১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর সকালে নিজের সরকারি বাসভবনে দেহরক্ষীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মৃত্যু বরণ করেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবথেকে বর্ণময় , সবথেকে ক্যারিশ্মাটিক এমনকি সবথেকে সফল রাজনৈতিক চরিত্রের নাম ইন্দিরা । ইন্দিরার সাফল্য যেমন চোখ ধাঁধানো , ভুলও তেমনি হিমালয়ের মতো ভারি । ইন্দিরার দৃঢ়তা , সাহস এবং ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ ছিলেন তাঁর চরম রাজনৈতিক শত্রুরাও । ইন্দিরা গান্ধীর আত্মবলিদান দিবসে একটি বিশেষ প্রতিবেদন –
নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের সবথেকে বর্ণময় চরিত্রের নাম ইন্দিরা গান্ধী । পিতা জওহরলাল নেহেরু ভারতের জাতীয় রাজনীতির অন্যতম মহীরুহ। অথচ পিতার চেয়েও বর্ণময় এবং অনেক বেশি বিতর্কিত জওহরলালের ইন্দু। এমনকি সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেহেরুর থেকে অনেক বেশি দৃঢ় এবং সংকটের মুহুর্তে কঠিনও । শুধু দ্বিখণ্ডিত ভারত নয় সমগ্র উপমহাদেশ এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার সবথেকে ক্যারিশ্মাটিক রাষ্ট্রনায়কদের সারিতে ইন্দিরাই প্রথম ,এখনও পর্যন্ত । ভুবন ভোলানো রূপ বলতে যা বোঝায়, বিধাতা তাই দিয়েছিলেন নেহেরু তনয়াকে । কৈশোরে অন্তর্মুখী । যৌবনে জীবনসঙ্গী চয়নে রীতিমতো বিদ্রোহিনী । রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম। রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা । পিতার ছত্রছায়াতেই রাজনীতিতে আসা । ইন্দিরা যখন সদ্য রাজনীতিতে এলেন , দলের ভেতরে ও বাইরে অনেকেই তাঁকে মাপতে ভুল করেছিলেন । প্রখ্যাত সমাজতান্ত্রিক নেতা ডঃ রামমনোহর লোহিয়া ইন্দিরাকে তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন ’ ঘুঙ্গি গুরিয়া ‘ । অর্থাৎ বোবা পুতুল । অচিরেই লোহিয়াকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ভারতের সবথেকে চতুর, তীক্ষ্মবুদ্ধি , ঠান্ডামাথা এবং দৃঢ়চেতা রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন ইন্দিরা গান্ধী , দলের ভেতরে এবং বাইরেও ।
নিজের রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন ইন্দিরা । ইন্দিরা গান্ধীর সবথেকে বড় কৃতিত্ব পাকিস্তানের ব্যবচ্ছেদ । স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্রের সবথেকে সফল সামরিক অভিযান নিঃসন্দেহে একাত্তরের ভারত-পাক যুদ্ধ । এই যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় এমনকি বিপর্যয় নিয়ে কোনও বিতর্ক , কোনও সন্দেহের অবকাশই নেই। বাংলাদেশের সৃষ্টিতে ইন্দিরার অবদান একটি ঐতিহাসিক সত্য। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক ও খনি জাতীয়করণ ইন্দিরা গান্ধীর অন্যতম সাহসী পদক্ষেপ। ভারতকে পরমাণু অস্ত্রধর রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রথম সাহস দেখান ইন্দিরাই । ইন্দিরার সাহসী এবং বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গুলির সুফল যেমন দেশবাসী পেয়েছে তেমনি ইন্দিরার ভুল গুলির কুফলও ভুগেছে দেশের মানুষ। একটা কথা মানতে হবে সাফল্যের মতোই নিঃসন্দেহে ইন্দিরার ভুল গুলিও ছিল হিমালয়ের মতো ভারি এবং বিশাল । তাঁর সবথেকে বড় ভুল নিঃসন্দেহে পঁচাত্তরে অভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থা ঘোষণা।
