মামলায় মামলায় জেরবার সরকার। তাই কি বিশ্ববাংলা কনভেনশন সেন্টারে দেশের প্রধান বিচারপতির সামনেই বিচারব্যবস্থার উপর রাগ ঝাড়লেন মুখ্যমন্ত্রী?
কলকাতা : দেশের বিচারব্যবস্থা এখন আর স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ নয় বলে উষ্মা প্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ আইনবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিত, কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর উপস্থিতিতেই বিচারব্যবস্থা নিয়ে নিজের অসন্তোষ ব্যক্ত করলেন মমতা। প্রতিক্রিয়ায় বিরোধীদের কটাক্ষ- বিচারবিভাগের কড়া অবস্থানের কারণে একের পর এক ঘোটালায় সরকারের এক হেভিওয়েট মন্ত্রী এবং শাসকদলের একাধিক জনপ্রতিনিধি ও নেতা ফেঁসে যাওয়াতেই বিচারব্যবস্থার উপর তৃণমূল সুপ্রিমোর এই রাগ।
বিশ্ববাংলা কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ” স্যার, সম্মানই আমাদের একমাত্র সম্বল। সেটা যাওয়া মানে সব চলে যাওয়া। একবার সম্মানহানি হলে তা আর ফেরত আসে না।” মমতা আরও বলেন, “অকারণে আজকাল মানুষকে হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে। এক শ্রেণির মানুষ সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। এই রকম চলতে থাকলে দেশে রাষ্ট্রপতি নিয়ন্ত্রিত শাসনের পরিস্থিতি তৈরি হবে।”
সাম্প্রতিক সময়ে এসএসসি ও প্রাথমিকের নিয়োগ দুর্নীতি সহ একাধিক মামলায় জড়িয়ে প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের পদচ্যুত সভাপতি তথা তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য এবং বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল জেলে। তৃণমূলের নেতারাও আড়ালে স্বীকার করছেন, নিয়োগ দুর্নীতি মামলা সরকার ও দলের ভাবমূর্তিতে চুনকালি লেপেছে। কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল ও ডিভিশন বেঞ্চের অনমনীয় অবস্থানের কারণেই নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জল এতদূর গড়িয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। বিশেষ করে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম লোকের মুখে মুখে। এই কারণেই কি মমতার মুখে সম্মানহানি ও হেনস্থার অভিযোগ? প্রশ্ন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের।
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমেরও সমালোচনা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিচারাধীন বিষয়ে গণমাধ্যম ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করে রায় দিয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। মমতা বলেন, “গণতান্ত্রিক দেশে বিচারব্যবস্থা, আইন, প্রশাসন এবং গণমাধ্যম- এই সব হল এক-একটি স্তম্ভ। একটির মান নষ্ট হলে অন্যটির ক্ষতি হয়।” মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, এখন আদালতে বিচারের আগেই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ করে রায় দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যম এখন বিচারব্যবস্থার উপর প্রভাব খাটাচ্ছে বলে অনুষ্ঠানে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষোভের সঙ্গে মমতা বলেন, “সংবাদমাধ্যম বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তারা কাউকে অপরাধী বলে দাগিয়ে দিতে পারে না। আমার সম্মান নষ্ট করতে পারে না।” এর আগেও একাধিকবার সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়ালের অভিযোগ করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, নিয়োগ দুর্নীতি সহ একাধিক মামলার খবর ফলাও করে প্রকাশ করাতেই মিডিয়ার প্রতি ক্ষোভ মুখ্যমন্ত্রীর।
বিচারব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ উগড়ে দেওয়ার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতের প্রশংসাও করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ললিত দায়িত্ব নেওয়ার পর বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে বলে দাবি করেন তিনি। উদয় উমেশ ললিত আগামী মাসেই অবসর নেবেন। গত ২৭ অগাস্ট সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে মাত্র তিন মাস সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব সামলাবেন ইউ ইউ ললিত। মমতা বলেন, “ললিতজি আগামী মাসে অবসর নেবেন। এই দুই মাসে আমরা দেখেছি, বিচারব্যবস্থা কাকে বলে! আমি বলছি না বিচারব্যবস্থা থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে গিয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপ হচ্ছে।” একাধিক মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল -ডিভিশন এমনকি লার্জার বেঞ্চে রাজ্য সরকার বিপাকে পড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্টে কিঞ্চিত স্বস্তিতে আছে দেখা যাচ্ছে। এই কারণেই মমতার ললিত প্রশস্তি কিনা, প্রশ্ন তুলছে রাজনৈতিক মহল।
Photo Credit- Verified FB page of Mamata Banerjee.