূহে অভিমন্যু হিসেবে প্রতীত হন। বঙ্কিমচন্দ্রকে ত্রিমুখী আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। হিন্দুয়ানির রক্ষাকর্তারা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে দেখেছেন অহিন্দু মনোভাবের প্রকাশ, ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমানেরা তাঁর উপন্যাসে দেখেছেন সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ অর্থাৎ মুসলমানবিদ্বেষ, আর শুদ্ধ-শিল্পের প্রবক্তারা সেখানে দেখেছেন নীতিধর্ম- সমাজধর্ম-হিন্দুধর্মের নির্দেশে শিল্পধর্ম বিসর্জনের প্রয়াস। ১৮৮৮ সালে সেখ আবদোস সোবহান হিন্দু মুসলমান নামে একটি বই লিখেছিলেন, যেখানে বঙ্কিম উপন্যাসে মুসলমান চরিত্রের বিকৃতিতে প্রথম ক্ষোভ প্রকাশ পায়। তার পর ইসমাইল হোসেন সিরাজী, সৈয়দ আবুল মোহাম্মদ, তসলিমুদ্দিন আহমদ্‌, আবুল কালাম মোহম্মদ শামসুদ্দীন, এস এম আকবর, ইমদাদুল হক, গোলাম মোস্তাফা প্রমুখ অনেক লেখক এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন (অলোক রায় ১৮৪)।

বঙ্কিমের মুসলমান বিদ্বেষ নিয়ে এর আগেও অনেক লেখা হয়েছে, এর পরেও হবে। অনেকে বঙ্কিমকে ডিফেণ্ড করবেন, অনেকে আক্রমণ করবেন। প্রশ্ন হল, অন্যান্যদের বঙ্কিম বিদ্বেষ নিয়ে কবে একটা কমপ্রিহেনসিভ কাজ হবে? স্মর্তব্য, “মুসলমান লেখকদের রচনায় বঙ্কিম-বিদ্বেষ সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত কম বেশি পরিমাণে বিদ্যমান” (রায় ১৮৫)। আর শুধু তো লেখকদের প্রশ্ন নয় এটা । সারা ভারতে মোট কতবার, কী কী পদ্ধতিতে বন্দেমাতরম গানে বাধা দেওয়া হয়েছে, সেই গানের সমালোচনা হয়েছে, কীরকম ভাষায় সমালোচনা হয়েছে ? কতবার আনন্দমঠের ও অন্যান্য বঙ্কিম উপন্যাসের নাট্যাভিনয় নিষিদ্ধ হয়েছে, ব্যহত হয়েছে ? আনন্দমঠ পোড়ানোও হয়েছে একাধিকবার, তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তো কেউ লিপিবদ্ধ করছেন না। বঙ্কিমের প্রতি বাকিদের বিদ্বেষ নিয়ে কিন্তু আলোচনা দরকার। অবশ্য সেটা এই প্রবন্ধের আওতার বাইরে।

বঙ্কিমের সবথেকে বেশি বিতর্কিত উপন্যাস আনন্দমঠ। এই উপন্যাস নিয়ে রেজাউল বলেছেন – ‘ আনন্দমঠ শুধু আনন্দ দেয় নাই, -দিয়াছে প্রাণ, দিয়াছে উৎসাহ, প্রাণের পরতে পরতে ছুটাইয়াছে আগুনের ফোয়ারা। প্রাণে জাগাইয়া দিয়াছে দেশাত্মবোধের মহান আদর্শ। দিশেহারা লোক পাইয়াছে একটা অবলম্বন -একটা আশ্রয়। সে আশ্রয় ও অবলম্বন পাইয়া হয়ত কেহ কেহ উদ্ভ্রান্ত হইয়াছে – হয়ত কেহ বিপথে চলিয়া গিয়াছে, -কিন্তু অধিকাংশ লোকই সত্যিকারের আদর্শ পাইয়াছে। ‘আনন্দমঠ’ না থাকিলে পরবর্তী যুগের কোন আন্দোলন (যেমন – স্বদেশী, হোমরুল, খেলাফত, অসহযোগ-সংগ্রাম) সার্থক ও পূর্ণ হইত না; গৌরবান্বিত স্বদেশীযুগের ইতিহাসও রচিত হইত না। স্বদেশী যুগ হইতে এ পর্যন্ত জাতীয় জাগরণের জন্য যে সব আন্দোলন হইয়াছে, ‘আনন্দমঠ’ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে তাহার সবটাতে অনুপ্রেরণা যোগাইয়াছে। স্বদেশী যুগে কোন আদর্শ বিবদমান ও কলহসর্বস্ব জাতিকে একত্র করিয়াছে ? দেশ আগে, তারপর সম্প্রদায় – এই ভাব কোন আদর্শ দেশবাসীর মনে জাগাইয়াছে? দেশে দেশে কোন পুস্তক আগুন ছুটাইয়াছে ? দিগ্বিদিকে ভারতের আশা আকাঙ্ক্ষার দাবী প্রচার করিয়াছে? বস্তুতঃ ‘আনন্দমঠের’ কল্যাণে ইহা সম্ভব হইয়াছে। ‘আনন্দমঠের’ সুমধুর ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনির তালে তালে জাতি ভেদাভেদ ভুলিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে কর্তব্যের আহ্বানে – দেশের উদ্ধারের কাজে। আসমুদ্র-হিমাচল প্রকম্পিত করিয়াছে অমর বঙ্কিমচন্দ্রের একটি মাত্র সঙ্গীত ‘বন্দেমাতরম ‘ । (৫২)

