কোম্পানির বিধর্মী সাহেবরাও কালীঘাটের কালীর কৃপা প্রার্থনা করতেন। শক্তিপীঠ কালীঘাট মন্দিরের ইতিহাস স্বল্প কথায় এই প্রতিবেদনে-
কালীর শহর কলকাতা। কলকাতার নামের মধ্যেই কালী। কালীক্ষেত্র কালীঘাট থেকেই কলকাতা নামের উৎপত্তি বলে অধিকাংশ গবেষক মনে করেন। কালীঘাটের শহর কলকাতায় বিলিতি সাহেবরাও ভয়ে-ভক্তিতে মাকালীর পায়ে মাথা নোয়াতেন, এমন প্রমাণ আছে। কালীঘাট ছাড়াও কলকাতা জনপদে আরও কয়েকটি প্রাচীন কালীমন্দির আছে, যাদের ঘিরে রহস্য বড় কম নয়। তবে কালীঘাটকে বাদ দিয়ে কলকাতার কালী মাহাত্ম্য অসম্পূর্ণ।

একান্ন শক্তিপীঠের এক পীঠ এই কালীঘাট। ‘পীঠমালা’ তন্ত্র মতে এখানে সতীর ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি পড়েছিল। পুরাণ থেকে চোখ সরিয়ে ইতিহাসের পাতায় নজর রাখলেও আমরা দেখতে পাবো, কালীঘাট কালীমন্দির কত প্রাচীন! পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত মনসামঙ্গল কাব্যে কালীঘাটের উল্লেখ পাই। ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে উল্লেখ আছে, ধনপতি সওদাগর পুত্র শ্রীমন্তকে নিয়ে সপ্তডিঙায় চড়ে আদিগঙ্গা পাড়ি দেওয়ার সময় কালীঘাটে নেমে মায়ের পুজো দিয়েছিলেন।
কালীঘাট মন্দিরের উৎপত্তি নিয়ে আরও অনেক লোকশ্রুতি আছে। শোনা যায়, ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে আদিগঙ্গার ধারে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দেবী কালীর পুজো করতেন ভুবনেশ্বর ব্রহ্মচারী নামে এক সাধক। পরে নিজের জামাই আগমাচার্য ভবানীদাস চক্রবর্তীর হাতে পুজোর ভার তুলে দেন তিনি। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের কাকা রাজা বসন্ত রায় বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে এখানে একটি পাকা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
কালের নিয়মে সেই মন্দির জীর্ণ হয়ে পড়লে ১৮০৬ সালে নতুন মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নেন কলকাতার বিখ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কর্তা সন্তোষ রায়চৌধুরী। তবে নতুন মন্দির দেখে যেতে পারেন নি তিনি। সন্তোষ রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পর ১৮০৯ সালে মন্দিরের নির্মাণকাজ শেষ করেন তাঁর পুত্র রামনাথ ও ভাইপো রাজীবলোচন। মন্দিরটি নির্মাণে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের খরচ হয়েছিল তিরিশ হাজার টাকা। এই মন্দিরেই এখনও পর্যন্ত মায়ের পুজো চলছে।
১৯০১ সালে লিখিত একটি নথি থেকে আমরা জানতে পারি কালীঘাট নিয়ে অন্য একটি তথ্য। এই কালীক্ষেত্রের আদি মন্দির নাকি ছিল বর্তমান স্ট্র্যান্ড রোডে পোস্তা বাজারের কাছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর ভূমিকম্পে মন্দিরটি মাটিতে বসে গেলে বিগ্রহ তুলে এনে ভবানীপুর অঞ্চলে আদিগঙ্গার পাড়ে আজকের কালীঘাটে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

কলকাতার বাবুসমাজ থেকে সাধারণ জনগণ সুখে-দুঃখে সবাই কালীঘাটের দেবীর কাছে হত্যে দিতেন। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে মূলতঃ কালীঘাটকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হত কলকাতার হিন্দু সমাজের আধ্যাত্মিক জীবন। এমনকি কোম্পানির বিধর্মী সাহেবরাও কালীঘাটের কালীকে অবহেলা করার সাহস পেত না। মায়ের মাহাত্ম্যে মোহিত হয়ে কালীঘাটের মন্দিরে পুজোও দিতেন সাহেবরা। বলিস্থলে ফিরিঙ্গিদের মানত করা পাঁঠাই সবার প্রথমে থাকত। এই প্রসঙ্গে রাজনারায়ণ বসু এক জায়গায় লিখে গেছেন, “কালীঘাটের কালী মন্দিরে প্রথমে কোম্পানির পূজা হইয়া তৎপরে অন্যান্য লোকের পূজা হইত।”
সেকালে কলকাতার বাঙালি ধনাঢ্যরা কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে হাত উপুড় করতে কৃপণতা করতেন না। সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়ি থেকে রোজ মায়ের পুজোর নৈবেদ্য আসত। পাইকপাড়ার রাজবাড়িও মায়ের পুজোয় শরিক হত। মায়ের রোজকার আমিষ ভোগের যাবতীয় খরচ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্র সিংহ। মায়ের সোনার জিভও গড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। শোনা যায় কালীঘাটে প্রায় রোজই পুজো দিতে আসতেন শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব। মায়ের গলায় সোনার মুন্ডুমালা গড়িয়ে দিয়েছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ। শক্তিপীঠ কালীঘাটের দক্ষিণা কালীর ভক্ত ছিলেন নেপালের প্রবল প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী জঙ্গ বাহাদুর রানাও। দেবীর মাথায় যে সোনার ছাতা দেখা যায়, তা বানিয়ে দিয়েছিলেন জঙ্গ বাহাদুর।

কালীঘাটে মা নিত্য বিরাজিতা। শাস্ত্রাচার মেনে হয় দেবীর নিত্যপুজো। ভক্তের আনাগোনায় প্রতিদিন মুখরিত থাকে অন্যতম এই শক্তিপীঠ। কলকাতায় প্রথমবার পা দিয়ে কালীঘাটে মাকে দর্শন না করে ফেরেন না ধর্মপ্রাণ কোনও হিন্দু। কার্তিক অমাবস্যায় হয় মায়ের বিশেষ পুজো। সেদিন মন্দির চত্বরে মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা থাকে না।