সত্তরের দশক বাংলার রাজনীতিতে যে ক’জন তারকার জন্ম দিয়েছিল,নিঃসন্দেহে সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁদের একজন। তারকারা একে একে উধাও হচ্ছেন…
আলোর উৎসবের রাতেই নিভল জীবনের বাতি । আঁধার নামল রাজ্য রাজনীতিতে। কালীপুজোর মধ্যেই মহাকালের পথে যাত্রা করলেন পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর গত ২৪ অক্টোবর এসএসকেএম হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে ভর্তি করা হয় সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে।ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকলেও বৃহস্পতিবার ( ৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় আচমকাই শারীরিক অবস্থার অবনতি । ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে লোকান্তরে পাড়ি জমান সুব্রত । রাজনীতির অন্যতম বর্ণময় চরিত্র । বাম হোক কি ডান – ষাটের দশকের শেষে অথবা সত্তরের দশকের শুরুতে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হওয়া যে’কজন নেতা পরবর্তীতে রাজ্য রাজনীতির মহীরুহতে পরিণত হয়েছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁদের অন্যতম । সাতষট্টি থেকে বামপন্থার তীব্র জোয়ারে ভেসে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কংগ্রেসের পালে হাওয়া লাগে তিন ছাত্র নেতার হাত ধরে । প্রিয়-সুব্রত-সোমেন । ত্রয়ী । সময়টা ছিল সত্তরের শুরু । ছাত্রপরিষদের কান্ডারী হয়েই কংগ্রেসের মরা গাঙে যৌবনের জোয়ার আনেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সী । সংগঠন বিস্তারে প্রিয়কে যোগ্য সংগত দিলেন সোমেন মিত্র ও সুব্রত মুখোপাধ্যায় । একাত্তরের ডিসেম্বরে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে হারিয়ে ভারতীয় সেনার অনবদ্য জয়লাভ । ইন্দিরার হাওয়ায় ভেসে গেল গোটা দেশ। পশ্চিমবঙ্গেও হারানো জমি ফিরে পেল কংগ্রেস । বাহাত্তরের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মহাকরণ দখল করলেন সিদ্ধার্থশংকর রায় । সিদ্ধার্থর মন্ত্রিসভায় সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন ছাব্বিশ বছরের এক ছাত্রনেতা । যাঁর নাম সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ওই বয়সেই স্বরাষ্ট্র , তথ্য ও সংস্কৃতির পাশাপাশি স্থানীয় সরকার দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও সামলে ছিলেন সুব্রত ।
প্রিয় এবং সোমেন আগেই জীবনের মঞ্চ ছেড়েছেন । এবার আড়াল হলেন সু্ব্রতও । বলাই যায় , একটা যুগের পূর্ণ অবসান । প্রিয়-সুব্রত-সোমেন , এই তিনমূর্তির রাজনৈতিক জীবনের সিংহভাগ কেটেছে বাম জামানায় । বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে বামবিরোধী , সরকারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ ছিলেন সুব্রত । রাজপথে ঝটিকা আন্দোলন নামিয়ে প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত করায় জুড়ি ছিল না সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের । বিধানসভার ভেতরেও নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে মিডিয়ার নজর টেনে নেওয়ায় তাঁর সমকক্ষ আর কেউ ছিলেন না বিরোধী বেঞ্চে। যদিও জ্যোতি বসু সহ অধিকাংশ সিপিএম নেতার সঙ্গে সুব্রতর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল মধুর । জ্যোতি বসু তাঁকে স্নেহ করতেন – সংবাদমাধ্যমের সামনে একাধিকবার এই কথা বলেছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। রাজনীতির পথ সতত পিচ্ছিল এবং বিচিত্র । মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক গুরু ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। মুখে তা স্বীকারও করেন মমতা । যদিও গুরু-শিষ্যার সম্পর্ক সর্বদা সরলরেখায় চলে নি । একসঙ্গে কংগ্রেসে থাকার সময় সুব্রত-মমতায় ঠোকাঠুকি লেগেই থাকত । সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে তরমুজ বলে কটাক্ষ করতেন মমতা । অর্থাৎ উপরে সবুজ হলেও ভেতরে লাল । সুব্রত সিপিএমের দালাল – এটা বোঝাতেই তরমুজ উপমা ব্যবহার করতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা রাজনীতি নয় বেদের মেয়ে জ্যোস্নার মতো যাত্রাপালা করে বলে একবার বিদ্রুপ করেছিলেন সুব্রত । আজীবন দিল্লির রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও ইন্দিরা গান্ধীর স্নেহছায়া থেকে কখনও বঞ্চিত হন নি । সাতাত্তরে শোচনীয় ভরাডুবির পর গুরু প্রিয়রঞ্জনও ইন্দিরাকে ছেড়ে দেবরাজ আর্সের দলে নাম লিখিয়েছেন কিন্তু ইন্দিরাকে ত্যাগ করেন নি সুব্রত । পরবর্তী সময়ে অবশ্য কংগ্রেসের প্রতি এই অচলাভক্তি ধরে রাখতে পারেন নি সুব্রত মুখোপাধ্যায়। কংগ্রেসের সঙ্গে দীর্ঘ তিরিশ বছরের সম্পর্ক চুকিয়ে ২০০০ সালে তৃণমূলে যোগ দেন সুব্রত। কংগ্রেসের বিধায়ক হয়েও কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে তৃণমূলের প্রতীকে ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে জয়লাভ করেন। সে’বার বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে কর্পোরেশন দখল করে তৃণমূল। কলকাতার মেয়র হন সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
বাম জামানায় কলকাতার মহানাগরিকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কৃতিত্বের পরিচয় দেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। শক্ত হাতে হাল ধরেন কলকাতা পুর নিগমের । পুর পরিষেবার উন্নয়নে অনেক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেন । পুরপ্রশাসন পরিচালনাতেও রেখেছিলেন দক্ষতার ছাপ । ২০০১ এর বিধানসভা নির্বাচনে চৌরঙ্গি কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে নির্বাচিত হন । ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ২০০৫ এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফের মন কষাকষি সুব্রতর । পুরসভা নির্বাচনের মুখে তৃণমূল ছেড়ে পৃথক মঞ্চ গড়েন তিনি। কর্পোরেশন নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধে সুব্রতর মঞ্চ । শরদ পাওয়ারের এনসিপির ঘড়ি প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মঞ্চের প্রার্থীরা । সুব্রত মুখোপাধ্যায় জিতলেও ভোটে পর্যুদস্ত হয় সুব্রতর মঞ্চ ও কংগ্রেসের জোট । ফের কলকাতা পুরসভা দখল করে বামফ্রন্ট । মেয়র হন বিকাশ ভট্টাচার্য। সেই বছরই কংগ্রেসে ফিরে যান সুব্রত । ছয়ের বিধানসভা নির্বাচনে চৌরঙ্গী থেকে হারের মুখ দেখেন । সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন পর্বে ফের মমতার সঙ্গে দূরত্ব কমতে থাকে সুব্রতর । আটে সিঙ্গুরে মমতার ধর্নামঞ্চেও দেখা যায় তাঁকে । ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ও কংগ্রেসের আসন সমঝোতা হয় । বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্র থেকে সিপিএমের দুঁদে সাংসদ বাসুদেব আচার্যের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজয় বরণ করেন সুব্রত । দশে পুরসভা নির্বাচনের মুখে কংগ্রেস ত্যাগ করে ফের তৃণমূলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেন তিনি । এরপর থেকে আমৃত্যু মমতার সঙ্গেই ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। এগারোর বিধানসভা ভোটে বালিগঞ্জ থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে মমতার মন্ত্রিসভায় । এগারোর ২০ মে থেকে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত মমতার ক্যাবিনেটে গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন সুব্রত । পাশাপাশি আরও কিছু অতিরিক্ত দফতরের দায়িত্বও তাঁর সুব্রতদার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