তাও বন্দেমাতরমকে একদল নিষিদ্ধ করবে, তাও আনন্দমঠ পোড়ানো চলবে । কলকাতায় আনন্দমঠ পোড়ানোর উৎসব করেছিল মুসলিম লিগ ১৯৩৮ সালে (জন্মশতবর্ষের উপহার হয়ত)। সে সম্পর্কে রেজাউল করীম বলছেন – ‘ সভ্য-জগৎ স্তম্ভিতচিত্তে দেখিল, ভারতের একটি সুবৃহৎ নগরে, বহু শিক্ষিত ও সাহিত্য সেবকের সম্মুখে ও সম্মতিক্রমে এমন একটি অনাচার হইয়া গেল, যাহা বর্বরতায় মধ্য-যুগের ধর্মান্ধ জ্ঞানবৈরীদের সমস্ত অত্যাচারকে ম্লান করিয়া দিল। সাহিত্য-সেবক, কবি ও লেখকগণ, সাহিত্যামোদী পাঠকগণ কিরূপ মত্ত উল্লাসে করতালি দিতে দিতে এই বহ্নি-উৎসব উপভোগ করিলেন, তাহা দেখিবার বস্তু বটে। ‘আনন্দমঠ’ সাজানো হইল, পরে তাহাতে অগ্নি-সংযোগ করা হইল – সেই অগ্নি বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল, আর তাহারই চারিদিকে কবি, লেখক, সাহিত্যিকগণ, আইন-সভার সদস্যগণ এবং মুসলিম বাংলার তরুণদলের প্রতিনিধিগণ আনন্দে করতালি দিতে দিতে সেই দৃশ্য পরম সন্তোষ ও তৃপ্তির সহিত উপভোগ করিলেন এবং কম্বুকণ্ঠে ঘোষণা করিলেন, মুসলিম-বাংলায় নবযুগ আসিয়াছে… ‘ (৫৩) ।

লেখক পরিচিতি – ডঃ তমাল দাশগুপ্ত । দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। সপ্তডিঙা পত্রিকা , জার্নাল অভ বেঙ্গলি স্টাডিজ ও মাৎস্যন্যায় ব্লগজাইন নামক তিনটি পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সপ্তডিঙা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান । নিজেকে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধানে নিবেদিত একজন ইতিহাস শ্রমিক ও ভাষাকৃষক হিসেবে পরিচয় দিতেই ভালবাসেন লেখক ।


তথ্যসূত্র –

  • চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিম রচনাবলী। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড। কলকাতাঃ রিফ্লেক্ট, ১৯৯৯
  • কর, শিশির। ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই। কলকাতাঃ আনন্দ, ২০১২
  • করীম, রেজাউল। বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ। কলকাতাঃ র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, ২০১৪
  • চট্টোপাধ্যায়, শচীশচন্দ্র। স্বর্গীয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবন চরিত। কলকাতাঃ ইউনিভার্সাল লাইব্রেরি, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ।
  • বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন। আনন্দ মঠঃ উৎস সন্ধানে। কলকাতাঃ আনন্দ, ১৯৮৩
  • ভট্টাচার্য, অমিত্রসূদন। প্রবন্ধ পঞ্চাশৎঃ বিষয় বঙ্কিমচন্দ্র। কলকাতাঃ প্রতিভাস, ২০১৪
  • বঙ্কিমজীবনী। কলকাতাঃ আনন্দ, ২০১২
  • রায়, অলোক। বঙ্কিম মনীষা। কলকাতাঃ এবং মুশায়েরা, ২০১৪
  • রায়, গোপালচন্দ্র। বঙ্কিমচন্দ্রের বিচারক জীবনের গল্প। কলকাতাঃ পারুল প্রকাশনী, ২০১২
  • রায়চৌধুরী, সত্যব্রত। “বঙ্কিমচন্দ্র ও জাতীয়তাবাদ”। জাতীয়তাবাদ ও বাঙালী চিন্তাবিদ। সম্পাঃ ডঃ সত্যব্রত রায়চৌধুরী ও ডঃ এ কে বসু। কলকাতাঃ সুজন পাবলিকেশন্স, ১৯৯৭। পৃঃ ৯-১৬।
  • Chatterjee, Bhabatosh (Ed). Bankimchandra Chatterjee: Essays in Perspective. New Delhi: Sahitya Akademi, 1994.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *