সাউথ-এশিয়া ডেস্ক: যে কোনও মুহূর্তে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় বড় রকমের হামলার মুখোমুখি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দেশটির সংখ্যালঘু সংগঠনগুলির নেতৃবৃন্দ। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সংগঠন ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে শুক্রবার রাজধানী ঢাকা সহ বহু জায়গায় বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল ও সংগঠনের ব্যানারে বড় বড় মিছিল হয়েছে। তাদের অভিযোগ, ইসকন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ইসকন মুসলমান নারীদের ধর্ষণ, ধর্মান্তরণ ও আলেম-উলেমাদের গুম-খুনের সঙ্গে যুক্ত বলেও মারাত্মক অভিযোগ তুলেছে গোঁড়া ইসলামপন্থীরা।

এমনিতেই ইউনূসের জামানায় বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তলানিতে। চব্বিশের ৫ অগাস্টের পর থেকেই একাধিক ঘটনার জেরে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষ। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় প্রভু এখনও কারাগারে। সনাতনীদের এমনকি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যারা সুফি তরিকায় বিশ্বাসী, তাদের উপরেও প্রতিনিয়ত হামলা-মামলা চলছেই। গত আঠারো মাসে বাংলাদেশে আড়াইশোর বেশি মাজার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বিভিন্ন গোঁড়া ইসলামপন্থী সংগঠনের সদস্যরা। এক সুফি সাধকের দেহ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দিয়েছে তৌহিদি জনতা। গ্রামে-গঞ্জে বাউল গানের আসরে হামলা হচ্ছে। মঞ্চে উঠে গায়ক-গায়িকাদের মারধর করেও রেহাই পেয়ে যাচ্ছে মৌলবাদীরা।
তবে চলতি অক্টোবর মাসে পরিস্থিতি বিগত এক বছরের মধ্যে সবথেকে খারাপ ও উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা। আগামী দুই মাসে পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। সামাজিক মাধ্যম থেকে প্রকাশ্য সভা-সমাবেশে, ওয়াজ মাহফিল ও জুম্মার নামাজের খুতবায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে ভাঙচুর-হামলা এবং মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা প্রায় প্রতি মাসের ঘটনা। কিন্তু যখন সামাজিক মাধ্যম, ওয়াজ মাহফিল বা সভা-সমাবেশ থেকে প্রকাশ্যে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, তখন পুলিশকে সচরাচর কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায় না।

অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে ইসকনের উপস্থিতি সমাজের একটা অংশের মানুষের গাত্রদাহের কারণ। বিদেশে বসে তাদের নিয়মিত উস্কানি দিয়ে আরও বেশি ক্ষেপিয়ে তুলছেন পিনাকী ভট্টাচার্য, ইলিয়াস হোসেন, কনক সরওয়ারের মতো হাসিনা ও হিন্দু বিরোধী ব্লগার-ইউটিউবারেরা। এখন বাংলাদেশে বসেই অবাধে এই কাজটি করছেন আমার দেশ পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং অ্যাক্টিভিস্ট গৌতম দাস সহ আরও কয়েকজন। সাম্প্রতিক সময়ে ইসকন নিষিদ্ধের দাবিকে রীতিমতো সিরিয়াস রাজনৈতিক ইস্যু করে তোলা হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে শরিয়ার শাসন কায়েম করতে চায়, এমন কট্টরপন্থী ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলির সবাই আজ ইসকনের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে। জামাতে ইসলামি ও বিএনপির মতো বড় দল এখনও অফিসিয়ালি এই দাবি না তুললেও দলদুটির কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ইতিমধ্যেই ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন।
২০২১ সালের শারদীয়া দুর্গোৎসবের মহাষ্টমীর দিন কোরআন অবমাননার ধুয়ো তুলে কুমিল্লায় পুজো মন্ডপগুলিতে তান্ডব চালিয়েছিল সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার জনতা। পরদিন নোয়াখালি শহরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়গুলি আক্রান্ত হয়। নোয়াখালির চৌমুহনীতে মন্দির রক্ষা করতে গিয়ে উন্মত্ত দাঙ্গাকারীদের হাতে খুন হয়েছিলেন ইসকনের দুই সন্ন্যাসী সহ সংগঠনটির পাঁচজন সদস্য। পরিস্থিতি এবার তার থেকেও ভয়াবহ হতে পারে বলে ভয় পাচ্ছেন ইসকন-বাংলাদেশের নেতৃত্ব। সবথেকে আশঙ্কার হল, বাংলাদেশে এখন যে কোনও অপরাধে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কেউ অভিযুক্ত হলেই ইসকন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের নাম জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি হিন্দু ছেলের সঙ্গে মুসলিম মেয়ের বিচ্ছিন্ন কয়েকটি প্রণয়জনিত ঘটনার উপরেও সাম্প্রদায়িক রঙ চড়াচ্ছে উগ্র ইসলামপন্থী দলগুলি।

