হাইলাইটস –
- ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সর্বশেষ ধাপে রয়েছে কিউবান ভ্যাকসিন আবদালা ।
- কিউবার মধ্যে ভ্যাকসিনটির প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে ।
- হু’র অনুমোদন পাওয়া মাত্রই আবদালার রপ্তানি আরম্ভ করবে কিউবা সরকার ।
- হাভানার ফিনলে ইনষ্টিটিউট ও সিআইজিবি’র বিজ্ঞানীরা ভ্যাকসিনটি আবিষ্কার করেছেন।
- দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পরপর তিনটি ডোজ নিতে হয় ভ্যাকসিনটির ।
বিশেষ প্রতিবেদন : ট্রায়াল পর্বে করোনা প্রতিরোধে শতকরা ৯২.২৮ শতাংশ সক্ষমতা প্রমাণ করে সবার তাক লাগিয়ে দিল কিউবান ভ্যাকসিন ‘ আবদালা ‘ । ভ্যাকসিনের এমন বিস্ময়কর কার্যকারিতা দেখে স্বাভাবিক ভাবেই উচ্ছ্বসিত কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ কানেল । হাভানার ফিনলে ভ্যাকসিন ইনষ্টিটিউট ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি কেন্দ্রের ( CIGB ) বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণার ফসল ‘ আবদালা ‘ । কিউবার বিজ্ঞানীদের তৈরি এই করোনা ভ্যাকসিনটি এখন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সর্বশেষ ধাপ গুলি পার করছে । ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে লাটিন আমেরিকার ছোট্ট সমাজতান্ত্রিক দেশ ‘ কিউবা ‘। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় অবস্থিত কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে ১৯৫৯ এর পয়লা জানুয়ারি সমাজতন্ত্র কায়েম হওয়ার পর থেকেই তা হোয়াইট হাউসের অস্বস্তির কারণ । কাস্ত্রোকে উৎখাত করতে ষাট বছর আগে কিউবাকে ঘিরে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করেছিল আমেরিকা । ২০১৬ র ২৫ নভেম্বর ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যু হয় । তার আগেই ২০১১য় সহযোদ্ধা ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে রাষ্ট্রের দায়িত্বভার তুলে দেন ফিদেল । এ’বছরের ১৯ এপ্রিল মিগুয়েল দিয়াজ কানেলের হাতে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব তুলে দিয়ে অবসরে গেছেন রাউলও । কিউবা থেকে কাস্ত্রো জামানার অবসান হলেও সমাজতান্ত্রিক কিউবার ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেয় নি আমেরিকা । মার্কিন অবরোধের জেরে অর্থনৈতিক ভাবে জীর্ণ হলেও কিউবার স্বাস্থ্য পরিষেবা সারা পৃথিবীর সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছে ।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকার চেয়ে নিজেরা গবেষণা করে এগিয়ে যাওয়াতেই বরাবর আগ্রহী কিউবা । কোভিড- নাইন্টিন অতিমারি প্রতিরোধেও চিন-রাশিয়া বা অন্য কোনও দেশের ভ্যাকসিনের অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই ভ্যাকসিন আবিষ্কারে আত্মনিয়োগ করেন কিউবার বিজ্ঞানীরা । নিজেদের বিজ্ঞানীদের ওপর ভরসা থাকায় প্রথম থেকেই বিদেশ থেকে ভ্যাকসিন আমদানির রাস্তায় হাঁটে নি কিউবা সরকার । এমনকি রাষ্ট্রসংঘের কোভ্যাক্স মিশনের সহায়তায় প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে হাভানা । কিউবার বিজ্ঞানীদের তৈরি প্রথম করোনা ভ্যাকসিনটির নাম ‘ সোবেরানা – টু ‘ । সংক্রমণ প্রতিরোধে এর কার্যকারিতা ৬২ শতাংশ । প্রথম ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সন্তোষজনক না হওয়ায় আরও কার্যকর টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করতে থাকে হাভানার ফিনলে ইনষ্টিটিউট ও সিআইজিবি’র গবেষকেরা । ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দ্বিতীয় ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ৯২ শতাংশের বেশি প্রমাণিত হওয়ায় কিউবার বিজ্ঞানীদের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে ।
