হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল হলে সাধারণত রায়ের উপরে স্থগিতাদেশ দিয়ে দেয় সুপ্রিম কোর্ট, বিশেষ করে রায়টি যদি কোনও স্পর্শকাতর বিষয়ে হয়ে থাকে। এই মুহূর্তে এসএসসি-র নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্টের রায়ের চেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই ভূ-ভারতেও আছে বলে মনে হয় না। ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে ২৬ হাজার মানুষের চাকরি যাওয়ার মুখে। ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার ও স্কুল সার্ভিস কমিশন। সোমবার (২৯ এপ্রিল) মামলাটি শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে ওঠে। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দেয় নি সুপ্রিম কোর্ট।
ডিডিশন বেঞ্চের রায় ঘোষণা হওয়ার পর তৃণমূলের আইনজীবী নেতা সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বড় মুখ করে বলেছিলেন, মামলা সুপ্রিম কোর্টে উঠলে পাঁচ মিনিটেই স্টে অর্ডার হয়ে যাবে। স্টে অর্ডার তো দূরের কথা, শুনানি চলাকালে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির যে সমস্ত পর্যবেক্ষণ সামনে এসেছে, তাতে মনে হচ্ছে না দেশের শীর্ষ আদালতেও সুবিধা করতে পারবে রাজ্য সরকার। এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ না দেওয়ায় আইনের চোখে এই মুহূর্ত পর্যন্ত ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ বহাল আছে। অর্থাৎ ২৫ হাজার ৭৫৩ জন শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়ে গেছে! হাইকোর্টের রায়ে চাকরিচ্যুতরা ইতিমধ্যেই বলাবলি শুরু করেছেন, যোগ্যদের চাকরি বাঁচাতে নয় বরং নিজের লোকেদের জেলযাত্রা বাঁচাতেই সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে সরকার!
সোমবার সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের স্বস্তির জায়গা বলতে একটিই- ‘সুপারনিউমেরিক পোস্ট’ নিয়ে এক্ষুণি রাজ্য ক্যাবিনেটের সদস্যদের জেরা করতে পারবে না সিবিআই। এসএসসি-র ২০১৬-র প্যানেলে বেআইনি নিয়োগের রাস্তা প্রশস্ত করতে রাজ্য মন্ত্রিসভা অতিরিক্ত শূন্যপদ বা ‘সুপারনিউমেরিক পোস্ট’ তৈরিতে সম্মতি দিয়েছিল বলে অভিযোগ। অভিযোগটি ভয়ঙ্কর এবং তাতে সিলমোহর দিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ। রাজ্য ক্যাবিনেটের যে সভায় ‘সুপারনিউমেরিক’ পোস্ট তৈরির প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল; সেই সভায় উপস্থিত সদস্যদের জেরা এমনকি প্রয়োজনে হেফাজতে নিতে পারবে সিবিআই- এমনই নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ।
রাজ্য ক্যাবিনেটের মাথা মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর উপস্থিতি ও সম্মতি ছাড়া ক্যাবিনেটে কোনও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় না। ‘সুপারনিউমেরিক’ পোস্ট তৈরিতে যুক্ত মন্ত্রিসভার যে কোনও সদস্যকে সিবিআই জেরা করতে ও হেফাজতে নিতে পারবে বলে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। ডিভিশন বেঞ্চের এই নির্দেশের ফলে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সিবিআইয়ের জেরা করার রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেছে বলেই মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। এই পরিস্থিতিতে ‘সুপারনিউমেরিক’ পোস্ট ইস্যুতে ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের উপর সুপ্রিম কোর্টের আদেশে রাজ্য সরকার যে সাময়িক হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষের চোখ-কান খোলা। মুখও কেউ বন্ধ রাখতে পারবে না। তাই পাবলিক বলছে, যোগ্যদের চাকরি বাঁচানোটা উপলক্ষ মাত্র, উনার আসল উদ্দেশ্য তো নিজের পিঠ বাঁচানো।
তবে ‘সুপারনিউমেরিক’ পোস্ট ইস্যুতে রাজ্য সরকারের ফাঁড়া কেটে গেছে বলার সময় এখনও আসে নি। আগামী সোমবার (৬ মে) সুপ্রিম কোর্টে ফের নিয়োগ মামলার শুনানি। এই ক’টাদিনের জন্যই সিবিআইয়ের হাত বেঁধে দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। মমতা-অভিষেক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে যাচ্ছেন, যোগ্যদের চাকরি ফিরিয়ে দেবেনই। বেশ ভাল কথা। ফিরিয়ে দিন। আমরা সবাই চাই যোগ্যদের চাকরি বহাল থাকুক। কিন্তু আদালতের সামনে যোগ্য প্রার্থীদের তালিকা জমা রাখার মুরোদ নেই স্কুল সার্ভিস কমিশনের। এসএসসি এই কাজটা করতে পারলে ২৬ হাজার জনের পুরো প্যানেল অবৈধ ঘোষণা করার মতো কঠোর নির্দেশ দিতে হত না হাইকোর্টকে। এসএসসি-র তো সুপ্রিম কোর্টেও দেখানোর মতো মুখ নেই। নিয়োগ পরীক্ষার ‘ওএমআর’ শিট নষ্ট করে দিয়ে বসে আছেন নিয়োগকর্তারা। যোগ্যদের চিহ্নিত করার উপায় নেই, আদালতের কাছে কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে এসএসসি।
সোমবার সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দুর্নীতি মামলার শুনানি চলাকালে প্যানেলের বাইরে নিয়োগ করা হয়েছে শুনে প্রধান বিচারপতি উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘‘প্যানেলের বাইরে নিয়োগ করা হয়েছে। এটা তো সম্পূর্ণ জালিয়াতি!’’ সুপ্রিম কোর্টে এসএসসি-র আইনজীবী প্রশ্ন তোলেন, “৮ হাজার জনের নিয়োগ বেআইনি ভাবে হলেও ২৬ হাজার চাকরি কেন বাতিল করা হল?’’ এসএসসি-র আইনজীবীর কাছে প্রধান বিচারপতির পাল্টা প্রশ্ন ‘‘বেআইনি ভাবে নিয়োগ হয়েছে, এমন অভিযোগ জানার পরেও কী ভাবে সুপারনিউমেরারি পোস্টের অনুমোদন দিল মন্ত্রিসভা? কেন সুপারনিউমেরারি পোস্ট (বাড়তি পদ) তৈরি করা হল?’’ এরপরেও সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ মামলা নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনও কারণ থাকতে পারে চাকরিচ্যুতদের? অযোগ্যদের সাথে সাথে যোগ্যদেরও বিসর্জন তো মনে হচ্ছে শুধু সময়ের অপেক্ষা।
কোনও সন্দেহ নেই, এক ভয়ঙ্কর সামাজিক বিপর্যয়ের সামনে বাংলা। এই বিপর্যয়ের উৎস এসএসসি ও প্রাথমিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তদের সীমাহীন দুর্নীতি। এই দুর্নীতির অভিযোগে জেলে রাজ্য মন্ত্রিসভার দুই নম্বর ব্যক্তি সহ নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত উচ্চপদস্থ আরও অনেকে। হাইকোর্টের রায়ের পর গোটা রাজ্য মন্ত্রিসভাই নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে পড়েছে। আগামী দিনে বাংলায় কারও পরিণতি লালুপ্রসাদ যাদবের মতো হলে আমরা বিস্মিত হব না।
Feature image is representational.