উ ত্ত ম দে ব
ব্রিটিশদের সংসদীয় গণতন্ত্র মূলতঃ দল কেন্দ্রিক । তুলনায় মার্কিনিদের রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হলেও অনেক বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক । ভারত সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে গ্রহণ করলেও আমাদের রাজনীতিতে ব্যক্তি কেন্দ্রিক ঝোঁক বরাবরই প্রবল । কংগ্রেসকে ছাপিয়ে ব্যক্তি ইন্দিরার ইমেজ অনেক বড় হয়ে উঠেছিল । এবং একসময় এতটাই বড় হয়ে উঠেছিল যে দেবকান্ত বড়ুয়ার মতো স্তাবক কংগ্রেসিরা এটা পর্যন্ত ঢ্যাড়া পিটিয়ে বলতে সঙ্কোচ বোধ করত না যে,ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া , ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা । জয়ললিতা , এনটি রামারাও , বাল থ্যাকারে কিম্বা মায়াবতী – দল ব্যক্তিতে বিলীন হয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিই দল হয়ে ওঠার কাহিনী ভারতে নতুন নয় । নিঃসন্দেহে এঁদের সবাইকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । পশ্চিমবঙ্গে দল , সরকার এবং প্রশাসন যে বিন্দুটিতে এসে মিশে যায় তার নাম মমতা । এই মুহুর্তে ভারতবর্ষ তো বটেই দক্ষিণ এশিয়াতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমতুল্য একচ্ছত্র আধিপত্যের অধিকারী রাজনৈতিক নেতা বা কর্তৃত্ব দ্বিতীয়টি নেই ।
বাংলায় জনপ্রিয়তায় মমতার সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার মতো মুখ বিরোধী শিবিরে এখনও নেই । |
২০১৪ এবং ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনেও আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ধাঁচে দলকে ছাপিয়ে ব্যক্তির ইমেজ বড় হয়ে উঠেছিল ভারতে । সেই ইমেজের নাম নরেন্দ্র মোদী । সিপিএম , সিপিআইয়ের মতো বিজেপি দলটাও যৌথ নেতৃত্ব বা কালেক্টিভ লিডারশিপ দ্বারা পরিচালিত হয় । একটি রাজনৈতিক দলের যা যা বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত তা দেখা যায় সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শে বিশ্বাসী এই দুই শিবিরের মধ্যে । যদিও মোদী নামের ব্র্যান্ডভ্যালু রাজনীতির বাজারে যত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মোদীর আলোর ছটায় বিজেপি দলটা ততই ঢাকা পড়ে গেছে । মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় এই উচ্চ ও পরিকল্পিত রব শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদীকে নিজের দল এমনকি সরকারের চাইতেও অনেক বড় করে তুলেছে । নরেন্দ্র মোদী নিজেও বিষয়টি বেশ উপভোগ করেন এবং সংসদীয় ঘরানার চাইতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সুলভ নায়োকচিত হাবভাব , চালচলনেই অধিক স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন তিনি । নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর থেকে দিল্লি থেকে বাংলা – এমন কোনও ভোট নেই যেখানে মোদী নামক ব্র্যান্ডটিকে একটু সরিয়ে রেখে অন্য কোনও নেতাকে মুখ করে জেতার চেষ্টা করেছে বিজেপি । ব্যক্তির আধিপত্যকে সরিয়ে বিজেপিতে আবার যৌথ নেতৃত্বের যুগ আসবে কিনা তা ২০২৪ এর আগে বলা সম্ভব নয় । এই মুহুর্তে কোভিড সহ নানাবিধ কারণে দেশে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়লেও বিজেপির অভ্যন্তরে মোদী-শাহ রেজিম চব্বিশ পর্যন্ত আনচ্যালেঞ্জডই থাকবে । চব্বিশের লোকসভা নির্বাচন বিজেপি উতরে গেলে দলে মোদী-শাহর আধিপত্য বহাল থাকবে । আর মোদী ম্যাজিক ফ্লপ করে বিজেপি পরাজয়ের মুখ দেখলে সংঘ পরিবারে মোদী যুগের অবসান ঘটবে ।
বিজেপিতেও টিমকে ছাপিয়ে টিমের ক্যাপ্টের মুখ অনেক বড় হয়ে উঠেছে মোদী জামানায় । |
