উত্তম দেব
পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন পর্ব মেটার আগেই ফের করোনার জেরে নাকাল দেশ । একে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ বলছেন বিশেষজ্ঞরা । হু হু করে সংক্রমণ বাড়ছে । আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দুটোর গ্রাফই প্রতিদিন আগের দিনেরটাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে । গতবছর মার্চে কোভিড নাইন্টিন ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরে কখনও তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি । তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে সংক্রমণের সূচকটি নামতে নামতে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে দু’একটি রাজ্য বাদ দিলে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছিল । এই করোনাকালেই ( ২৮ অক্টোবর ২০২০ থেকে ৭ নভেম্বর , ২০২০) মাত্র তিন দফাতে বেশ নির্ঝঞ্জাটেই বিধানসভা নির্বাচন সেরে ফেলে গোটা দেশে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিহার । লালু পুত্রের নেতৃত্বে মহাগোঠ বন্ধন বনাম নীতিশকুমারের নেতৃত্বে জেডিইউ-বিজেপি জোটের কাটে কা টক্করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভোটে টানটান উত্তেজনা থাকলেও বিস্ময়কর ভাবে বিহারের ভোটে একটি মানুষেরও অপঘাতে মৃত্যু হয় নি । এই বিহারকে নিয়ে , বিহারিদের নিয়ে একসময় কম ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ , তাচ্ছিল্য করি নি আমরা বাঙালিরা ।
পশ্চিমবঙ্গ সহ চার রাজ্য ও এক কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের ভোটের নির্ঘন্ট যখন নির্বাচন কমিশন তৈরি করছিল তখনও দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিল। পশ্চিমবঙ্গে তো অনেক কোভিড হাসপাতালের দরজায় তালা পর্যন্ত পড়ে গিয়েছিল । নির্বাচনের দিনক্ষণ যখন কমিশন ঘোষণা করল তখন দেখা গেল কেরল , তামিলনাড়ু এবং পন্ডিচেরিতে এক দফাতেই ভোট । আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য অসমে তিনদফায় আর আমাদের রাজ্যে ভোট আট দফা পর্যন্ত । আজকে ১৬ এপ্রিল । ১০ দিন আগেই বাকি তিনটি রাজ্য ও একটি কেন্দ্রে শাসিত অঞ্চলের ভোট পর্ব চুকেবুকে গেছে। তাদের ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিট গুলো এখন স্ট্রংরুমে বন্দী । শুধু মাত্র পশ্চিমবঙ্গের ভোটের জন্য এই চার বিধানসভার গণনা প্রায় একমাস ঝুলে থাকবে ।
ভোটের দিন ঘোষণার তিনমাস আগে থাকতেই পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলের নেতারা নির্বাচন কমিশনে ধর্না দেওয়া শুরু করেছিলেন যে তিনটি মূল দাবি নিয়ে তার প্রথমটি প্রত্যেকটি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাই । দ্বিতীয়টি নির্বাচনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা থেকে রাজ্য পুলিশকে সম্পূর্ণ দূরে রাখা । কারণ রাজ্যের পুলিশ নিরপেক্ষ নয় । তৃতীয়টি বাংলায় এক-দুই-তিন দফায় অবাধ ভোট কদাচ সম্ভব নয় । আট-দশ দফায় ভোট চাই । লক্ষ্যনীয় বিষয় হল পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আর কোনও রাজ্যের বিরোধীরা উপরোক্ত তিনটি দাবিতে কমিশনের দ্বারস্থ হয় নি । ভোট নিয়ে শাসক বিরোধী চাপান-উতর কম-বেশি সব রাজ্যেই থাকে । কিন্তু নিজের রাজ্যের প্রশাসন , পুলিশ ও শাসকদলের প্রতি এত তীব্র অবিশ্বাস , ঘৃণা ও ভয় বাংলা ছাড়া আর কোনও রাজ্যের রাজনীতিতেই দেখা যায় না । এমনকি বিহার-ইউপিতেও নয় । বারেবারেই এই দুই রাজ্যের তুলনা টানতে হচ্ছে কারণ গোবলয়ের নাম কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্রই ইন্টেলেকচুয়াল বাঙালির নাসিকা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কুঞ্চিত হইয়া উঠে।
