প্রদ্যুৎ দাস : বিলেতের শীত হাড় হিম করা । কিন্তু বাংলার শীত মিঠা । বাঙালির কাছে শীতের কতকগুলো অনিবার্য অনুষঙ্গ আছে । শীত মানে দার্জিলিংয়ের কমলালেবু । শীত মানে কুয়াশা ভরা সকালে খেজুর গাছ থেকে ঠান্ডা রসের হাঁড়ি নামিয়ে আনা । শীত মানে নলেন গুড়ের পায়েস । শীত মানে সার্কাসের তাঁবু । শীত মানে বড়দিনের কেক আর পৌষ পাবনের পিঠে । আর শীত মানে পিকনিক । বাঙালি এমনিতেই বেশিক্ষণ ঘরে থাকলে হাঁপিয়ে ওঠে । আর প্রকৃতি যদি অনুকূল থাকে, তবে বাঙালিকে ঘরের চার দেওয়ালে আটকে রাখে কার সাধ্যি । শীতের রবিবার অথবা কোনও হলিডে । কাছে অথবা দূরে দল বেঁধে পিকনিক বাঙালির রুটিন সেলিব্রেশন ।
কিন্তু এইবারের শীত আর বিগত শীতকাল গুলোর মধ্যে পার্থক্য আছে । উনিশের ডিসেম্বরেও করোনার নাম শোনে নি বাঙালি । বিশ যেন বিষ নিয়ে এল মানবজীবনে । মার্চ থেকে করোনার জ্বালা শুরু । বসন্ত মাঠে মারা গেল । বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম । গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা । বর্ষা পেরিয়ে শরৎ । শরৎ শেষে ক্ষণিকের অতিথি হেমন্ত বিদায় নিয়ে শীতও চলে এল । ডিসেম্বরের শেষ লগ্নে বর্ষ বরণের আগে আগে বাংলা জুড়ে জাঁকিয়ে শীত । কিন্তু করোনা বিদায় নিল না ।
রথযাত্রা থেকে পুজো – অতিমারির গুঁতোয় উৎসবের পর উৎসব জৌলুস হারিয়ে পানসে হয়ে গেল । বড়দিনের ইউরোপ-আমেরিকা করোনার নতুন স্ট্রেইনের আঘাতে দিশেহারা । যদিও করোনা ভীতি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে বাঙালি । করোনা থাকুক আর যাক , মুখে মাস্ক চাপা দিয়ে ঘরে বসে থাকার বান্দা নয় বাঙালি । বড়দিনের বাজারে কেকের দোকানে ভিড়ের কমতি নেই । চার্চ গুলোও দিব্যি সেজে উঠেছে । পার্কস্ট্রিটে আলো ঝলমলে মধ্যরাতের ভিড় দেখে মনে হয় নি ফেস্টিভ্যালের কিছু কম পড়িয়াছে ।
কথা হচ্ছিল শীতের পিকনিক নিয়ে । জলপাইগুড়ি জেলা জুড়ে এবং তার আশেপাশে পিকনিক স্পটের অভাব নেই । কিন্তু এবার আর দল বেঁধে কারা যাবে মূর্তি , ঝালং , বিন্দু কিম্বা গরুবাথানে পিকনিক করতে ? তবে মানুষের প্রাণের টানকে তো আর দরজা বন্ধ করে আটকে রাখা সম্ভব নয় । তার উপর জলপাইগুড়িবাসীর হাতের কাছেই আছে অমন তিস্তা স্পার । তিস্তা শুখাই হোক আর ভরা – জলপাইগুড়ির মানুষের জীবনপ্রবাহের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই নদী । তিস্তার ধূধূ বালুচর । তিস্তার বাঁধ । প্রেমের টান থেকে বিরহের বেদনা – তিস্তার বালুকাবেলাই ভাঙা গড়ার ঠিকানা ।
বড়দিনের ছোট বেলাটা ঘরে না কাটিয়ে অনেকেই ছুটে গেলেন তিস্তার পাড়ে । যদিও এবার আনন্দের হাঁট অন্যান্য বারের মতো জমকালো নয় । কারণ ওই একটাই । করোনা । অন্যান্য বছর এমন দিনে তিস্তা নদীর সুবিস্তৃত চর জুড়ে পিকনিক পার্টির মেলা বসে যেত । এবার অনেকটাই ছাড়া ছাড়া ।
তবে পিকনিক একেবারে বন্ধ হয় নি । অনেকেই এসেছেন সপরিবারে । দল বেঁধে । হাঁড়ি , কড়াই , ডেকচি , গ্যাস সিলিন্ডার আর খাবার দাবার নিয়ে । খোলা আকাশের নিচে রান্না চড়িয়ে জমিয়ে আড্ডা মেরে , খেলে , নেচে-গেয়ে , মাটিতে বসে এক পংক্তিতে খেয়ে দিনটি কাটিয়ে দিয়েছেন সবাই মিলে। পিকনিকে এসে নস্টালজিক হয়ে পড়েন অনেক পৌঢ় দম্পতি ।