রাজনৈতিক শত্রু বলে বিরোধীদের কখনও বিষ নজরে দেখেন নি ডঃ বিধানচন্দ্র রায়
বিরোধী দলনেতা জ্যোতি বসুর জন্য মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের দরজা থাকত সবসময় খোলা
‘ খালি পেটে থেকে শরীর খারাপ করে বিধান রায়কে হারাতে পারবে না । গাড়িতে উঠে এসো । কয়েকটা লুচি আছে । খাও । খেয়ে সভায় গিয়ে বিধান রায়কে যত খুশি গালাগালি কর । ‘ জানেন কাকে রাস্তা থেকে নিজের গাড়িতে তুলে লুচি খাওয়ার জন্য সাধাসাধি করছেন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান রায় ? ৩২ বছরের ছোট বিরোধী দলনেতাকে । নেতাটির নাম জ্যোতি বসু । কমিউনিস্ট পার্টির বিধায়ক । বিধানসভায় বিরোধী দলের নেতা । রোজ বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে বিধান রায়ের সরকারকে তুলোধুনো করা যাঁর কাজ । রাজনীতিতে বিরোধী হলেই কাঁচা খিস্তি দিয়ে বধ করা , আট-দশটা মিথ্যা মামলা ঠুকে বেকায়দায় ফেলা অথবা টাকার টোপ দিয়ে দলে টানা – তখনকার বাংলায় এ’সবের চল হয় নি । বিধান রায়ের সরকারকে নাকাল করতে জোতি বসুর দল যে সঙ্কোচ করত পরিস্থিতি মোটেই তেমন ছিল না । দু’পয়সা ভাড়া বাড়ানোয় এক ডজন ট্রাম পুড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল কমিউনিস্টরা । ১৯৫৯ এর খাদ্য আন্দোলনে কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে । ৩১ আগষ্ট কলকাতায় বামেদের ডাকা ভুখা মিছিল হিংসাত্মক হয়ে উঠলে পুলিশের লাঠি পেটায় ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছিল বলে অভিযোগ । ৩১ আগষ্ট আজও স্মরণ করেন বামপন্থীরা । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৩ সালের একুশে জুলাইয়ের যতটা গুরুত্ব বামপন্থীদের কাছে ৫৯ এর ৩১ আগষ্টের রাজনৈতিক গুরুত্ব তার চেয়ে কোনও অংশে কম নয় ।
বিধান রায়ের ১৪ বছরের শাসনে বামপন্থীরা বিধানসভায় ৫৭ থেকে ৮০ হয়েছে । ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে চৌরঙ্গি আসনে সিপিআইয়ের মহম্মদ ইসমাইলের কাছে হারতে হারতে জিতেছিলেন বিধান রায় । পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে জ্যোতি বসুর উত্থান পর্ব হল বিধান রায়ের জামানা । বিধানসভার ভেতরে সফল বিরোধীনেতা হিসেবে জ্যোতি বসুর যখন আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে তখন ট্রেজারি বেঞ্চের ক্যাপ্টেনের নাম ডঃ বিধানচন্দ্র রায় । জঙ্গি আন্দোলনের কারণে কমিউনিস্টদের প্রতি বিধান রায়ের একটা উষ্মা ছিল বটে কিন্তু কখনও বিরোধীদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হতে দেখা যায় নি তাঁকে ।
হাউসে বিতর্কের সময় জ্যোতি বসু কখনও ছেড়ে কথা বলতেন না মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়কে । সেই জন্য বিধানসভার ভেতরে অথবা রাইটার্সে সাংবাদিকদের সামনে বিধান রায় জ্যোতির বাপান্ত করেছেন এমন প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি । জ্যোতি বসুর বাবা নিশিকান্ত বসু ছিলেন ডঃ বিধান রায়ের বন্ধু । নিশিকান্ত বসু ছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক । লোকে তাঁকে হোমিওপ্যাথির বিধান রায় বলত । সেই সূত্রে ৩২ বছরের ছোট জ্যোতির প্রতি একটা পিতৃসুলভ স্নেহ ছিল বিশাল হৃদয় মানুষটির । রাজনৈতিক মতপার্থক্য বা বামপন্থীদের জঙ্গি আন্দোলন দু’জনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাঝে কখনও দেওয়াল তুলে দাঁড়াতে পারে নি । তাই তো তাঁর বিরুদ্ধেই সভায় মঞ্চ কাঁপিয়ে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছে যেই ছেলে , তাঁর উস্কোখুস্কো চুল আর মলিন মুখ দেখে গাড়ি থামিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী । গাড়িতে তুলে লুচি খাইয়ে ছেলের পেট ভরিয়ে বলেন, যাও এবার গিয়ে আমাকে গালাগাল কর গে জ্যোতি ।