পঞ্চায়েত ভোটে হিংসার খন্ডচিত্র : হিংসার ভাইরাস বঙ্গ রাজনীতির ডিএনএ তে । |
ধরুন যদি অসম , কেরল , তামিলনাড়ুর বিরোধী দল গুলিও প্রতিটি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন , রাজ্য পুলিশকে বুথের ধারেকাছে ঘেঁষতে না দেওয়া এবং সাতআট দফা ভোটের দাবি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ সৃষ্টি করত তাহলে কমিশনের পক্ষে তো বিরোধীদের দাবি অগ্রাহ্য করা সম্ভব হতো না । কারণ নির্বাচনকে বিরোধীপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত । ভাগ্যিস অসম , কেরল , তামিলনাড়ু থেকে এমন দাবি উত্থাপিত হয় নি । হলে নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকরা চোখে সর্ষেফুল দেখতেন । পশ্চিমবঙ্গে এখন যেভাবে ভোট হয় এটাই যদি গোটা দেশে ভোটের রেওয়াজ হয়ে ওঠে তবে ভোট প্রক্রিয়া একবার শুরু হলে ছয়মাসের আগে শেষ হত না । কেননা একাধিক রাজ্যের প্রতিটি আসনের প্রতিটি বুথে একই দিনে সম সংখ্যক আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ান মোতায়েন করা কোনও মতেই সম্ভব নয় ।
আজকে পশ্চিমবঙ্গের মাসব্যাপী ভোট পর্ব মিটতে না মিটতেই কোভিডের সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেল । ২৭ মার্চ প্রথম দফায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছিল । শেষ তথা অষ্টম দফা ভোট গ্রহণের তারিখ ২৯ এপ্রিল । আগামীকাল পঞ্চম দফায় ৪৫ টি আসনে ভোট । এরপরেও আরও তিনদফায় ১১৪টি আসনে ভোট নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে । এদিকে রাজ্যে করোনা সংক্রমণের হার ১৬ শতাংশে পৌঁছেছে । দৈনিক গড়ে ৭০০০ করে মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছেন । বেশ কয়েকজন প্রার্থী করোনা সংক্রমিত । একজন মারাও গিয়েছেন । ভোটের প্রচারে দেখলে অবশ্য মনে হয় না বাংলায় করোনা বলে কিছু আছে । রাজ্য জুড়ে সব রাজনৈতিক দলেরই বিশাল বিশাল সভা-সমাবেশ , রোড শো চলছে । কাতারে কাতারে কর্মী-সমর্থকেরা দূরত্ব বিধির পরোয়া না করে সেই সব কর্মসূচিতে সামিল হচ্ছেন। কিন্তু মানুষ ভোটের উত্তেজনায় করোনাকে ভুলে গেলে কি হবে করোনা তো মানুষকে ভুলে যায় নি । তাই রাজনৈতিক সমাবেশ গুলির অনিয়ন্ত্রিত ভিড় করোনাকে ভালোই খোরাক জোগাচ্ছে । রোজই শোনা যাচ্ছে অমুক নেতা – তমুক নেত্রী করোনা পজিটিভ ।
বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানের উপস্থিতি বাংলার শান্তিপূর্ণ নাগরিকদের ভরসা জোগায় । |
করোনার বাড়াবাড়ি শুরু হওয়ায় তিন দফার ভোট একদফায় করতে কমিশনের দাবি জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । |
ইতিমধ্যেই তিন দফার ভোট গ্রহণ একদিনে সেরে ফেলার দাবি তুলেছে তৃণমূল । খোদ মুখ্যমন্ত্রী ট্যুইট করে এই দাবি উত্থাপন করেছেন । কিন্তু ১১৪ টি বিধানসভা কেন্দ্রের সব বুথে একদিনে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন সম্ভব নয়। বহুদফায় ভোট করার একটাই কারণ , যাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের স্থান থেকে স্থানান্তরে নিয়ে গিয়ে ভোটের নিরাপত্তায় লাগানো যায় । পঞ্চম দফার ভোটে মোতায়েন করা হচ্ছে ৮৫৩ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। ষষ্ঠ দফার জন্য ৯২৪ , সপ্তমে ৭৯১ এবং শেষ তথা অষ্টম দফায় ৭৪৬ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। যে তিন দফার ভোট একদিনে সেরে ফেলতে মমতার আকুলতা সেই তিন দফার জন্য প্রয়োজন ২৪৬১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। পুরো ভোট প্রক্রিয়া সামাল দেওয়ার জন্য রাজ্যে আনা হয়েছে ১০৭১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। একদিনে ভোট করতে চাইলে অতিরিক্ত ১৪০০ কোম্পানি কোথা থেকে আসবে ?
