দল যদি তাঁর কথা মেনে পচা অংশ কেটে বাদ না দেয়, তবে কী করবেন এই প্রাক্তন আমলা?
রাজনৈতিক প্রতিবেদন : মমতা তাঁর উপর চটলে তবেই পদ ছাড়বেন তৃণমূলের বিদগ্ধ সাংসদ জহর সরকার। সোমবার দল সম্পর্কে জহর যা বলেছেন, তার পরেও প্রাক্তন এই আমলার উপরে মমতা কুল আছেন কিনা তা জানা যায় নি। যদিও সৌগত রায় সহ তৃণমূলের কয়েকজনের কাছে থেকে জহর যে’ভাবে হ্যাটা খাচ্ছেন তার পরেও আত্মমর্যাদা ধরে রেখে কীভাবে তিনি দল ও পদে থাকবেন- সেটাই একটা বড় প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলের কাছে। সোমবার সংবাদ মাধ্যমের সামনে জহর সরকার বলেছেন- “দলের একটা সাইড পচে গেছে। পচে যাওয়াদের দলে রেখে দিলে চব্বিশে তৃণমূলের ভাল ফল হওয়ার কোনও আশাই নেই।” পার্থ চট্টোপাধ্যায়-অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের এপিসোড টিভিতে দেখার পর থেকেই ঘৃণায় গা শিরশির করে জহরের। তিনি তৃণমূল করুন, তাঁর পরিবারের লোকেরা যে তা আর চান না, সেই কথাও ফলাও করে মিডিয়াকে জানিয়ে দিয়েছেন সাংসদ। এমনকি তৃণমূল করার জন্য নিজের বন্ধুদের নজরেও যে তিনি নিচু হয়ে গেছেন, তাও গোপন করেন নি এই প্রাক্তন আমলা।
প্রশ্ন হল- নিজের দল সম্পর্কে যাঁর এই মূল্যায়ণ এবং প্রতিমাসেই যিনি দলটি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবেন, দল ছাড়া নিয়ে তাঁর এই দোদুল্যমানতা কেন? বুধবার সেই প্রশ্নের জবাব দিলেন জহর সরকার। সাংবাদিকদের জহর বলেন- মমতা চাইলেই তিনি চলে যাবেন। গত বছর এমন দিনেই দীনেশ ত্রিবেদীর ছেড়ে যাওয়া আসনে প্রাক্তন আমলা জহর সরকারকে রাজ্যসভায় পাঠান মমতা। ২০১৬ সালে অবসর গ্রহণের পর থেকেই মোদী সরকারের বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে সুর চড়িয়ে যাচ্ছিলেন জহর। হয়তো এই কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরে পড়ে যান এই বাঙালি আমলা। খুব প্রত্যাশিতভাবেই সোমবার করা জহরের বিস্ফোরক মন্তব্যে টাস্কি খেয়ে যায় তৃণমূল। যে ভাষায় জহর সরকার দলকে ছুঁলেছেন, অন্য কোনও নেতা হলে এতক্ষণে মমতা-অভিষেক তাঁকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে দিতেন।
কিন্তু জহর সরকার নিজে আর কতক্ষণ তৃণমূলে টিকতে পারবেন? এ’কথা ঠিক যে, তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব অফিশিয়ালি জহর সরকারের বিরুদ্ধে একটি শব্দও খরচ করে নি কিন্তু তাতে তো গালমন্দ থেমে থাকে নি। সবার আগে জহরকে অপমান করেছেন তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ অধ্যাপক সৌগত রায়। জহর সরকার মনে করেন, তিনি রাজনীতির লোক না হলেও ভাল বক্তৃতা দিতে পারেন বলেই মমতা তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছেন। জবাবে সৌগত কটাক্ষ করে বলেন- ” জহর কোনও ভাল বক্তাই নন। উনি সংসদে বক্তৃতা দিতে পারেন না।” সৌগত চাঁচাছোলা ভাষায় জহর সরকার সম্পর্কে আরও যা বলেন- ‘ ওঁর মতো স্বার্থপর আমলা জীবনে দেখিনি । সাংসদ হওয়ার আগে একদিনও দলের মিছিলে হাঁটেননি, উনি কোনও আত্মত্যাগ করেননি। জহর সরকার একজন তৃণমূল কর্মীরও উপকার করেননি উনি।” সৌগত রায়ের সাফ কথা- ”সাহস থাকলে জহর সরকার পদত্যাগ করুন। দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির ওঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা উচিত।”জহর সরকারের রাজ্যসভায় থাকা না থাকায় দলের পারফরম্যান্সে ভালমন্দ কোনও প্রভাব পড়ে বলেও মনে করেন না সৌগত। তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ বলেন, “উনি চাইলে সাংসদ পদ ছেড়ে দিন, আমরা অন্য কাউকে উপ নির্বাচনে জিতিয়ে আনব।” শুধু সৌগত রায়ই নন, বাবুল সুপ্রিয়, বিশ্বজিৎ দেব সহ তৃণমূলের আরও অনেক ছোট-বড় নেতাই প্রকাশ্যে জহর সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছেন। যাঁরা মুখ খোলেন নি তাঁরাও দলের ভেতরে জহরের মন্তব্যে যথেষ্টই উষ্মা প্রকাশ করছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের ছোট-বড় নেতাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শুনে আর কতদিন সাংসদ পদ আঁকড়ে রাখবেন জহর সরকার? সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে প্রসারভারতীর প্রাক্তন সিইও বলেন- যিনি আমাকে ( মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ) এই কাজের ( রাজ্যসভায় দলের সাংসদ করে পাঠানো) দায়িত্ব দিয়েছেন, তিনি যদি ক্ষুব্ধ হন এবং চলে যেতে বলেন, পদত্যাগ করে চলে যাব।” অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ ফুটে কিছু না বলা পর্যন্ত নড়বেন না জহর। মমতা কখন কী করেন, কী বলেন, অতি ঘনিষ্ঠরাও তা বুঝতে পারেন না। জহর সরকার ইস্যুতে মমতা কী অবস্থান নেবেন, তা কেউই জানে না। অনেকে বলছেন, এমনও তো হতে পারে যে, শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটিকে দিয়ে আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ না করিয়ে, দলের অন্যদের খেপিয়ে তুলে জহরকে পদ ছাড়তে বাধ্য করতে পারেন তিনি। জহর সরকার বলেছেন, “পদের থেকে আত্মসম্মান আমার কাছে অনেক বড়।”
শুধু সৌগত-বাবুল-বিশ্বজিতের মতো তৃণমূলের নেতারাই নন জহর সরকারের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশায় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও। তাঁদের প্রশ্ন- এত অস্বস্তি নিয়ে রাজনীতিতে আছেন কীভাবে জহরবাবু? দল যদি পচা অংশ কেটে বাদ না দেয়। দল যদি দুর্নীতিমুক্ত হতে যথাযথ পদক্ষেপ না করে, তবে কী করবেন এই প্রাক্তন আমলা? তারপরেও কি আত্মসম্মান বজায় রেখে তৃণমূলে থাকতে পারবেন জহর সরকার? নাকি তিনিও আরও অনেকের মতো বিশ্বাস করেন, তৃণমূল খারাপ কিন্তু তৃণমূলের সুপ্রিমো ভাল?
Feature image is representational.