সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দুর্নীতি মামলা ঝুলিয়ে রাখতে চাইবে রাজ্য সরকার, মামলা ঝুলে থাকলেই মুখ রক্ষা মমতার

সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দুর্নীতি মামলা ঝুলিয়ে রাখতে চাইবে রাজ্য সরকার, মামলা ঝুলে থাকলেই মুখ রক্ষা মমতার


গত মঙ্গলবার (৭ মে,২০২৪) দ্বিতীয় দিনের শুনানি শেষে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের উপর যথারীতি স্থগিতাদেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পার্দিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্র-র ডিভিশন বেঞ্চ। সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দেওয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে আপাতত হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মমতা ও অভিষেকের কথা শুনে যদিও মনে হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টে তাঁরা জিতেই গেছেন। অথচ মামলার শুনানি চলাকালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের আইনজীবী যে শীর্ষ আদালতের সামনে নিয়োগ প্রক্রিয়ার দুর্নীতির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন, সেই সত্য জনগণের সামনে চেপে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর গুণধর ভাইপো।

হাইকোর্টের রায়ে ২০১৬-র নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এস‌এসসি-র করা পুরো প্যানেলটাই বাতিল হয়ে যাওয়ায় ওই প্যানেলের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের সকলের‌ই চাকরি খারিজ হয়ে গেছে। এদের মধ্যে যাঁরা প্যানেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরে চাকরি পেয়েছেন, তাদের চাকরি তো গেছেই এমনকি চার সপ্তাহের মধ্যে ১২ শতাংশ সুদ সমেত বেতনের পুরো টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ না আসলে লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে তা কার্যকর করতে হত সরকারকে। ১৬ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার পরবর্তী শুনানি। ততদিন পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ থাকছে।

এস‌এসসি-র ২০১৬-র প্যানেলে বেআইনি নিয়োগের রাস্তা প্রশস্ত করতে ২০২২ সালে রাজ্য মন্ত্রিসভা অতিরিক্ত শূন্যপদ বা ‘সুপারনিউমেরিক পোস্ট’ তৈরিতে সম্মতি দিয়েছিল। এ’খানে এসে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী সহ গোটা রাজ্য ক্যাবিনেট ফেঁসে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরির মামলায় সিবিআই রাজ্য মন্ত্রিসভার যে কোনও সদস্যকে প্রয়োজনে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে বলে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বিরোধীরা কটাক্ষ করে বলছেন, ২৬ হাজার জনের চাকরি বাঁচানোর চাইতে নিজের গ্রেফতার এড়াতেই বেশি উদগ্রীব মুখ্যমন্ত্রী। সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দেওয়ায় ১৬ জুলাই পর্যন্ত সিবিআইয়ের জেরার হাত থেকে রক্ষা পেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ব্রাত্য বসু। বৈধ বা অবৈধ যে’ভাবেই নিয়োগ পান না কেন, নিয়োগপ্রাপ্তদের কারোরই আপাতত চাকরি যাচ্ছে না। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বলেছেন, “এস‌এসসি যোগ্য ও অযোগ্য বিভাজন করতে পারলে পুরো প্যানেল বাতিল ন্যায্য নয়। পুরো প্যানেল বাতিল হলে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে অভিঘাত সৃষ্টি হবে, আদালত তা অস্বীকার করতে পারে না।” আমরা সকলেই চাই, যোগ্যদের চাকরি বাঁচুক। কিন্তু রাজ্য সরকার ও এস‌এসসি কি আন্তরিকভাবে তাই চায়? এস‌এসসি যদি যোগ্য-অযোগ্যদের তালিকা হাইকোর্টের সামনে রাখতে পারত, তাহলেই তো পুরো প্যানেল বাতিল করার নির্দেশ দিতে হত না ডিভিশন বেঞ্চকে ।