বাংলার নির্বাচন ঘিরে এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে ? কেন লক্ষাধিক আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েনের পরেও নির্বাচন ঘিরে অশান্তি-রক্তপাত বন্ধ করা যায় না ? কেন প্রত্যেকটি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রত্যেকটি বুথেই সশস্ত্র জওয়ান মোতায়েন না করলে ভোট গ্রহণই সম্ভব নয় ? কেন রাজ্য পুলিশের পাহারায় বুথে বুথে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট সম্ভব নয় ? এই সমস্ত প্রশ্নের সদুত্তর না মেলা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের ভোট ঘিরে প্রাণ , অর্থ এবং সময়ের অপচয় চলতেই থাকবে ।
একটি কোম্পানিতে সাধারণত ১২০জন করে জওয়ান থাকে । ১০৭১ কোম্পানি মানে ১ লক্ষ ২৮ হাজার ৫২০ জন জওয়ান । কোনও বৈদেশিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয় । ভয়ঙ্কর কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযানও নয় । কোনও গৃহযুদ্ধ সামাল দেওয়ারও ব্যাপার নয় । স্রেফ একটি রাজ্যের বিধানসভা ভোট পরিচালনা করতে কি শেষে পাঁচ লক্ষ জওয়ান মোতায়েন করতে হবে ? রাজ্য প্রশাসনের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কি কেউ এই প্রশ্নটা করবেন যে নিজের রাজ্যের পুলিশ , নিজের রাজ্যের প্রশাসনের ওপর আমাদের এতটা অনাস্থার কারণ কী ? রাজ্যের পুলিশও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে সক্ষম এই বিশ্বাসটাই তো মানুষের উঠে গেছে । আজকে পশ্চিমবঙ্গে শাসকদল তৃণমূল বাদে প্রতিটি বিরোধী দলের একটিই দাবি – প্রত্যেকটি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন । রাজ্য পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ভোট করানোর কথা উঠলেই বিরোধীরা ২০১৮ র পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে আনে । পশ্চিমবঙ্গ থেকে দাবি না উঠলে তো আর যেচে শত শত কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী ভিন রাজ্য থেকে ডেকে আনত না নির্বাচন কমিশন। বিধানসভা নির্বাচনে বাহিনী মোতায়েনের খরচ তো রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকেই যায় । অর্থাৎ রাজ্যের জনগণের পকেট থেকে যায় । শুধু নিরাপত্তা সংক্রান্ত কড়াকড়ি করতেই ভোটে অতিরিক্ত কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয় প্রশাসনের ।
বঙ্গভোটের ভাইরাল ছবি : একটি স্থির ছবিই যখন অনেক কথা বলে দেয় । |
বাংলার নির্বাচন ঘিরে এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে ? কেন লক্ষাধিক আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েনের পরেও নির্বাচন ঘিরে অশান্তি-রক্তপাত বন্ধ করা যায় না ? কেন প্রত্যেকটি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রত্যেকটি বুথেই সশস্ত্র জওয়ান মোতায়েন না করলে ভোট গ্রহণই সম্ভব নয় ? কেন রাজ্য পুলিশের পাহাড়ায় বুথে বুথে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট সম্ভব নয় ? এই সমস্ত প্রশ্নের সদুত্তর না মেলা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের ভোট ঘিরে প্রাণ , অর্থ এবং সময়ের অপচয় চলতেই থাকবে । শাসকদল কোন অভিপ্রায় চরিতার্থ করতে তিনদফার ভোট একদফাতেই চাইছে তা বোঝার মতো বুদ্ধি নির্বাচন কমিশনারদের আছে । পশ্চিমবঙ্গে ভোটে নিরাপত্তায় একটু শৈথিল্য প্রদর্শনের অর্থই হল দশটি প্রাণ অকালে ঝড়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া । এখানে লিডার থেকে ক্যাডার সবাই মারমুখী । করোনার কথা মাথায় রেখে বরং প্রচারে রাশ টানুক নির্বাচন কমিশন । রাজপথ কাঁপিয়ে বড় মিছিল কিম্বা মাঠ উপচানো সমাবেশের পরিবর্তে ভার্চুয়াল মাধ্যমেই প্রচার সেরে ফেলতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্য করুক কমিশন ।
Photo Credits – scroll.in , Live mint , CRPF official FB page and Facebook .