অরুণকুমার,এনজেপি,২৪ ডিসেম্বর : উৎসবের মরশুম শেষে শীতের আমেজ ক্রমশ জাঁকিয়ে বসতেই করোনা ভীতি উপেক্ষা করেই পাহাড়ে ইতিউতি আগমন ঘটছে পর্যটকদের। পুজোর সময় থেকেই দাবি উঠেছিল দার্জিলিংয়ের অন্যতম আকর্ষণ ইউনেস্কোর হেরিটেজ মর্যাদা প্রাপ্ত টয় ট্রেন বা খেলনা ট্রেন পুনরায় চালু করার । কোভিড নাইন্টিন সংক্রমণের পর থেকেই বন্ধ টয় ট্রেন পরিষেবা । অবশেষে অনেক টালবাহানার পর টয়ট্রেন চালু করার সিদ্ধান্ত নিল দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে । তবে অতিমারি পরিস্থিতির যেহেতু সম্পূর্ণ অবসান হয় নি , তাই যাবতীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই টয়ট্রেনে চাপতে হবে যাত্রীদের।
২৫ ডিসেম্বর থেকে দার্জিলিং থেকে ঘুম ফের চালু ট্রয় ট্রেন |
বড়দিনের সকাল অর্থাৎ আগামী ২৫ ডিসেন্বর থেকেই পাহাড়ে টয়ট্রেন চলবে বলে ডিএইচআর সূত্রে জানা গেছে। রাজ্য সরকারের সবুজ সংকেত মিলতেই টয়ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে (ডিএইচআর) ।
ইউনেস্কোর তরফে হেরিটেজ মর্যাদা পেয়েছে শৈলরানীর খেলনা ট্রেন |
রেল সূত্রে খবর, আপাতত তিন জোড়া জয় রাইড দিয়ে পরিষেবা শুরু করা হবে । দার্জিলিং থেকে ঘুম পর্যন্ত পর্যটকেরা জয় রাইডে যাত্রা করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন ডিএইচআর এর ডিরেক্টর একে মিশ্রা। তিনি বলেন, ‘ রাজ্যের কাছে আমরা পুজোর আগেই ট্রয় ট্রেন চালুর অনুমতি চেয়েছিলাম। তখন থেকেই ট্রেন চালাতে প্রস্তুত ছিলাম আমরা । অবশেষে সরকারের অনুমতি পাওয়া গিয়েছে । তাই দেরি না করে ২৫ ডিসেম্বর থেকে করোনা বিধি মেনেই টয়ট্রেন চালানো হবে ‘। আপাতত পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় জয় রাইড দিয়ে পরিষেবা শুরু করা হলেও করোনা পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হয়ে গেলে এনজেপি থেকে দার্জিলিং ট্রয় ট্রেনের নিয়মিত পরিষেবাও চালু করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে,এ বিষয়ে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক শুভানন চন্দ বলেন, ‘ জয় রাইডে ফার্স্ট ক্লাস কোচ দিয়ে একটি স্টিম এবং দুটি ডিজেল ইঞ্জিনের ট্রেন চালানো হবে। তার মধ্যে একটি ফার্স্ট ক্লাস ভিস্তা ডোম কোচ থাকবে।
করোনা মহামারির কারণে গত মার্চ থেকেই দার্জিলিংয়ে টয়ট্রেন পরিষেবা বন্ধ ছিল। জনজীবন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করলে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পাহাড়ে টয়ট্রেন চালানোর অনুমতি চেয়ে রাজ্যকে চিঠি দেয় রেল। তৎকালীন জেলা শাসক এস পন্নমবলমের মাধ্যমে নবান্নে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু রাজ্য সরকারের তরফে কোনও উত্তর না মেলায় পরিষেবা বন্ধই রাখা হয়। উৎসব মরশুমে করোনা ভীতি উপেক্ষা করেই বেশ বড় সংখ্যায় পাহাড়ে গিয়েছিলেন পর্যটকেরা । কিন্তু পরিষেবা বন্ধ থাকায় সাধের টয়ট্রেনে না চড়েই ফিরতে হচ্ছিল ভ্রমণকারীদের । অথচ পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রেলপথ ধরে খেলনা ট্রেনের জানালা দিয়ে হিমালয়ের সৌন্দর্যকে দেখতে না পেলে দার্জিলিং সফর সম্পূর্ণ হয় না পর্যটকদের ।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর দার্জিলিংয়ের পর্যটন ব্যবসায় আবার জোয়ার এসেছিল । ২০১৯ এর পুজো মরশুমে রেকর্ড পরিমাণ পর্যটক এসেছিলেন পাহাড়ে । গত মার্চ মাসে যখন সবে মাত্র দেশ-বিদেশ থেকে দার্জিলিংয়ে পর্যটকেরা আসতে শুরু করেছেন তখনই আঘাত হানলো করোনা প্যান্ডেমিক । লকডাউনের ধাক্কায় স্তব্ধ হয়ে গেল জনজীবন । বন্ধ হয়ে গেল পর্যটন । শীত মরশুমের শুরুতেই পযটকেরা আবার পাহাড় মুখি হতেই টয় ট্রেন চালুর আর্জি জানিয়ে ফের রাজ্য সরকারের কাছে চিঠি পাঠায় রেল কর্তৃপক্ষ । টয় ট্রেন চালুর বিষয়টি বিবেচনা করতে রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেবের কাছেও অনুরোধ জানান স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীরা । এরপরেই তাঁর দপ্তরের সচিবকে বিষয়টি দেখতে নির্দেশ দেন গৌতমবাবু । সেইমতো সব দিক খতিয়ে দেখেই অবশেষে রেলকে টয়ট্রেন চালানোর অনুমতি দিয়েছে নবান্ন।