সুপ্রিম কোর্টে দুর্নীতির কথা স্বীকার করে নিয়েছে এস‌এসসি

কোন উদ্দেশ্যে দীর্ঘ সময় পাওয়ার পরেও স্কুল সার্ভিস কমিশন যোগ্য-অযোগ্যদের আলাদা করে নি, তা বুঝতে কারও অসুবিধে হচ্ছে না। রাজ্য সরকার ও রাজ্যের শাসকদল চাইছে, যে কোনও মূল্যে অযোগ্যদের চাকরি বাঁচাতে। কালীঘাটের চাপেই যে যোগ্য-অযোগ্য পৃথকীকরণের কাজ এস‌এসসি এতদিন এড়িয়ে গেছে, তা সুপ্রিম কোর্টে এস‌এসসির ভূমিকাতেই প্রমাণিত। সুপ্রিম কোর্টের সামনে এস‌এসসির আইনজীবী জানিয়েছেন, যোগ্য আর অযোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের পৃথক করা সম্ভব। শীর্ষ আদালতে এস‌এসসি এ‌ও স্বীকার করেছে, ৮,৩২৪ জনের নিয়োগ নিয়ম মেনে হয় নি। সুপ্রিম কোর্টের সামনে যদি এস‌এসসির আইনজীবী মিথ্যে না বলে থাকেন, তবে ধরে নিতে হয়, ১৭ হাজার ৪২৯ জনের চাকরি বৈধ। রাজ্যের সবাই চান, বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের সকলের চাকরি থাকুক।

সুপ্রিম কোর্ট প্যানেল বাতিল, বেতন ফেরত ও রাজ্য ক্যাবিনেটের সদস্যদের জেরার উপর অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ দিলেও নিয়োগ মামলায় সিবিআইকে তদন্ত চালিয়ে যেতে বলেছে। যাঁদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ, তাঁদের মুচলেকা দিতে বলেছে দেশের শীর্ষ আদালত। অভিযুক্ত নিয়োগপ্রাপ্তদের এই মর্মে মুচলেকা দিতে হবে যে, যদি তাঁরা ভবিষ্যতে অযোগ্য প্রমাণিত হন, তাহলে তাঁরা বেতন ফেরত দিতে বাধ্য থাকবেন।

৮,৩২৪ জনের চাকরি বাঁচাতে মরীয়া মমতা

২৫ হাজার ৭৫৩ জনের প্যানেলে ৮,৩২৪ জনের নিয়োগে ঘাপলা থাকাটা কম বড় দুর্নীতি নয়। এই ৮ হাজার ৩২৪ জনের টাকা কার কার পেটে গেছে, কে জানে! শুধু পার্থ চট্টোপাধ্যায় সব মেরে খেয়েছেন, এই কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভবিষ্যতে এতগুলো লোকের চাকরি খারিজ হয়ে গেলে তাঁদের আম-ছালা সব‌ই যাবে। চাকরি যাবে। সুদ সহ বেতন ফেরত দিতে হলে তো সপরিবারে মহা সর্বনাশ হবে এদের। চাকরি পাওয়ার জন্য এক-একজনকে ১০-১২ লক্ষ এমনকি ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে। এদের জীবনে যে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তার দায় কার? আঙুল কার দিকে ওঠা উচিত?

আগামী ১৬ জুলাই নিয়োগ দুর্নীতি মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট। তার মানে এটা নয় যে, সেদিনই চূড়ান্ত রায় দিয়ে দেবে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন চাইবেন, এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে থাকুক। যেনতেন প্রকারে মামলা বিলম্বিত করাই হবে সরকারপক্ষ ও এস‌এসসির কৌঁসুলিদের লক্ষ্য। মামলা সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘদিন বিচারাধীন থাকলেই একমাত্র বাঁচতে পারবে সরকার। যাঁরা নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ন্যায় প্রার্থী, দুর্নীতির কারণে যাঁরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি থেকে বঞ্চিত এবং মামলার তদন্তকারী কেন্দ্রীয় এজেন্সি- সকলকেই সুপ্রিম কোর্টে শক্ত আইনি লড়াই দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

Feature graphic is representational.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *