অরুণ কুমার, শিলিগুড়ি , ১৭ মার্চ ,২০২১ : ভোটের মুখে উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র শিলিগুড়ির দিকেই নজর সবার । প্রতিদিনই যেন পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে শিলিগুড়ির রাজনৈতিক সমীকরণ । পঞ্চম দফায় শিলিগুড়ি সহ দার্জিলিং জেলার পাঁচ আসনে ভোট ১৭ এপ্রিল। শিলিগুড়িতে অধ্যাপক ওমপ্রকাশ মিশ্রকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল । জোটের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বর্তমান বিধায়ক সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য । উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রেস্টিজিয়াস সিট শিলিগুড়িতে এখনও প্রার্থী ঘোষণা করে নি বিজেপি। আর যত জল্পনা বিজেপির প্রার্থী নিয়েই । ওমপ্রকাশ মিশ্রকে প্রার্থী করতেই শিলিগুড়ির তৃণমূলে বিদ্রোহের আগুন । বহিরাগত ওমপ্রকাশ মিশ্রকে নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের। এমনিতেই শিলিগুড়ি আসনে তৃণমূলের কলকাতা নিবাসী প্রার্থীর নাম ঘোষণা হতেই রাজনৈতিক মহলে চর্চা শুরু হয়ে যায় তবে কি অশোক ভট্টাচার্যকে একপ্রকার ওয়াকওভারই দিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ? যদিও শিলিগুড়ির শুকনো মহানন্দা দিয়ে রাজনীতির জল এখন যেদিকে গড়াচ্ছে তাতে রীতিমতো আতান্তরে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তৃণমূল তো বটেই বিদ্রোহের ডামাডোলে প্রবল অস্বস্তিতে বাম শিবিরও । দিন চারেক আগে কোনও পূর্বাভাস ছাড়াই বিজেপিতে যোগ দিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন শিলিগুড়ির দাপুটে সিপিএম নেতা শঙ্কর ঘোষ । অশোক ভট্টাচার্যর দীর্ঘদিনের সহচর শঙ্কর যে হঠাৎ বাম ছেড়ে রাম হয়ে যাবেন তা কল্পনাও করতে পারে নি কেউ ।
সবাইকে চমকে দিয়ে আচমকাই বাম থেকে রাম হয়ে গেলেন শঙ্কর ঘোষ । |
এদিকে ওমপ্রকাশ টিকিট পেতেই দল ছাড়ার হিড়িক পড়েছে তৃণমূলে। দল ছেড়ে দিয়েছেন জেলা তৃণমূলের নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান নান্টু পাল। শিলিগুড়ির রাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী মুখ নান্টু পাল । নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বারংবার রঙ বদলের পরেও এতটুকুও দাপট কমে নি নান্টুবাবুর । একসময়ের সিপিএম করা নান্টু পাল কংগ্রেস ও তৃণমূল পাল্টাপাল্টি করেছেন বেশ কয়েকবার । ৫ মার্চ প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে তৃণমূল কংগ্রেস। ৭ মার্চ শিলিগুড়িতে পদযাত্রা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর মমতার কর্মসূচির দিনেই রাগে দুঃখে পদ ও দল দুটোই ত্যাগ করেন নান্টু পাল । নান্টু পালের দলত্যাগের সপ্তাহ পেরোনোর আগেই আবার ধাক্কা শিলিগুড়ির তৃণমূল শিবিরে । দল ছেড়ে দেন প্রাক্তন কাউন্সিলর জ্যোস্না আগরওয়াল ও জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল । তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই দলের সঙ্গে ছিলেন জ্যোস্না আগরওয়াল । ১৯৯৮ সালে তৃণমূলের টিকিটে শিলিগুড়ি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। দীপক শীলও শিলিগুড়ি তৃণমূলের পুরোনো মুখ । বহিরাগত ওমপ্রকাশ মিশ্রকে প্রার্থী করার প্রতিবাদে জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দল ছেড়ে বেরিয়ে যান দীপকবাবু । দল ছাড়ার লাইনে আরও অনেকেই আছেন বলে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে।
ওমপ্রকাশকে টিকিট দিতেই তৃণমূল ছাড়লেন নান্টু পাল । |
ইতিমধ্যেই নির্দল হয়ে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন নান্টু পাল । এই পরিস্থিতিতে গেরুয়া শিবির প্রার্থী ঠিক করার আগে সব অপশনই বাজিয়ে দেখছে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা । সদ্য সিপিএম ছেড়ে দলে আসা শঙ্কর ঘোষ অথবা প্রভাবশালী নান্টু পাল নাকি কোনও পুরোনো নেতা- নজরকাড়া কেন্দ্র শিলিগুড়িতে প্রার্থী করা নিয়ে বিজেপিতে বিস্তর টানাপোড়েন চলছে বলে ভেতরের খবর । দল শিলিগুড়ি আসনে তাঁকেই প্রার্থী করবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল নান্টু পালের । তাই তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা দেখার সাথে সাথেই মানসিকভাবে প্রচন্ড আঘাত পান তিনি। পিকের কারসাজিতেই শিলিগুড়ির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে একজন বহিরাগতকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী করে দিয়েছেন বলে মনে করছেন নান্টুবাবু । দলের নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার পরেও তাঁকে অন্ধকারে রেখেই প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন নান্টু পাল । শিলিগুড়ির মানুষের পালস বোঝার ক্ষমতাই ভাড়ায় খাটা স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোরের নেই বলে মনে করেন তিনি। শিলিগুড়ির মানুষ ঘরের প্লেয়ার থাকতে বাইরে থেকে হায়ার করা প্লেয়ারকে কোনও মতেই খেলতে দেবে না বলে দাবি করেছেন নান্টুবাবু । শিলিগুড়ি থেকে যোগ্য নেতা তৈরি হোক – এটা কলকাতার নেতারা চান না বলেই ধারণা নান্টু পালের । এই উদ্দেশ্য থেকেই ষড়যন্ত্র করে তাঁর নাম প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ হেনেছেন শিলিগুড়ির এই প্রভাবশালী নেতা ।
অশোক ভট্টাচার্যকে হারাতে শেষ পর্যন্ত কী কৌশল নেয় বিজেপি ,এখন এটাই দেখার । |
শিলিগুড়ির সবথেকে হাই প্রোফাইল নেতার নাম নিঃসন্দেহে অশোক ভট্টাচার্য । সিপিএমের চরম দুর্দিনেও ঘাঁটি রক্ষা করে চলেছেন অশোকবাবু । অনেক টানাপোড়েনের মধ্যেও পাঁচ বছর সামলেছেন কর্পোরেশনের দায়িত্ব । অশোক ভট্টাচার্যর মতো হেভিওয়েট প্রতিদ্বন্দ্বির বিরুদ্ধে বিজেপি শেষ পর্যন্ত কী স্ট্র্যাটেজি নেয় , এখন সেই দিকেই তাকিয়ে সবাই । লোকসভার নিরিখে শিলিগুড়িতেও এগিয়ে বিজেপি । তবে বিধানসভার হিসেব আলাদা – এটা বিজেপি নেতৃত্বেরও জানা । নান্টু পালের মতো পোড় খাওয়া নেতাকে দিয়েই অশোকের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে গেরুয়া ব্রিগেড – এমন সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠেছে বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনুমান । সব জল্পনার অবসানের জন্য আরও দু-এক দিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের ।