সাঙ্গ হল শেষ লড়াই । চল্লিশ দিনের যুদ্ধ শেষে মৃত্যুর কাছে পরাজিত নায়ক । প্রয়াত বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দীপাবলীর আলোর খেলার মধ্যেই নিভল জীবনদীপ । জীবনের মঞ্চ ছেড়ে মহাকালের গ্রিনরুমে চিরকালের জন্য চলে গেলেন আমাদের প্রিয় অভিনেতা । পৃথিবীতে রেখে গেলেন নিজের অজস্র কীর্তি । যা সেলুলয়েডের রিলে অক্ষয় হয়ে থাকবে অনেক অনেক দিন । বাংলা চলচ্চিত্র জগতে নক্ষত্রের ছড়াছড়ি । কিন্তু যে দুই তারকার দীপ্তিতে বাকি তারকারা অনেকটাই নিষ্প্রভ তাঁদের একজন মহানায়ক উত্তমকুমার অপরজন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । মহানায়কের পর বাংলা সিনেমায় যদি আর কেউ জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন তবে তিনি সৌমিত্র ছাড়া অন্য কেউই নন ।
বাংলা সাহিত্যের ছাত্র । শিরায় শিরায় সাহিত্য প্রীতি তো ছিলই আর ছিল মঞ্চের নেশা । ছাত্রাবস্থা থেকেই চুম্বকের মতো টানতেন নাট্টাচার্য শিশির ভাদুড়ী । শিশির ভাদুড়ীকে অভিনয়ের গুরু মানতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেলুলয়েডে সৌমিত্রের আরেক স্রষ্টার নাম আমরা সবাই জানি। তিনি বিশ্ববন্দিত পরিচালক সত্যজিৎ রায় । সত্যজিতের ছিল জহুরীর চোখ । জলসাঘরের সেটে বছর চব্বিশের সৌমিত্রকে স্রেফ একপলক দেখেই অপুর সংসারে অপূর্বর রোল কে পাবে, তা ঠিক করে ফেলেন সত্যজিৎ রায় । বাকিটা ইতিহাস । সেই ইতিহাসেরই সমাপ্তি হল দু‘হাজার বিশে হেমন্তের এক বিষণ্ণ দিবসে ।
শুধু সত্যজিৎ রায়ই নন নিজেদের ফিল্মে সৌমিত্রের থেকে সেরা অভিনয়টা বের করে নিতে পেরেছেন মৃণাল সেন, তপন সিংহ , অজয় কর , তরুণ মজুমদার এবং ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো বাংলার শ্রেষ্ঠ পরিচালকেরাও । পর্দায় হোক আর মঞ্চে – অভিনয় করতে ভীষণ ভালবাসতেন । বলতেন, অ্যাক্টিং ছাড়া আর কিছুই তো পারি না। কিন্তু বাঙালি জানে , আমৃত্যু সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল অকৃত্রিম। বন্ধু নির্মাল্য আচার্যকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিন “এক্ষণ” এর মতো উঁচু মানের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । আবৃত্তি ছিল তাঁর নেশা । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আসলে ছিলেন একটি পূর্ণাঙ্গ শৈল্পিক সত্ত্বা ।
১৯৭০য়ে ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান করেন তিনি । ২০০৪–এ রাষ্ট্রের কাছ থেকে পান পদ্মভূষণ সম্মান। ২০১৮তে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান “লিজিয়ঁ অফ অনার’’ প্রদান করে ফরাসী সরকার। বছর ঘুরলেই সত্যজিৎ শতবর্ষ । তার আগেই প্রিয় নায়ককে নিজের কাছে টেনে নিলেন বাংলার শ্রেষ্ঠতম চলচ্চিত্র পরিচালক। আজ থেকে স্রষ্টার পাশেই স্থান নিলেন সৃষ্টি ।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নাগরিক নিউজের শ্রদ্ধাঞ্জলি-