রাজনীতি আসলেই দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া । কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছুতে ব্যর্থ হলে পতন অনিবার্য। সাতাত্তরে এমন রাজনৈতিক পতনই হয়েছিল ইন্দিরার । দলের ভেতরে পিতৃতুল্য প্রবীণদের অপদস্থ করে চাটুকারদের মাথায় তুলেছিলেন। জীবনের সবথেকে বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি নেওয়ার সময় ইন্দিরার পাশে অভিজ্ঞ এমন কেউ ছিলেন না যিনি তাঁকে সুপরামর্শ দিয়ে খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেন । যে কোনও বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিম্বা ঝুঁকি নেওয়ার সময় নিজের পিতার মতো দোলাচলে ভুগতেন না ইন্দিরা গান্ধী। এই আত্মবিশ্বাস তাঁকে যেমন অনেক সাফল্য এনে দিয়েছে তেমনি করেছে সর্বনাশও । তার মধ্যে এমার্জেন্সি অন্যতম। জনগণ তাঁকে বিদায় করেছিল । আবার জনগণই তাঁকে ফিরিয়ে এনেছে ক্ষমতায়। মানুষের মনের গতিপ্রকৃতি বোঝার এলেম ইন্দিরা গান্ধীর ছিল অনবদ্য । রাজনীতির শতরঞ্জে চালই হচ্ছে আসল । চাল ঠিক হলে কিস্তিমাত। চালে ভুল হলে পরাজয়ের গ্ল্যানি বহন অনিবার্য । তীক্ষ্ণবুদ্ধির রাজনীতিক হওয়ার পরেও চাল দিতে গিয়ে ইন্দিরা মাথা ঠিক রাখতে পারেন নি বারকয়েক । ইন্দিরা গান্ধীকে বলা হয় আয়রন লেডি, লৌহ মানবী । লৌহমানবীরও পুত্রস্নেহে হয়েছিল পদস্খলন । সঞ্জয় গান্ধীকে লাই দিতে দিতে দল এবং প্রশাসনের চরম ক্ষতি করেছিলেন । পঁচাত্তর থেকে সাতাত্তর – এই দুই বছরে নিজের দল ও সরকারের ভেতরে ইন্দিরা যত শত্রু তৈরি করেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার জন্য একমাত্র দায়ী দুর্বিনীত সঞ্জয় ।
অজস্র গুণেদোষে বর্ণময় ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, একটা ব্যাপার দিনের আলোর মতোই স্বচ্ছ যে,দেশকে ভালবাসায় কোনও খাদ ছিল না তাঁর মধ্যে । ভারতের অখন্ডতা রক্ষার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন। জীবন দিয়ে মূল্য চোকাতে হতে পারে জেনেও সৈন্য পাঠিয়ে জঙ্গি খালিস্তানিদের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির । শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়েই দেশের অখন্ডতা রক্ষা করেছেন ইন্দিরা । আবার এটাও মিথ্যে নয় যে, পাঞ্জাবের অকালি ও কেন্দ্রের জনতা সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করতে বিচ্ছিন্নতাবাদী ভিন্দ্রানওয়ালাকে একসময় ইন্ধন জুগিয়ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীই । কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফেরার পর এই ভিন্দ্রানওয়ালাই সবথেকে বড় গলার কাঁটা হয়ে ওঠে ইন্দিরার । কাঁটা ইন্দিরা উপড়ে দিয়েছিলেন বটে কিন্তু নিজের জীবন এবং বহু রক্তের বিনিময়ে শান্ত হয়েছিল পাঞ্জাব ।
ইন্দিরা শব্দের অর্থ হল লক্ষ্মী । আর শেষে গান্ধী যোগ করলে নিঃসন্দেহে এর অর্থ দাঁড়ায় সাহস । ইন্দিরার চরম রাজনৈতিক শত্রুও ছিলেন ইন্দিরার সাহসিকতায় মুগ্ধ । ইন্দিরা হলেন ভারতের সেই নারী প্রধানমন্ত্রী , যাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছিল , ” দ্য ওনলি ম্যান ইন হার ক্যাবিনেট ।”
Feature Photo Credit – Renowned Photographer Raghu Rai.Others photos collected.