দেহের বিশালতার মতোই ছিল তাঁর মনের বিশালতা । রাজনৈতিক বিরোধীদের প্রতি । বিরোধী দলের নেতার প্রতি যে সম্মান , ভালবাসা এবং ঔদার্য তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেসব অলীক কল্পনা মনে হয় ।
অনেকেই বলেন মাথায় বিধান রায়ের আশীর্বাদ না থাকলে পশ্চিমবঙ্গের সমকালীন রাজনীতিতে এতটা স্পেস পেতেন না জ্যোতি বসু । বিরোধী নেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়ে দিচ্ছেন শাসকদলের প্রধান – পৃথিবীর ইতিহাসে এমন উদাহরণ দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। অনেক ব্যাপারেই একে অপরের পরামর্শ নিতেন বলে শোনা যায়। ১৯৫০ এ কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর দলের আরও অনেক নেতার মতোই জেল থেকে ছাড়া পান জ্যোতি বসু । ছাড়া পাওয়ার পরেও জ্যোতি বসুর পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে থাকত সাদা পোশাকের পুলিশ । শেষে রেগেমেগে একদিন অভিযোগ জানাতে রাইটার্সে সটান বিধান রায়ের কাছে হাজির জ্যোতি বসু । জ্যোতি বসুর সামনেই আইজিকে ডেকে কারণ জানতে চান মুখ্যমন্ত্রী । বিধান রায়ের হস্তক্ষেপে জ্যোতিবাবুর পিছু ছাড়ে পুলিশ । বিধান রায়ের কাছে জ্যোতির ছিল অবারিত দ্বার । এমনকি নিজের দলের নেতাদের থেকেও জ্যোতি বসুকে সময় দিতেন বেশি । শোনা যায় একবার নিজের বাসায় কয়েকজন ব্যবসায়ীকে বসিয়ে রেখে জ্যোতি বসুর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছিলেন বিধান রায় । তদ্বির করতে আসা ব্যবসায়ীরা বিরক্ত হচ্ছিলেন । জ্যোতি বসু বিদায় নিলে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে ঢুকে এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা কিঞ্চিৎ অসন্তোষ প্রকাশ করলে ডঃ বিধান রায় রেগে গিয়ে বলেন , ‘ আপনারা জানেন আমি কার সঙ্গে কথা বলছিলাম ? বিরোধী দলনেতা জ্যোতি বসুর সঙ্গে । আপনারা এসেছেন নিজের স্বার্থের কথা বলতে । আর উনি এসেছিলেন মানুষের সমস্যার কথা বলতে ‘।
দূর থেকে রোগীর কাশির আওয়াজ শুনে রোগ শনাক্ত করতে পারতেন ডঃ বিধান রায় । হতে পারে অতিকথন । কিন্তু মানুষের বিশ্বাস ছিল তেমনই । রোগ নিরাময় নিয়ে বিধান রায়ের গল্প বলে শেষ করা সম্ভব নয় । মানুষ তাঁকে ধন্বন্তরি মনে করত । ডাক্তার হিসেবে বিধান রায় ছিলেন কিংবদন্তী । কিন্তু তাঁর হৃদয় ছিল আরও বড় । হয়ত তা আকাশও ছুঁয়েছিল । উচ্চতায় একটু খর্ব হলে ঘাড় উঁচু করে তাকাতে হত বিধান রায়ের মুখের দিকে । দেহের বিশালতার মতোই ছিল তাঁর মনের বিশালতা । রাজনৈতিক বিরোধীদের প্রতি । বিরোধী দলের নেতার প্রতি যে সম্মান , ভালবাসা এবং ঔদার্য তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেসব অলীক কল্পনা মনে হয় । জন্মদিনেই মৃত্যু বরণ । তাও সজ্ঞানে কথা বলতে বলতে । জগতে বিরলতম ঘটনা । দেশবন্ধু সহধর্মিণী বাসন্তী দেবী বলেছিলেন, ‘ বিধান পুণ্যাত্মা । তাই ভগবান বুদ্ধের মতো একই দিনে আসা-যাওয়া । বিদ্বেষমুক্ত এমন যাঁর অন্তর তিনি যদি পুণ্যাত্মা না হন তবে জগতে পুণ্যাত্মা কে !