বিশেষ প্রতিবেদন: বন্যা দুর্গতদের ত্রাণ দিতে গিয়ে সোমবার দুপুরে ডুয়ার্সের নাগরাকাটায় আক্রান্ত হয়েছেন মালদহ উত্তরের বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু ও শিলিগুড়ির বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ। খগেন মুর্মুকে ধরে যেভাবে মারধর করা হয়েছে তাতে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হতে পারতেন। রক্তাক্ত দেহে প্রায় অচৈতন্য সাংসদ গাড়িতে বসে আছেন, এই ভিডিও ভাইরাল। সারা দেশের মানুষ দেখলেন একজন আদিবাসী সাংসদকে ধরে একদল মানুষ পেটাচ্ছে এবং তিনি রক্তাক্ত দেহে মুমূর্ষু অবস্থায় ঘটনাস্থল থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন!
সাংসদ ও বিধায়ক দু’জনেই শিলিগুড়িতে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। খগেন মুর্মুর চোট গুরুতর বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। মঙ্গলবার আহত সাংসদকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষয়টা নির্ভেজাল সৌজন্য ও মানবিকতা হলে মুখ্যমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ স্বাগত জানানোর মতো। কিন্তু ন্যক্কারজনক ঘটনার ৪৮ ঘন্টা পরেও সাংসদ-বিধায়কের উপর হামলায় জড়িতরা কেউ ধরা পড়ল না! তাই মুখ্যমন্ত্রীর এই সৌজন্যকে খোঁচা দিতে ছাড়ছেন না বিজেপি নেতৃত্ব।

সোমবার নাগরাকাটার বামনডাঙ্গায় দিনে-দুপুরের ঘটনা। কয়েকশো মানুষ সাংসদ খগেন মুর্মু ও বিধায়ক শঙ্কর ঘোষের গাড়িবহর ঘিরে ফেলে হামলা চালাল। পুলিশের সামনেই লাঠি দিয়ে খগেন মুর্মু ও শঙ্কর ঘোষের উপর হামলা হয়েছে। এবং যারা হামলা করেছে, তাদের মুখ ও গতিবিধি ভিডিওতে দৃশ্যমান। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, সেদিন সাংসদ ও বিধায়কের উপর যারা হামলা করেছিল ও ঘটনায় উস্কানি দিয়েছিল, তাদের গ্রেফতার করতে এত সময় লাগছে কেন?
আক্রান্ত সাংসদকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যাওয়াটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর তরফে নিছক সৌজন্য প্রদর্শনের বিষয় নয়, এটা তাঁর কর্তব্যের মধ্যেও পড়ে। কিন্তু রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য আরও বেশি কর্তব্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা ও আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের কঠোর হাতে দমন করা। নাগরাকাটায় যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন তাঁরা কেন্দ্র ও রাজ্যের আইন প্রণেতা। যে রাজ্যে আইন প্রণেতাদেরই পুলিশ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, সেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সাধারণ জনগণ কীভাবে আশ্বস্ত থাকবেন? যতটা তৎপরতার সঙ্গে মমতা আহত খগেন মুর্মুকে দেখতে গেলেন, ততটা তৎপরতার সাথে সাংসদের উপর হামলাকারীদের গ্রেফতারে পুলিশকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন কি? ঘটনার ৪৮ ঘন্টা পার! মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পরেও পুলিশ একজনকেও গ্রেফতার করতে পারল না! ঘটনাটা আশ্চর্য হওয়ার মতো নয় কি?
সোমবার যে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য, সাংসদ খগেন মুর্মু, ফালাকাটার বিধায়ক দীপক বর্মণ, শিলিগুড়ির বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ ও জলপাইগুড়ির বিজেপি সাংসদ ড. জয়ন্ত রায় নাগরাকাটার বানভাসি এলাকা পরিদর্শনে যাবেন, এই খবর জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশ প্রশাসন ভাল করেই জানত। তারপরেও কীভাবে বামনডাঙ্গায় সাংসদ ও বিধায়কের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে একপাল জনতা? রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, পুরো হামলার ঘটনাটাই একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। বিজেপির জনপ্রতিনিধিরা বন্যাকবলিত এলাকায় পৌঁছানো মাত্রই ডিআইজি ও এসপি এলাকা ত্যাগ করেন বলে বিধায়ক দীপক বর্মণ অভিযোগ করেছেন।

যে গ্রামে খগেন-শঙ্কর আক্রান্ত হয়েছেন, আক্রমণকারীরা কেউ সেই গ্রামের নয়, পাশের গ্রাম থেকে এসেছিল। এই অভিযোগ করেছেন খোদ শঙ্কর ঘোষ। বিজেপির সাংসদ ও বিধায়কের উপর হামলার ঘটনায় আদিবাসীরা নয় একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দুষ্কৃতীরা জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সামাজিক মাধ্যমে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজনের ছবি ও পরিচয় পোস্ট করে শুভেন্দু দাবি করেছেন, এরাই নাগরাকাটায় পরিকল্পনা করে খগেন মুর্মু ও শঙ্কর ঘোষের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। তবে কি বিজেপির জনপ্রতিনিধিদের উপর হামলার কথা জেলা পুলিশ আগে থেকেই জানত? রাজ্য বিজেপির অভিযোগ, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের ইশারাতেই হামলা হয়েছে এবং ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে আগাম জানতে পেরেই ঘটনার সময় নিষ্ক্রিয় ছিল পুলিশ।
প্রশ্ন হল, যখন বন্যা-ধসে উত্তরবঙ্গের পাহাড় ও তরাই-ডুয়ার্সের একটা বড় অংশ বিপর্যস্ত, তখন কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে নাগরাকাটায় বিজেপির জনপ্রতিনিধিদের উপর দলের লোকদের লেলিয়ে দিলেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব? উত্তরবঙ্গ বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। ডুয়ার্সের নাগরাকাটা বিধানসভা বিজেপির দখলে। বিজেপি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন তাই দুর্যোগের সময় রাজনীতি করতে গিয়ে বিজেপির নেতারা স্বতঃস্ফূর্ত জনরোষের শিকার, এই রকম একটা ছবি তুলে ধরতেই তৃণমূল পরিকল্পনা করে খগেন মুর্মু ও শঙ্কর ঘোষের উপর হামলা চালিয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। কেন ৪৮ ঘন্টা পরেও হামলাকারীরা অধরা, তা আর কারও কাছেই অস্পষ্ট থাকছে না।
Feature image : NNDC.