চব্বিশে মোদীর ফাঁড়া কাটবে কিনা তার উত্তর সময় দেবে । কিন্তু একুশের ফাঁড়া হেলায় পার করে দিয়ে দিদি যে শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হয়তো মমতা নিজেও ভাবেন নি দোসরা মে বিকেলে তাঁর জন্য এত বিপুল সাফল্য অপেক্ষা করবে । ৩৪টা বছর কঠোর দল নিয়ন্ত্রিত শাসনে থাকার পর পশ্চিমবঙ্গবাসীর সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । দুই হাজার এগারোর পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে শাসকদল , সরকার এবং প্রশাসনের এক ও অদ্বিতীয় উৎস ও অভিমুখ কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের একটি টালির ঘর । বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গে সরকার , প্রশাসন এমনকি জনজীবন পর্যন্ত চালিত হত বহু ধাপ বিশিষ্ট একটি পার্টি ব্যুরোক্রেসির কঠিন শৃঙ্খলের ভেতর দিয়ে । দশ বছর হল বাঙালির জীবন থেকে সেসব হ্যাপা চুকেবুকে গেছে । এখন বাঙালি জানে – আমার দিদি সব জানে । দিদিও জানেন – তিনিই সব জানেন । শাসন ব্যবস্থার ওপর মমতার সর্বব্যাপী কর্তৃত্ব দেখে তাঁকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত একজন সম্রাজ্ঞী বললেও বোধ হয় ভুল হবে না ।
বাম বিরোধী আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে ওঠার জন্য অনেক ঘাম ঝড়াতে হয়েছে মমতাকে । |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতি , বাচনভঙ্গি এবং সরকার পরিচালনার স্টাইল আপনার ভাল লাগুক আর নাই লাগুক আপনি মানতে বাধ্য তিনি ভুঁইফোড় কোনও নেতা নন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মমতা নামের ব্র্যান্ডভ্যালু একদিনে তৈরি হয় নি । বিরোধী নেত্রী হিসেবে মানুষের কাছে মমতার গ্রহণযোগ্যতার শুরু গত শতাব্দীর আশীর দশকের শেষ থেকেই । দীর্ঘ বাম আমলে এই জায়গাটা তিনি মুফতে পান নি । বাম বিরোধী আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে ওঠার জন্য মমতাকে অনেক ঘাম ঝড়াতে হয়েছে । দল এবং ব্যক্তি কে কাকে কখন কীভাবে ছাপিয়ে যায় এটা ইতিহাসের একটা বড় হেঁয়ালি বটে। কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসে হারিয়ে গেছেন দেশের অনেক ওজনদার নেতানেত্রী । মুখ নামিয়ে ফিরে এসেছেন দলে । শুধু কংগ্রেস বলে নয় , যে কোনও বড় দলের ছাতা ছেড়ে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ নিজের ইমেজের জোরে রাজনীতিতে আগের দাপট ধরে রাখতে পেরেছেন মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন নেতানেত্রী । সদ্য প্রয়াত গৌরী আম্মার মতো প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেত্রীও সিপিএম ছেড়ে এসে কেরলের রাজনীতিতে খুব বড় দাগ কাটতে পারেন নি । যে সামান্য ক’জন পেরেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক সফলতমের নাম নিঃসন্দেহে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেস ত্যাগ করার পর মমতা হারিয়ে যান নি বরং কংগ্রেসের জনভিত্তির প্রায় পুরোটাই আত্মসাৎ করে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাম বিরোধী রাজনীতির ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। রাজ্যপাট থেকে বাম সরলে বিকল্প মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিম্বা মমতাই বামেদের বিকল্প – বাংলায় এই পলিটিক্যাল ন্যারেটিভের জন্ম জ্যোতি বসু মহাকরণ ছাড়ার আগেই ।
এখন বাঙালি জানে – আমার দিদি সব জানে । দিদিও জানেন – তিনিই সব জানেন । শাসন ব্যবস্থার ওপর মমতার সর্বব্যাপী কর্তৃত্ব দেখে তাঁকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত একজন সম্রাজ্ঞী বললেও বোধ হয় ভুল হবে না ।
ফায়ারব্যান্ড বিরোধী নেত্রী মমতা দশ বছর হল ক্ষমতায় । আরও পাঁচ বছরের জন্য নবান্ন তাঁর আস্তানা । বিরোধী নেত্রী হন আর সরকার প্রধান – মমতার পলিটিক্যাল মেকানিজম সম্পূর্ণ তাঁর নিজের মতোন করে গড়েপিটে নেওয়া । তাঁর দলে তিনিই শেষ কথা । বিরোধীদের কটাক্ষ – তৃণমূলে একটাই পোস্ট , বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট । তৃণমূল কংগ্রেসে এটাই ঘোর বাস্তবতা । ইন্দিরা যখন কংগ্রেসের শেষ কথা তখন ইন্দিরাকেও পরামর্শ দেওয়ার দু’একজন লোক ছিল । মুকুল রায় দলত্যাগের পর মমতার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে দুটো পরামর্শ দেওয়ার মতো সাহস তৃণমূলে কারও নেই । এমনকি নেত্রীর ভ্রাতুষ্পুত্রেরও । একই কথা সরকার এবং প্রশাসনের ভেতরেও । কার বরাতে কোন মন্ত্রিত্ব জুটবে তা ঠিক করে দেওয়ার একমাত্র মালিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দফতর যাঁর যেমনই হোক মন্ত্রীদের হয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার শেষ পর্যন্ত মমতার । ক্যাবিনেটের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী যেমনটি চান , যেমনটি বলেন তার জবাবে স্কন্ধ ঝুঁকিয়ে সম্মতির বদলে ভিন্ন মত পোষণের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না তৃণমূল সরকারের মন্ত্রীরা । ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মতো দোর্দন্ড প্রতাপ মুখ্যমন্ত্রীর মুখের ওপরেও দ্বিমত পোষণ করতেন মুখ্যসচিব , স্বরাষ্ট্রসচিবেরা এবং তাঁদের পরামর্শ মেনে সিদ্ধান্ত বদল করতেও দ্বিধা করতেন না মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমলাদেরও দিদি । দিদির কানে অপ্রিয় শোনাবে এমন কোনও বাক্য ভুলেও যাতে স্বীয় জিহ্বা দিয়ে নির্গত না হয়ে পড়ে তার জন্য নিয়মিত কঠোর অনুশীলনের মধ্যে থাকতে হয় সচিবদের ।
মমতা নিজেও জানেন সামনে যারা বেড়াল আড়ালে ষড়যন্ত্রে তারা অপটু নয় । রাজনীতিতে সত্যিকারের আনুগত্য অতি দুর্লভ বস্তু। মমতার পর্যবেক্ষণ শক্তি প্রশ্নাতীত । দলে এবং সরকারে তাঁর নজর এড়িয়ে চলা মুশকিল । গণতন্ত্রে ক্ষমতাসীনদের জন্য জনগণের অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি মুড একটা বড় চ্যালেঞ্জ । দশ বছরে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধেও সঙ্গত নানা কারণেই একাধিকবার জন অসন্তোষ ধূমায়িত হয়েছে । প্রত্যেকবারই কোনও না কোনও কৌশলে জনগণের বিক্ষোভ-অসন্তোষ প্রশমনে সফল হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । এই ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহু ব্যবহৃত পদ্ধতি হল দলের থেকে নিজের ভাবমূর্তিকে বড় করে মানুষের সামনে প্রতিস্থাপিত করা । তাঁর এই ভাবমূর্তিটাকে জনগণ এখনও বিশ্বাস করে বলেই বারেবারে খাদের কিনারা থেকে জয়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ।
ষোলোর পরে একুশের ভোট কুরুক্ষেত্রেও তূণ থেকে মমতা শেষ পর্যন্ত যে ব্রহ্মাস্ত্রটি বের করে আনেন তার নাম – আমার দলকে খারাপ ভাবলেও আমাকে খারাপ ভেবো না , আমি তোমাদের সেই আগের মমতাই আছি । ২৯৪টি কেন্দ্রে আমিই প্রার্থী । তোমরা আমাকে দেখে ভোট দাও । পাঁচ বছর ধরে তৃণমূলের নেতাদের , তৃণমূলের সরকারকে তেড়ে গালমন্দ করার পরেও ভোটের মুখে মমতার কথায় বিশ্বাস করে বাংলার জনগণের বড় অংশ শেষ মুহুর্তে এই সিদ্ধান্তে আসে যে ,দলটা খারাপ হলেও মানুষটা খারাপ নয় , রাজ্য সামলাতে মানুষটার কোনও বিকল্প নেই । মমতা নামের ম্যাজিকটা এখানেই । মানুষের মনকে ভুলিয়ে দেওয়ার পরশমণি যতদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে থাকবে অথবা যতদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমতুল্য জনপ্রিয় নেতা বিরোধী শিবিরে উঠে না আসছে ততদিন নবান্ন থেকে হাওয়াই চটি পরিহিতাকে বিদায় করা খুব কঠিন । একুশে মোদী-শাহর নেতৃত্বাধীন বিজেপির সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে মমতা একা দলকে টানলেন না বলে বলা উচিত মমতা নিজেই নিজেকে টানলেন । দল গৌণ হয়ে গিয়ে দলের নেত্রীর মুখ্য হয়ে ওঠার রাজনীতি দেখল পশ্চিমবঙ্গ । রাজা চতুর্দশ লুইয়ের অনুকরণে মমতা যদি স্বকন্ঠে একদিন বলে ওঠেন আমিই পশ্চিমবঙ্গ – শুনে খুব অবাক হওয়ার কারণ আছে কি ?
Picture Credits – Mamata Banerjee official Facebook page , India Today.