উত্তম দেব
দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল এবং ভারতীয় উপমহাদেশ কার্যত সমার্থক । ভারত , বাংলাদেশ , পাকিস্তান , নেপাল এবং ভূটান ভৌগলিক ভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ । শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপ দ্বীপরাষ্ট্র হওয়ার কারণে ভূখণ্ডগত ভাবে উপমহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও সাংস্কৃতিক এবং পরম্পরাগত ভাবে নয় । ভারতীয় উপমহাদেশের একটি নিজস্ব ভূরাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক নিয়তি আছে । ভারতের প্রতিবেশীরা সময় সময় এই সত্য বিস্মৃত হয়ে বিপথগামী হন এবং ছ্যাকা খেয়ে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় আবার সিধা রাস্তায় ফিরে আসেন ।
ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের আধিপত্য বিস্তার চিনের বহুদিনের হাউস । প্রজাতান্ত্রিক ভারত ও গণপ্রজাতন্ত্রী চিন প্রায় একই সময়ে আধুনিকতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে । প্রথমদিন থেকেই ভারত চিনের বন্ধুত্ব প্রার্থনা করলেও চিন ভারতকে সর্বদাই দেখেছে সন্দেহের দৃষ্টিতে । উপনিবেশিক শাসনের অবসানের সাথে সাথেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারত বিভাজিত হয় এবং নিজের ভুখন্ডের একটি বড় অংশের ওপর সার্বভৌম অধিকার হারায় । পক্ষান্তরে কমিউনিস্ট চিন ফরমোজা ( বর্তমান তাইওয়ান ) দ্বীপের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালেও কিছুদিনের মধ্যেই তিব্বতের বিশাল মালভূমি আত্মসাৎ করে নেয় । গত একাত্তর বছরে ( ১৯৫০ এর ২৬ জানুয়ারি প্রজাতান্ত্রিক ভারতের উদ্ভব থেকে ধরে ) গণতান্ত্রিক বহুদলীয় ভারত এবং কমিউনিস্ট পার্টির শাসনাধীন একদলীয় চিন উভয় দেশই অনেক ঘাত-প্রতিঘাত , চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিজেদের মতো করে এগিয়েছে । অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি , আর্থ-সামাজিক এবং প্রতিরক্ষা , বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নতির নিরিখে নিঃসন্দেহে চিন ভারতের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ।
গণতান্ত্রিক বহুদলীয় রাজনৈতিক ও শাসন পরিকাঠামো তদুপরি জাতিগোষ্ঠীগত জটিল বিবিধতা নিয়ে ভারত সত্যিই একটি বিস্ময়কর বহুত্ববাদী দেশ । পক্ষান্তরে রাজনৈতিক ভাবে একদলীয় কমিউনিস্ট চিনকে হান নৃগোষ্ঠীর জাতিরাষ্ট্র বললে অত্যুক্তি হয় না । রাজনৈতিক , আঞ্চলিক ও নৃগোষ্ঠীগত বহুত্বতা এবং এইসকল বহুত্বতা থেকে উৎসারিত গোলোযোগ ভারতের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করেছে এবং করে যাচ্ছে । তারপরেও ভারত আজ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি । চিন দ্বিতীয় । আগামী দশ বছরের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির ভরকেন্দ্র চিন-ভারত কেন্দ্রীক হবে বলে বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস ।
ভারতই উপমহাদেশের কেন্দ্রমুখি এবং কেন্দ্রাতিগ বল |
ভারত যে উপমহাদেশের অক্ষ এবং ভারতকে কেন্দ্র করেই যে উপমহাদেশে একই সঙ্গে কেন্দ্রমুখি এবং কেন্দ্রাতিগ – এই দুটি বলই সমানভাবে ক্রিয়াশীল এটা ভারতের প্রতিবেশীরা বারবার ভুলে যায় । উপমহাদেশের ভূরাজনৈতিক পরিমন্ডলে ভারতের অক্ষ হয়ে ওঠাটা কোনও দুর্ঘটনা নয় । বরং ভৌগলিক , সাংস্কৃতিক , রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক পরম্পরার বাধ্যবাধকতাতেই দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত চালকের আসনে । ভারতীয় উপমহাদেশে ভারতের অস্তিত্ব একটি কঠিন বাস্তবতা । নেপাল , ভূটান , শ্রীলঙ্কা , মালদ্বীপ , বাংলাদেশ এমনকি পাকিস্তানকে বুঝতে হবে এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার অর্থ নিজের অস্তিত্বকেই খারিজ করে দেওয়া ।