বিখ্যাত বাবা-মা কিম্বা জগদ্বিখ্যাত স্বামীর সূত্রে পাওয়া পরিচয়ে নয় নিজের গড়া আত্মপরিচয়েই নবনীতা দেবসেন আলোকিত। আসলে নবনীতা স্বনামেই ধন্যা। লিখলেন উত্তম দেব-
তিনি বিদ্যাবতী ছিলেন কিন্তু শুষ্ক নন। তিনি নারীবাদীও ছিলেন কিন্তু উচ্চস্বরে তা জানান দেন নি এবং পুরুষের প্রতিও তাঁর কোনও অহেতুক বিদ্বেষ ছিল না। সারস্বত সাধনায় বসে তিনি সত্যিই সরস্বতীর বর লাভ করেছিলেন। আবার সাহিত্যের সাধনাতে নেমেও তিনি ছিনিয়ে এনেছেন সিদ্ধি। আমাদের নবনীতা দেবসেন। বিখ্যাত বাবা-মায়ের বিখ্যাত কন্যা। জন্মসূত্রেই যেন নবনীতার মনটা আকাশের মতো বড়। যাঁর গর্ভধারিণীর নাম রাধারানি দেবী, আর বাবা নরেন্দ্র দেব, সাহস তাঁর সহজাত হবে না তো হবে কার!
মেয়ের কথা বলার আগে মায়ের কথা না বললেই নয়। রাধারানি দেবী ছিলেন কবি। বিংশ শতাব্দীর বিশ-ত্রিশের দশকে ‘অপরাজিতা’ ছদ্মনামে কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মাত্র তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল রাধারানির। বিয়ের বছরেই বৈধব্য! সে সময়ের আর পাঁচজন বাল্যবিধবার মতো নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেন নি রাধারানি দেবী। হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম। লিখে গিয়েছেন একের পর এক কবিতা। পুরুষদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সাহিত্যের আড্ডায়। এমনকি যাঁকে অগ্রজের মতো মানতেন, সেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত আপত্তি করেছেন। শোনেন নি।
কাব্যচর্চা করতে গিয়েই কবি নরেন্দ্রনাথ দেবের সঙ্গে রাধারানির প্রেম। প্রেম গড়ায় বিয়েতে। ১৯৩১-এর ৩০ মে নরেন্দ্রনাথ-রাধারানির বিবাহ। তখন রাধারানি দেবী ২৮ বছরের যুবতী। কবি নরেন্দ্র দেব তেতাল্লিশে পড়েছেন। কলকাতার বাঙালি সমাজকে নাড়া দেওয়ার মতো সব মশলাই মজুত ছিল এই বিয়েতে। সমাজ ও স্বজনদের উপেক্ষা করে ১৫ বছরের বড় প্রেমাস্পদের গলায় মালা দিয়েছিলেন রাধারানি দেবী। তার উপর বিয়ের আসরে নিজেই নিজেকে সম্প্রদান করে সমাজের রক্ষণশীলদের মহলে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন হইচই। পরের দিনের প্রভাতী দৈনিকের পাতায় ছেপে বেরোলো- ‘রাধারানি-নরেন্দ্র দেবের বিবাহ: কন্যার আত্মসম্প্রদান’।
এহেন বিপ্লবী কবিদম্পতির দ্বিতীয় সন্তান নবনীতা। তাঁদের প্রথম পুত্রসন্তান জন্মের কিছুদিন পরেই নিউমোনিয়ায় ভুগে মারা যায়। ১৯৩৮ সালের ১৩ জানুয়ারি কলকাতার হিন্দুস্তান পার্কে কবিদম্পতির নয়া আবাস ‘ভালো-বাসা’য় জন্ম। নরেন্দ্র-রাধারানির কন্যা জন্মলগ্নেই সৌভাগ্যবতী। স্নেহের রাধুর কন্যা হয়েছে জেনে নার্সিংহোমে শুয়েই শরৎচন্দ্র নাম রাখলেন ‘অনুরাধা’। তিনদিন বাদেই চোখ বুজলেন কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিক। এদিকে প্রিয়পাত্র নরেনের মেয়ে হয়েছে শুনেই গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় নাম রাখলেন ‘নবনীতা’। যে নাম একদিন মাকে দিতে চেয়েছিলেন, সেই নামই মেয়ের গলায় পরিয়ে ছাড়লেন গুরুদেব। এই নামেই তাঁকে চিনলাম আমরা।
নবনীতার পরিচয়ের ব্যাপ্তিটা ভাবুন। বিখ্যাত দুই কবি নরেন্দ্রনাথ দেব-রাধারানি দেবীর কন্যা। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের স্ত্রী। কিন্তু বিখ্যাত বাবা-মা কিম্বা জগদ্বিখ্যাত স্বামীর সূত্রে পাওয়া পরিচয়ে নয় নিজের গড়া আত্মপরিচয়েই নবনীতা দেবসেন আলোকিত। আসলে নবনীতা স্বনামেই ধন্যা।
‘বিদূষী’ শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গেই মানায়। ছাত্রী ‘মেধাবী’ বললেও যেন কম বলা হয়। নবনীতার শিক্ষাজীবন হিরের দ্যুতি ছড়ায়। গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ হয়ে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশে অনার্স। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কম্পারেটিভ লিটারেচার’ বিভাগের ফার্স্ট ব্যাচের ছাত্রী এবং ১৯৫৮-য় এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। নবনীতা এরপর মেধার স্বাক্ষর রাখলেন আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকায়। ১৯৬১ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ‘কম্পারেটিভ লিটারেচার’-এ ‘ডিস্টিংকশন’ সহ এমএ। ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি ব্লুমিংটন – থেকে পিএইচডি। এখানেই না থেমে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণার জন্য ছুটলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং শেষে থামলেন গিয়ে কেম্ব্রিজে!