করোনা প্রতিরোধে ৯২.২৮ শতাংশ কার্যকর কিউবার করোনা ভ্যাকসিনের নামের মধ্যেও থাকছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ল্যাটিন আমেরিকার ভূমিপুত্রদের প্রতিরোধের গন্ধ । কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নায়ক এবং জাতীয়বীর হোসে মার্তি ছিলেন একাধারে কবি , সাহিত্যিক ও দার্শনিক । হোসে মার্তির কাব্যের নায়কের নাম ‘ আবদালা ‘ । স্পেনীয় আগ্রাসনকারীদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে গুটিকয়েক যোদ্ধা ও সামান্য অস্ত্র সম্বল করেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বীর আবদালা । প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে সামান্য সরঞ্জাম নিয়েই দেশের বিজ্ঞানীরা করোনা প্রতিরোধী টিকা আবিষ্কারে সফল হওয়ায় কিউবা সরকার টিকারও নাম রেখেছে ‘ আবদালা ‘ ।
৯২ শতাংশের বেশি কার্যকর , এমন একটি দেশীয় ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য কিউবার জনগণ ধন্যবাদ দিচ্ছে গেরার্দো এনরিক গুইলেন নিয়েতো নামে এক বিজ্ঞানীকে । ইনি হাভানার জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি কেন্দ্রের ( CIGB) বায়ো মেডিকেল রিসার্চ ইউনিটের পরিচালক । দেশের মানুষকে করোনার হাত থেকে বাঁচাতে পারে এমন প্রতিষেধক আবিষ্কারের লক্ষ্যে দিনরাত টিম নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পড়েছিলেন ৫৬ বছরের গেরার্দো এনরিক গুইলেন নিয়েতো । সাধনা সফল হওয়ায় আজ জাতীয় নায়কের মর্যাদা পাচ্ছেন বিজ্ঞানী নিয়েতো । নিয়েতো ও তাঁর সহকর্মীদের রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে ইনষ্টিটিউটের পরীক্ষাগারে । এভাবেই কেটে গেছে দিনের পর দিন । মাসের পর মাস ঘরমুখো হন নি বিজ্ঞানীরা , মুখ দেখেন নি প্রিয়জনদের । আবদালার বিস্ময়কর সাফল্যের পর গেরার্দো এনরিক গুইলেন নিয়েতো বলেছেন , ‘ সফল যে হবোই এই আত্মবিশ্বাস শুরু থেকেই ছিল কিন্তু ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা যে এত ব্যাপক হবে তা ভাবতে পারি নি । ‘ এখনও পর্যন্ত ফাইজার ও মর্ডানার টিকার পর কিউবার টিকার কার্যকারিতাই ৯২ শতাংশের বেশি বলে ক্লিনিকাল ট্রায়ালে প্রমাণিত হয়েছে ।
কিউবান ভ্যাকসিন আবদালার তিনটি ডোজ নিতে হয় । ১৪ দিন পরপর ডোজ গুলি নিতে হবে । দেশের ভেতরে আবদালার প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছে কিউবা সরকার । ইতিমধ্যেই ২২ লক্ষ কিউবাবাসী প্রথম ডোজ পেয়ে গেছেন । ১৭ লক্ষকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে । ৯ লক্ষ মানুষকে তৃতীয় ডোজও দেওয়া হয়ে গেছে । আগামী আগষ্ট মাসের মধ্যে দেশের ৭০ শতাংশ নাগরিককে তিনটি ডোজ টিকা দিয়ে সম্পূর্ণ ভ্যাকসিনেট করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে কিউবা সরকার । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ( WHO ) অনুমোদনের জন্য আবেদন জানানোর আগে আবদালার কার্যকারিতা নিয়ে আরও একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা চালাতে চান কিউবার বিজ্ঞানীরা । আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই এই পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে । তারপরেই টিকাটিকে হুর অনুমোদনের জন্য আবেদন জানাবে কিউবা সরকার । হুর স্বীকৃতি পেয়ে গেলেই আবদালা রপ্তানি করার কাজ শুরু করবে কাস্ত্রোর দেশ । ভেনেজুয়েলা , মেক্সিকো , বলিভিয়া এবং আর্জেন্টিনা সহ ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ কিউবার এই ভ্যাকসিন পেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ।
Photo Credit – Twitter , Facebook and zawya.com .