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সহজাত প্রভাব চিনের চক্ষুশূল । অথচ এই উপমহাদেশের যে রাষ্ট্রই ভারতকে সন্দেহ করে ভালবেসে চিনের আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছে শেষ পর্যন্ত চিন তার গলগ্রহে পরিণত হয়েছে । নেপালের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক , ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই । নেপালের রাজতন্ত্র অথবা বহুদলীয় গণতন্ত্র – উভয়ের শেকড়ই ভারতের মাটিতে । নেপালি কংগ্রেসের জন্ম বারাণসীতে, প্রতিষ্ঠাতা বিপি কৈরালা ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর নেপালি কংগ্রেসের থিঙ্কট্যাঙ্ক ছিলেন । বাবুরাম ভট্টরাই সহ নেপালের কমিউনিস্ট আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের অনেকেরই উচ্চশিক্ষা ভারতে । নেপালের শাহ রাজবংশের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক সময় সময় একটু ওঠানামা করলেও কখনও ভারতের স্বার্থ বিরোধী কোনও পদক্ষেপ করেন নি নেপালের রাজারা । প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সদ্য প্রকাশিত আত্মজীবনী থেকে এমনও জানা যাচ্ছে যে, তাঁদের দেশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে নেহেরুকে অনুরোধ পর্যন্ত করেছিলেন নেপাল নরেশ ত্রিভুবন বিক্রম শাহ । নেপালের রাজার প্রস্তাব দুর্বলচিত্ত নেহেরু অগ্রাহ্য না করলে আজ নেপালকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ভারতকে বিব্রত করার কোনও সুযোগ পেত না বেইজিং । পিতার জায়গায় পুত্রী থাকলে মহারাজা ত্রিভুবন বিক্রম শাহর প্রস্তাব লুফে নিতেন বলে প্রণব মুখোপাধ্যায় বিশ্বাস করতেন ।
ওলির মতো কট্টর চিনপন্থী আগে কখনও নেপালে ক্ষমতার শীর্ষে বসেন নি |
নেপালের কমিউনিস্টদের মধ্যে যারা মাওবাদী তাঁরা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নেপাল-ভারত সম্পর্কে অবনতির সূত্রপাত । তবে মাওবাদীদের সবথেকে বড় নেতা পুষ্পকমল দাহাল ওরফে প্রচন্ড ( এখনও পর্যন্ত দু’দফায় নেপালের প্রধানমন্ত্রী থেকেছেন ) , মাধবকুমার নেপাল ( প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ) কিম্বা বাবুরাম ভট্টরাইরা কখনও খুল্লামখুল্লা চিনের দালালি করেন নি যেমনটা করছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি । প্রধানমন্ত্রীর পদ পেয়েই ওলি একেবারে বেজিংয়ের কোলে গিয়ে বসলেন এবং কাঠমান্ডুস্থ চিনের রাষ্ট্রদূতের কানমন্ত্রে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পায়ে পা লাগিয়ে খারাপ করে দিতে শুরু করলেন । এদিকে চিন যখন নজরানা নিতে শুরু করল এবং নজরানার পরিমাণ দিনকে দিন বাড়িয়ে যেতে থাকল তখন ওলির দলেই অনেকের টনক নড়ল এবং নিজের দলেই কোনঠাসা হতে হতে শেষে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি বিদ্যাদেবী ভান্ডারির কাছে নতুন করে সংসদ নির্বাচনের সুপারিশ করে বসলেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি ।
এখন রাজনৈতিক ডামাডোল চূড়ান্তে পৌঁছেছে নেপালে। শাসক দল নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি আরও একবার আড়াআড়ি ভাঙনের সম্মুখীন । প্রচন্ড আর অলিতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ । প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের নির্দেশ দিলেও এর বিরোধিতায় সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছেন প্রচন্ড সহ অন্যান্যরা । ইতিমধ্যে বহুদলীয় গণতন্ত্রে নেতাদের খোয়াখুয়ি দেখে বিরক্ত হয়ে দেশে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে রাজধানী কাঠমান্ডুতে বিশাল মিছিল হয়ে গেছে মানুষের। এই পরিস্থিতিতে স্বখাত সলিলে ডুবতে বসা কেপি শর্মা ওলির জন্য নেপালের জনগণ নয় চিন্তায় ঘুম নেই চিনা সরকারের ।
উপমহাদেশের ছোট শরিকদের কেউ চিনের কোলে গিয়ে বসলে তাকে সহবৎ শিক্ষা দেওয়া ভারতের দায়িত্ব |
বেচারা ওলি ! ভেবেছিলেন চিন পাশে থাকলেই তিনি পহেলবান । এটা হিসেবে আনেন নি যে নেপালকে হাতের বাইরে চলে যেতে দেখলে বসে বসে বাদাম ভাজা চিবুবে না ভারত । চিন যতই শক্তিশালী হোক না কেন হিমালয়ের দক্ষিণ পাশের ভূরাজনীতিতে ভারতই বড় খিলাড়ি । উপমহাদেশের কোনও ছোট তরফ চিনের কোলে গিয়ে বসলে তাকে সহবৎ শিক্ষা প্রদান বড় তরফ ভারতের কূটনৈতিক দায়িত্ব বৈকি। শ্রীলঙ্কার মাহিন্দা রাজাপাক্ষে ঠেকে শিখেছেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে । বাকি রইল পাকিস্তান । দিন কে দিন চিন পাকিস্তানের নাকি পাকিস্তান চিনের বোঝা হয়ে উঠছে তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না । মাঝে মাঝে মনে হয় জন্মলগ্ন থেকে জন্মের উৎস ভারতের বিরোধিতা করতে করতে পাকিস্তান বুঝি শেষ পর্যন্ত চিনের রাজনৈতিক রক্ষিতা হয়ে পড়ল !
চিন নয় হিমালয়ের দক্ষিণ পাশের ভূরাজনীতিতে ভারতই বড় খিলাড়ি |