জয় রাইড ফের শুরু করার আগে ট্রয় ট্রেনের ট্রায়ল রান |
ডিএইচআর সূত্রে জানা গিয়েছে, ৫২৫৯৪ স্টিম লোকোমটিভ সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে দার্জিলিং থেকে ফার্স্ট ক্লাস কোচ নিয়ে ছুটবে। যার ভাড়া হবে ১,৫০০ টাকা। এছাড়াও ৫২৫৯৭ ডিজেল লোকোমটিভ বেলা ১২টায় ফার্স্ট ক্লাস কোচ নিয়ে চলবে। যার ভাড়া হবে ১,০০০ টাকা। অপর একটি ৫২৫৯৮ ফার্স্ট ক্লাস ভিস্তা ডোম কোচ নিয়ে দুপুর দেড়টায় রওনা হবে। যার ভাড়া হবে ১,৬০০ টাকা। রেলের তরফে জানানো হয়েছে, পর্যটকের সংখ্যা বাড়লে টয়ট্রেনের সংখ্যাও বাড়ানো হবে।
এদিকে, টয়ট্রেন পরিষেবা পুনরায় চালুর খবরে খুশি উত্তরবঙ্গের পর্যটন ব্যবসায়ীরা। পর্যটন ব্যবসায়ী সম্রাট সান্যাল বলেন, ‘ আমরা দীর্ঘদিন ধরে চাইছিলাম টয়ট্রেন চালানো হোক। অবশেষে রাজ্য এবং রেল বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হয়েছে, এটা অবশ্যই খুশির খবর। ‘
১৪১ বছর ধরে চলছে । বদলেছে রূপ । কমে নি আকর্ষণ |
উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম পর্যটন বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম রাজ বসু এ বিষয়ে জানিয়েছেন,’টয় ট্রেন হল ইউনেস্কোর অন্যতম হেরিটেজ আইকন । এখানকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এই ট্রেন কে চালু করার। কারণ এই হেরিটেজ আইকন এর সাথে যদি মানুষের যোগাযোগ না থাকে বিশেষ করে পর্যটকদের সঙ্গে যদি সরাসরি যোগাযোগ না থাকে তাহলে সেটা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ।’ রাজ বসু আরও বলেন, ‘ আমাদের ভয় ছিল দীর্ঘদিন স্থবির থাকতে থাকতে মানুষের মন থেকে ঐতিহ্যবাহী টয় ট্রেন হারিয়ে যাওয়ার একটা প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়ে যাবে। তাই আমরা দাবি করেছিলাম, যত দ্রুত সম্ভব টয় ট্রেনকে ফের সচল করুক ডিএইচআর । ‘ পর্যটন ব্যবসায়ী মহলের দাবির মুখে দার্জিলিং হিমালয়ের রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল , রাজ্য সরকারের অনুমতি পেলে টয় ট্রেন চালু করতে আপত্তি নেই তাদের ।
যাই হোক অবশেষে রাজ্য সরকারের অনুমতি নিয়েই কেন্দ্রীয় সরকারের করোনা কালীন যাবতীয় বিধি-নিষেধ মেনেই ক্রিসমাসের সকাল থেকেই আবার আরম্ভ হতে চলেছে নস্টালজিক টয় ট্রেনের যাত্রা ।
করোনা অতিমারি ও লকডাউনের ধাক্কায় বিশ্ব জুড়েই যেকটি ক্ষেত্র একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে তার একটি পর্যটন শিল্প । ভারতে আনলক পর্ব শুরু হতেই পর্যটনস্থল গুলিও গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। উত্তরবঙ্গে পর্যটন ব্যবসার ভরকেন্দ্র হল দার্জিলিং পাহাড় । পুজোর সময় থেকেই পাহাড়ে পর্যটকেরা আসতে শুরু করেছেন । পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বিদেশি পর্যটকদের পাহাড়ে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। এখন দেশি পর্যটকেরাই পাহাড়ের পর্যটন কেন্দ্রিক অর্থনীতির ভরসা । সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে টয় ট্রেন চালুর পর পর্যটকেরা আরও বেশি করে পাহাড় মুখি হবেন বলে ট্যুর অপারেটরদের বিশ্বাস । আর পাহাড়কে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পে সুদিন ফিরে এলে ছন্দে ফিরবে তরাই-ডুয়ার্স সহ হিমালয় পাদদেশের অন্যান্য পর্যটন স্থল গুলিও ।