গাজিপুরে মসজিদের এক খতিবকে গুম ও হত্যার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে ইসকনের বিরুদ্ধে। ঘটনাটিকে তাদের বিরুদ্ধে চলমান সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের একটি অংশ বলে দাবি করেছে ইসকন কর্তৃপক্ষ। গাজিপুরের টঙ্গীর টিএন্ডটি এলাকার বিটিসিএল জামে মসজিদের পেশ ইমামের নাম মাওলানা মহিবুল্লাহ মাদানী। মাদানী নামাজের জামাতে খুতবা দেওয়ার সময় নিয়মিত ইসকনের নামে বিষোদ্গার করতেন। গত বুধবার (২২ অক্টোবর) ফজরের নামাজের পর থেকে বেপাত্তা হয়ে যান তিনি। খোঁজ না পেয়ে বুধবার রাতে টঙ্গী পূর্ব থানায় ‘মিসিং ডায়েরি’ করেন মাদানীর পরিবারের লোকেরা। বৃহস্পতিবার সকালে পঞ্চগড় সদর থানার হেলিপ্যাড বাজার এলাকা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশ।
রহস্যে ঢাকা এই ঘটনার পুরো দায় চাপানো হচ্ছে ইসকনের ঘাড়ে! ইসকনের সদস্যরা মাওলানা মহিবুল্লাহ মাদানীকে অপহরণ করে ভারতে পাচারের ছক কষেছিল বলে অভিযোগ করছে কট্টরপন্থী ইসলামিক দলগুলি। পুলিশ তদন্তে নেমে ঘটনার সঙ্গে এখনও পর্যন্ত ইসকনের জড়িত থাকার কোনও আলামত পায় নি। কিন্তু তারপরেও এই ঘটনায় ইসকনের বিরুদ্ধে গুম ও হত্যার চেষ্টার মামলা দিতে পুলিশের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে একটি মহল। গাজিপুরের ঘটনার পর থেকে যে ভাষায় মিটিং-মিছিলে ইসকন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখা হচ্ছে, তা এক কথায় মারাত্মক। ইসকনের ভক্ত-শিষ্য এবং ইসকনের সঙ্গে যুক্ত হিন্দুদের ধরে ধরে জবাই করা হবে বলে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছে মহিবুল্লাহ মাদানীর ছেলে সহ আরও কয়েকজন হুজুর। কারও বিরুদ্ধেই কোনও ব্যবস্থা নেয় নি পুলিশ।
ইসকনকে জঙ্গি সংগঠন আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করার দাবিতে যারা সোচ্চার, তাদের বিরুদ্ধেই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। বিগত সরকারের আমলে এদের অনেকেই জেলে ছিল। মুহাম্মদ ইউনূসের জামানায় জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এরাই আবার স্বমূর্তি ধারণ করেছে। আতাউর রহমান বিক্রমপুরী নামে যে ব্যক্তি ইসকন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লাগাতার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার করে যাচ্ছে, সে নিজেই ‘আইসিস’-এর মতো জঙ্গি সংগঠনে জড়িত থাকার অভিযোগে দীর্ঘদিন জেলে ছিল।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের সন্দেহ, পেছন থেকে কারও ইন্ধনে ইসকন ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছে ইসলামপন্থী দলগুলির একটি অংশ। আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি রমজান মাস শুরুর আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু নির্বাচন আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে ঘোরতর সংশয় রাজনৈতিক মহল। নির্বাচন বানচাল করাই যদি দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির কারণ হয়ে থাকে, তবে নভেম্বর-ডিসেম্বরে ইসকন ও হিন্দু বিরোধী সাম্প্রদায়িক প্রচারণা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।