নবনীতা দেবসেনের দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনের সিংহভাগই কেটেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে পড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড, কর্ণেল, কলম্বিয়া ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছিলেন আমেরিকার কলোরাডো কলেজের মেটাগ প্রফেসর ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রাধাকৃষ্ণণ মেমোরিয়াল লেকচারারও।
শিক্ষাবিদ ও বহুভাষী নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে সাধারণ বাঙালির আসল পরিচয় অবশ্যই সাহিত্যের জগতে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্য রচনা থেকে ভ্রমণকাহিনী- কিচ্ছু বাদ দেন নি কবি ও সাহিত্যিক নবনীতা। মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩৮। নবনীতার কলমের ডগা থেকে বেরিয়ে শব্দগুলো যেন বইয়ের পাতায় মুক্তো হয়ে ঝড়ত। লিখতেন ঝড়ঝড়ে বাংলা। বাংলা সাহিত্যে হাল্কা চালে গুরুগম্ভীর বাতচিতে যাঁদের তুলনা নেই, তাঁদের মধ্যে নবনীতা দেবসেন একজন। নবনীতার ছিল অনবদ্য রসবোধ এবং তা পাঠকের কাছে হয়ে উঠত ভীষণ উপভোগ্য।
পুরাণ, লোককাহিনী, রূপকথা ও মহাকাব্য নিয়ে লেখালেখিতে ঝোঁক ছিল নবনীতা দেবসেনের। রামায়ণ ভালবাসতেন। রামকথা নিয়ে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। সীতার চোখ দিয়ে রামকে দেখেছেন। ভ্রমণের বাই উঠলে মাথার ঠিক থাকত না। সারাজীবন ভুগেছেন হাঁপানিতে। ইনহেলার সঙ্গে নিয়েই অকুতোভয়ে চলে যেতেন যেখানে মন চাইত, সেখানে এমনকি হিমশীতল আলাস্কাতেও।
এক কাপড়ে একাই ট্রাকে চেপে চলে গেছেন অরুণাচলের ভারত-তিব্বত সীমান্তে ম্যাকমোহন লাইন দেখতে। ফিরে এসে লিখলেন চমৎকার একটি ভ্রমণকাহিনী ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে’। প্রয়াগে পূর্ণকুম্ভের জনসমুদ্রেও একাই ঘুরে বেড়িয়েছেন নবনীতা। ফিরেই পাঠকদের সামনে উপুড় করে দিলেন নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি। লিখলেন নতুন বই, “করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে”।
জীবনসমুদ্র মন্থন করে অমৃত আহরণ করেছেন নবনীতা দেবসেন। গরলটুকুও ধারণ করেছেন নীরবে, বিনা অভিযোগে। নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করতে ভালবাসতেন। এমনকি নিজের কষ্ট নিয়ে কৌতুক করতেও পিছপা ছিলেন না তিনি। ১৯৫৯ সালে অমর্ত্য সেনকে ভালবেসে বিয়ে। ছিয়াত্তরে বিচ্ছেদ। ততদিনে নবনীতা দুই কন্যাসন্তানের জননী। ভেতরে ক্ষোভ-অভিমান কিছু থাকলেও কখনও ঠোঁট ফুলিয়ে প্রকাশ করেন নি। দাম্পত্যের বিচ্ছেদের পরেও কীভাবে প্রাক্তনের সম্মান রক্ষা করতে হয়, তা শিখিয়ে গেছেন নবনীতা দেবসেন।
খ্যাতি, সম্মান, পুরস্কার, গুণের স্বীকৃতি ও মানুষের ভালোবাসা- সব পেয়েছেন জীবনে। বিশ্বাস করতেন, লিখলে সমাজের ভালোর জন্যই লেখা উচিত। বলেছেন, “এমন কিছু লিখব না যাতে সমাজের ক্ষতি হয়। এমন কোনো লেখা লিখে লাভ নেই যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কোনো উপকার না হয়। আমার লেখা থেকে যেন কোথাও কোনো অকল্যাণ না হয়।”
প্রকৃত জ্ঞান ও মেধা যে মানুষকে নম্র করে, নবনীতা দেবসেন ছিলেন তার দৃষ্টান্ত। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন নিতান্তই আটপৌরে। হেসে-গড়িয়ে আলাপ করতেন অচেনা লোকের সঙ্গেও। রসিক তো ছিলেনই, ছিলেন দিলখোলাও। বাজারের মাছ বিক্রেতা থেকে ক্লাসের ছাত্রছাত্রী- সবার ছিলেন প্রিয় দিদি। কর্কট রোগ যখন তাঁর শরীরকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, তখনও নবনীতার মুখে ভয়, উদ্বেগ, বিরক্তির ছাপ দেখেন নি কাছের মানুষেরা। বরং নিজের আসন্ন মৃত্যু নিয়েও করে গেছেন রসিকতা। ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর অনন্তের পথে পাড়ি জমান সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ নবনীতা দেবসেন।
Feature graphic is representational and designed by NNDC.