প্রদ্যুৎ দাস , জলপাইগুড়ি , ১৬ জানুয়ারি : যাকে বলে উলট-পুরান , এ ঠিক তাই । শরীরের বাম দিকের অঙ্গ ডানে । ডান দিকের অঙ্গ বামে । ডাক্তারির পরিভাষায় শরীরের এই অবস্থাকে বলা হয় সাইটাস ইনভার্সাস(Situs Inversus)।প্রতি ১০ হাজার জনে একজনের শরীরে এমন উলটপুরান দেখা যায় । বেসরকারি নার্সিংহোমে সম্পূর্ণ নিখরচায় বিরল সাইটাস ইনভার্সাস উপসর্গযুক্ত এক রোগীর গলব্লাডার স্টোনের সফল ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি করলেন জলপাইগুড়ির শল্য চিকিৎসক ডঃ রজত ভট্টাচার্য ।
ডঃ রজত ভট্টাচার্য
ডঃ রজত ভট্টাচার্য জলপাইগুড়ি সদর ও সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের চিকিৎসক । বৃহস্পতিবার শহরের রাজবাড়ি পাড়ার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে এই অস্ত্রপচার হয় । হলদিবাড়ি ব্লকের বগড়িবাড়ি এলাকার বাসিন্দা পেশায় দিনমজুর জয়হরি বর্মনের স্ত্রী বছর চল্লিশের চঞ্চলা বর্মন গত দেড় বছর ধরেই পেটের তীব্র ব্যথায় ভুগছিলেন । স্থানীয় ডাক্তারের চিকিৎসায় ব্যথার উপশম না হওয়ায় স্ত্রীকে নিয়ে ডঃ রজত ভট্টাচার্যের শরণাপন্ন হন জয়হরিবাবু । গলব্লাডার স্টোন সন্দেহে রোগীর আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাতে বলেন চিকিৎসক । আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট হাতে পেয়েই ডাক্তারবাবু বুঝে যান রোগীর শরীরের ভেতরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গে সবই উলট-পুরান হয়ে রয়েছে । অর্থাৎ রোগীটির বিরল সাইটাস ইনভার্সাস উপসর্গ রয়েছে । সাইটাস ইনভার্সাস থাকায় চঞ্চলা দেবীর হৃদযন্ত্র বামপন্থী না হয়ে ডানপন্থী । অর্থাৎ কিনা বুকের ডানদিকে অবস্থিত । আবার লিভার , গলব্লাডার , প্লিহা , অ্যাপেনডিক্স এমনকি পাকস্থলী সহ গোটা পরিপাকতন্ত্রের অবস্থান ডানের বদলে পেটের বাম দিকে ।
ডঃ রজত ভট্টাচার্য ও তাঁর টিমের সদস্যরা রোগীর পাশে
পিত্তথলি পাথরে পূর্ণ থাকায় রোগীর অস্ত্রোপচার জরুরি । কিন্তু সাইটাস ইনভার্সাস রোগীদের ক্ষেত্রে গলব্লাডারের ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি যথেষ্টই জটিল এবং ব্যয়বহুল । খরচের বহর শুনে দিনমজুর বর্মনদম্পতির মাথায় হাত । কিন্তু পিছিয়ে আসার মানুষ নন চিকিৎসক রজত ভট্টাচার্য । তিনি রোগীর স্বামী জয়হরি বর্মনকে আশ্বস্ত করে বলেন,’ আমি নার্সিংহোমেই নিখরচায় অপারেশনের ব্যবস্থাকরছি ।’
অপারেশন শেষে সুস্থ আেন রোগী
এর আগে জলপাইগুড়িতে সাইটাস ইনভার্সাস উপসর্গযুক্ত রোগীদের এই ধরণের সার্জারি হয় নি । ডাক্তারবাবুর নিজেরও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই । সাইটে ঘাঁটাঘাঁটি করে চিকিৎসক রজত ভট্টাচার্য জানতে পারেন ১৯৯০ সালে ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি চালু হওয়ার পর থেকে পৃথিবীতে মাত্র ৭০জন সাইটাস ইনভার্সাস রোগীর এই পদ্ধতিতে গলব্লাডার স্টোনের অপারেশন হয়েছে । তার আগে পেট কেটে সাইটাস ইনভার্সাস রোগীর গলব্লাডার স্টোনের অপারেশন হয়েছে মাত্র চল্লিশটি । একাত্তরতম সার্জারিটি করতে মনস্থির করে ফেলেন ডাক্তারবাবু । অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসককে যারা সহায়তা করেন , তাদের কাছেও ব্যাপারটি নতুন । টিমের সবাইকে জটিলতার ব্যাপারটি বোঝানোরও দায়িত্ব নেন ডাক্তারবাবু । এই রোগীর অপারেশনের বেলায় ওটিতে টেবিল , মাথার ওপর লাইট এবং সরঞ্জামাদি সমস্ত কিছুই উল্টো করে সাজাতেহয় । সব কিছুর ব্যবস্থা করে বৃহস্পতিবার রাতে পঞ্চাশ মিনিটেই চঞ্চলা দেবীর পেটের বাম পার্শ্বে অবস্থিত গলব্লাডারটি ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে অপসারণ করেন চিকিৎসক ডঃ রজত ভট্টাচার্য। অস্ত্রোপচার সফল হয় এবং রোগী এখন ভালো আছেন ।
ডাঃ রজত ভট্টাচার্য এবং ওটিতে তাঁর সহযোগীরা
দরদী মনের মানুষ ডঃ রজত ভট্টাচার্য । একই সঙ্গে সাহসীও । কেস যতই জটিল হোক চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসেন । রোগী দরিদ্র হলেও মুখ ফিরিয়ে নেন না। টাকার থলি নয় মানুষের আরোগ্যকেই প্রাধান্য দেন এই ডাক্তারবাবু । কিছু দিন আগেই জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে জটিল স্প্লেনেকটমি সার্জারির মাধ্যমে পেট থেকে ক্ষতিগ্রস্ত প্লিহা অপসারণ করে দুর্ঘটনাগ্রস্ত এক দরিদ্র পরিবহণ শ্রমিকের জীবন রক্ষা করেছেন তিনি। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বেসরকারি নার্সিংহোমে স্ত্রীর অপারেশন যে সম্ভব এটা কল্পনাও করতে পারেন নি দরিদ্র দিনমজুর জয়হরি বর্মন। ডঃ রজত ভট্টাচার্যের উদ্যোগে অসম্ভব সম্ভব হওয়ায় এখন ডাক্তারবাবুর মধ্যেই ভগবানকে দেখতে পাচ্ছেন জয়হরিবাবু ।
স্বাভাবিক ব্যক্তি ও সাইটাস ইনভার্সাস ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য