বিশেষ প্রতিবেদন : আধা শতক আগেই যে মানুষটি গাছ কেটে হিমালয়কে ন্যাড়া বানিয়ে দেওয়ার পরিণতি সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন কোভিড তাঁর প্রাণ কাড়ল ৯৪ বছর বয়সে । এতক্ষণে দেশশুদ্ধ লোক জেনে গেছে সুন্দরলাল বহুগুণা প্রয়াত । তিনি বেঁচে আছেন কিনা সেটাই যখন ভুলতে বসেছিলাম তখন সুন্দরলাল বহুগুণা মরে জানিয়ে গেলেন তিনি বেঁচেই ছিলেন । তাঁর প্রাণের হিমালয় জুড়ে এখন উন্নয়নের অট্টহাসি । প্রাণপ্রবাহিনী অলকানন্দা , মন্দাকিনী , ধৌলিগঙ্গা , ঋষিগঙ্গা , ভাগীরথী নদীর বক্ষ জুড়ে এখন অজস্র ক্ষত । শতশত বছর যে জনপদ গুলি গাঢ় সবুজ আচ্ছাদিত দুর্গম হিমালয়ের বুকে মুখ গুঁজে শিশুর মতো লুকিয়ে ছিল সেই সব নির্জন জনপদ এখন জনারণ্য কংক্রিটের জঙ্গল ।
মানুষটির কাছে হিমালয়ই ছিল পিতা। মাতা অবশ্যই গঙ্গা । যৌবনের প্রারম্ভ থেকে বানপ্রস্থে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত পিতা-মাতার সেবায় চেষ্টার ত্রুটি রাখেন নি মানুষটি । সন্তানের চোখের সামনেই তেহেরি গড়োয়ালে মায়ের বক্ষ বিদীর্ণ হল ! ১৯৮০তে বাঁধ নির্মাণের তোড়জোর শুরু হতেই রাষ্ট্র , সরকার , প্রশাসন আর উন্নয়ন লবির বিশাল বুলডোজারের সামনে মাকে রক্ষা করতে দু বাহু বাড়িয়ে রুখে দাঁড়ালেন তিনি । ততদিন চিপকো আন্দোলনের সুবাদে মাথায় সাদা ফেট্টি , মুখ ভরা দাড়ি , ক্ষুদে দুই চোখের খর্বাকৃতি মানুষটি বেশ বিখ্যাত । তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে সারা দেশ থেকে তেহেরিতে ছুটে এলেন সেই মানুষেরা , যাঁদের বিশ্বাস উন্নয়নের হাড়িকাঠে পরিবেশকে বলি চড়ানো প্রকৃতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা । ১৯৮০ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত নিজের গ্রামে মাটি কামড়ে পড়ে থেকেও সুন্দরলাল বহুগুণা নামের কিংবদন্তি সম মানুষটি কিন্তু পারলেন না তেহেরি ড্যামের নির্মাণ থেকে শাসকগোষ্ঠীকে পিছু হটাতে । দীর্ঘ চব্বিশ বছরের সংগ্রামে বাঁধের নির্মাণ বন্ধ করতে দু’দফায় মোট ১১৯ দিন অনশনে ছিলেন এই গান্ধিবাদী নেতা । ২০০১ সালে তাঁকে গ্রেফতার পর্যন্ত করে সরকার । বাঁধের কারণে এক লক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাকে বাস্তুচ্যুত হতে হয় । শেষ পর্যন্ত একই পরিণতি বরণ করতে বাধ্য হন সুন্দরলাল বহুগুণাও । তেহেরি বাঁধের সুবিশাল জলাধার পূর্ণ হয়ে উঠলে ২০০৪ এর ৩১ জুলাই বরাবরের মতো মারোদা গ্রামে নিজের জন্মভিটা ত্যাগ করে কোটিতে চলে যান তিনি ।
২৪ বছর মাটি কামড়ে লড়েও তেহেরি ড্যাম প্রকল্প থেকে সরকারকে টলাতে পারেন নি সুন্দরলাল বহুগুণা । |
চিপকো মানে জড়িয়ে ধরা । গাছকে জড়িয়ে ধরে কুড়োলের আঘাত থেকে বাঁচাতেন গাড়োয়াল কন্যারা । |
নিজের সংস্কার, অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ থেকে সুন্দরলাল বহুগুণা এই প্রতীতিতে উপনীত হয়েছিলেন, হিমালয়ের বাসিন্দাদের চাষাবাদ , উপার্জন , সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতির সঙ্গে জঙ্গল ও নদী জড়িয়ে আছে । পরিবেশ থেকে হিমালয়ের মানুষকে ছিন্ন করতে গেলে তাদের আর্থ-সামাজিক জীবনে বিপর্যয়টা হবে সুদূরপ্রসারী । বাস্তুতন্ত্র নির্ভর যে জীবনধারার জন্য জীবনব্যাপী সংগ্রাম করেছেন সুন্দরলাল বহুগুণা , সরকারের শাসন প্রক্রিয়ায় তা উপেক্ষিত । সুন্দরলাল বহুগুণার দর্শনকে উপেক্ষা করার অর্থ প্রকৃতিকে উপেক্ষা করা । হিমালয় জুড়ে জনপদে জনপদে যে উন্নয়নযজ্ঞ অব্যাহত তাতে প্রতিদিন আহত হচ্ছে প্রকৃতি । আহত প্রকৃতির পাল্টা রোষে গাড়োয়াল হিমালয় যে ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত নেই । কেদারনাথের বিধ্বংসী বন্যা থেকে চামোলি বিপর্যয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে – কানে তুলো গুঁজে বহুগুণার বাণীকে উপেক্ষা করতে থাকলে চড়া মাশুল দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের ।
Picture Credits – Twitter , India Today.