দল বা প্রশাসন পরিচালনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সহকর্মীদের ধার বিশেষ ধারেন না এই কথা রাজনৈতিক মহলে সুবিদিত । একমাত্র ব্যতিক্রম সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তৃণমূল ও রাজ্য মন্ত্রিসভায় সুব্রতই একমাত্র ব্যক্তি যিনি মমতাকে তুই বলে সম্বোধন করে গেছেন । কারও কথায় না চলা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সুব্রতকে অভিভাবক মানতেন । পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের কাজ নিয়েও বড় একটা মাথা ঘামাতেন না মুখ্যমন্ত্রী। পঞ্চায়েতের দায়িত্ব সুব্রতদার উপরে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন মমতা । পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের কাজ দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেনও অভিজ্ঞ এই রাজনীতিক । দলীয় রাজনীতির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক আন্দোলনেও আলোচিত নাম সুব্রত মুখোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন আইএনটিইউসির রাজ্যসভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন । রাজনীতির খাতিরে কখনও কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট করেন নি সুব্রত । কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি , সব ঘরেই বন্ধু রেখে গেছেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বাঙালি মধ্যবিত্তের রুচি , চালচলন ও ভদ্রতা বজায় রেখেছেন আমৃত্যু । তীব্র রসবোধ ছিল । পড়ালেখা করতেন নিয়মিত । যৌবনে রাজনীতি করতে গিয়ে ধুতি পরেই রাজপথ দাপিয়েছেন । আমৃত্যু ধুতিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন । কংগ্রেস শিবিরে প্রিয়-সোমেন-সুব্রত , বাম শিবিরে বিমান-বুদ্ধ-সুভাষ । একই প্রজন্ম থেকে উঠে আসা ধুতি পরিহিত বাঙালি নেতা এঁরা সবাই । ধুতি-পাঞ্জাবিতে শোভিত বাঙালি নেতাদের যুগ শেষ হতে চলল।
রাজনীতিতে সাফল্য-ব্যর্থতা আপেক্ষিক। এ কথা ঠিক , দাপুটে নেতা হয়েও পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে কিছুই দিতে পারেন নি সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বাংলায় কংগ্রেস আজ সাইনবোর্ডে পরিণত হয়েছে। প্রিয়-সোমেনের মতো এর দায় এড়াতে পারেন না সুব্রতও । মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা ছিল । মনে অভিলাষ ছিল না তেমনও নয় । কিন্তু ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা যেই উচ্চতায় পৌঁছুলে রাজনীতির শীর্ষে পৌঁছানো সম্ভব তা কোনও দিনই অর্জন করতে পারেন নি সুব্রত মুখোপাধ্যায়। পরিষদীয় রাজনীতিতে বেশ দক্ষ ছিলেন। একবার অন্তত সংসদেও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল খুব । কিন্তু সবার সব ইচ্ছে পূরণ করেন না বিধাতা । যতবার লোকসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন , ততবারই ঘটনাচক্রে পরাস্ত হতে হয়েছে সুব্রতকে । কপাল এমনই , রাজ্যসভাতে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েও হারের মুখ দেখতে হয়েছে এই দুঁদে রাজনীতিককে । আজীবন নিজেকে দুর্নীতি-কলঙ্ক থেকে বাঁচিয়ে চলেছেন। শেষ জীবনে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের নিষ্কলঙ্ক রাজনৈতিক জীবনে চোনা ফেলেছে নারদা কান্ড ।শেষ জীবনে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল । এই আঘাত সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে বিপর্যস্ত করেছিল নিঃসন্দেহে । সত্তরের দশক বাংলার রাজনীতিতে যে ক’জন তারকার জন্ম দিয়েছিল নিঃসন্দেহে সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁদের একজন। তারকারা একে একে উধাও হচ্ছেন ।
Photo Credit – Facebook page of Subrata Mukherjee.