শ্রেণি ঘৃণার নামে ভিন্ন মতাবলম্বী প্রতিবেশীকে ঘৃণা করার সংস্কৃতির বাংলায় প্রথম আমদানি কিন্তু বামপন্থীদের হাত ধরেই। এই বিষবৃক্ষ আজ ফুলে-ফলে মহীরুহে পরিণত হয়েছে। লিখলেন ঋতুপর্ণা কোলে-
বাংলায় সরকার বদলায় কিন্তু সন্ত্রাস বন্ধ হয় না। রাজনৈতিক হিংসা বাঙালির ডিএনএ-র মধ্যে ঢুকে গেছে। সরকার বদলের সাথে সাথে রাজনৈতিক হিংসার শিকার ও শিকারির স্থান বদল হয় মাত্র। হিংসা ছাড়া বাংলার পার্টি পলিটিক্স আলুনি লাগে তাই নেতারাই দলের কর্মীদের হিংসায় প্ররোচিত করে পরে তাঁরাই আবার শান্তির বারি ঢালেন। সম্পূর্ণ হিংসামুক্ত সমাজ সোনার পাথর বাটির মতোই অলীক। ভারতের অন্যান্য প্রদেশে এখন হিংসা-পাল্টা হিংসা মূলতঃ জাতিগোষ্ঠী, বর্ণ ও ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যেই ঘটে থাকে। কিন্তু রাজনীতিকে কেন্দ্র করে মারামারি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলায় গোষ্ঠী ও জাতপাত নিয়ে সংঘাত কম কিন্তু রাজনৈতিক খুনোখুনি সত্তরের দশক থেকে বঙ্গ জীবনের অঙ্গ বোরোলিনের মতোই। ২০১৬ সাল; বিধান সভা ভোট পরবর্তী চাপা সন্ত্রাস নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কিছু কথা আজ বলতে চাই।
বাবা মা কোনও দলের কর্মী নয়। আমি যাদবপুরের ছাত্রী৷ পাড়ার লোকের মতে বাই ডিফল্ট আমরা বাম সমর্থক। তাই মমতা প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নানারকম অত্যাচারের শিকার। ইতিমধ্যে ২০১৪ সালে লোকসভা ভোট হলো। ভোট দিতে ঢুকলাম। দেখি ভেতরে তিনু কর্মী সবার ভোট দিয়ে দিচ্ছে। আমি ঢুকতেই বলতে শুরু করলো, “১নম্বর বোতামটা টেপো” আমি চিৎকার করে বলে উঠেছিলাম “বেরিয়ে যাও নয়তো ভোট দেবো না” এবং নিজের জেদ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। লোকটি বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলো। বাবাকে সন্ধ্যায় কিছু তিনু কর্মী শাসিয়ে বলেছিলো, “আপনার মেয়ে কাজটা ভালো করেনি।” এরপর শুরু হলো নানা অত্যাচার। বাড়ির সামনে বোম ফেলা, ডিজে বক্স বসানো ইত্যাদি। সবথেকে খারাপ ব্যাপার ছিলো সন্ধ্যে হলেই কিছু প্রতিবেশী (যারা সমকালে তৃণমূল সমর্থক বলে বুক বাজাতো। পরে ভোল বদলে কিছুদিন বিজেপি হতে দেখেছি। এখন আবার তৃণমূল) তাদের বন্ধু বান্ধব ডেকে মদের বোতল নিয়ে আমাদের বাড়ির গেটের সামনে বসে পড়ত এবং সঙ্গে ছিলো মা মাসি উদ্ধার কর গালাগাল। ছোট থেকে যাদের কাকা বলে চিনে এসেছি তারাই অবলীলায় করত এসব। এদের মাঝে বেরিয়ে বারবার প্রতিবাদ করেছি। কাজ হয়নি। বাংলায় শাসকদল করলে অন্যকে শাসানি দেওয়ার অবাধ লাইসেন্স পাওয়া যায়। শুধু এই জন্যই জামানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বহু ধান্ধাবাজ জার্সি বদল করে ফেলে। কতটা নির্লজ্জ হলে অন্য দলকে সমর্থন করার কারণে কেউ প্রতিবেশীর ক্ষতি করতে পারে?
বিধানসভা ভোটে শুনলাম বামেরা পোলিং এজেন্ট পাচ্ছে না। আমি বললাম “আমি হবো”। সেসময়ই আমার এম.ফিলের গবেষণা পত্র জমা করতে হত। আমি এতটাই জেদ ধরেছিলাম যে মা বাধ্য হয়ে বলেছিলো, “তোকে হতে হবে না আমি হবো”। যে মা সারাজীবন ধরে কংগ্রেস সমর্থক সেই মা বামেদের হয়ে পোলিং এজেন্ট হলো। আমি গবেষণা পত্র রেডি করে আসামে গেলাম। ভোটের রেজাল্ট বেরোলো। বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়া, গালিগালাজ ইত্যাদির পাশাপাশি শুরু হলো পরিবারকে চাপ দেওয়া। তিন লাখ টাকা না দিলে আমাকে তুলে নিয়ে যাবে এমন সব হুমকি। যদিও আমরা সেসব পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। তৃণমূলের অনেক কর্মী সেসময় সাপোর্টও দিয়েছিলো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করা অন্যায় হবে। বাবা অধ্যাপক, সেই তৃণমূল কর্মীদের অনেকেই বাবার ছাত্র তাই সুবিধাটা পেয়েছিলাম। অনেকে সত্যিই সেটা পায় না।
আজ বামেদের জেতা প্রার্থী সন্তান হারানোর ভয়ে তৃণমূল হয়ে গেল খবরটা পাওয়া মাত্র সব স্মৃতি একধাক্কায় নেমে এলো। তবে বামেরাও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। আজ তিনু নেতার ব্যালট পেপার খেয়ে নেওয়ার খবর পেলাম। বাম আমলে একই ঘটনা আমাদের গ্রামেই ঘটিয়েছিলো বাম নেতারা। আমার মামাবাড়ির লোকজন কংগ্রেসের সাপোর্টার হবার কারণে বামেরা কীভাবে হাতে ও ভাতে মেরেছিলো আমার দাদুদের তা গ্রামের সকলেই জানে। স্কুল নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীর হাত গরম ফুটন্ত তেলে ডুবিয়ে দিয়েছে, যুধিষ্ঠির দোলুই-এর যৌনাঙ্গ কেটে বামেদের লোফালুফি আজও ভুলিনি। গ্রামের মানুষ এগুলো যতদিন না ভুলবে বামেরা যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। শ্রেণি ঘৃণার নামে ভিন্ন মতাবলম্বী নিজের প্রতিবেশীকে ঘৃণা করার সংস্কৃতির বাংলায় প্রথম আমদানি কিন্তু বামপন্থীদের হাত ধরেই। এই বিষবৃক্ষ আজ ফুলে-ফলে মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
খালি মানুষ ভেবেই চলবে বদলটা কোথায় হলো? মমতা ব্যানার্জি তো বলেছিলেন “বদলা নয় বদল চাই” কিন্তু বাস্তবে বদলাটাই ঘটে যাচ্ছে, বদল কিছুই হয়নি। বদলটা একদিনে সম্ভব নয়। কিন্তু বদল আনার কাজটা শুরু না করে গালে হাত দিয়ে বসে থাকলে কোনও দিনই রাজনৈতিক হিংসার ধারা থেকে মুক্তি পাবে না বাঙালি। যে হেতু রাজনৈতিক হিংসা, তাই রাজনৈতিক দলগুলির সদিচ্ছা ছাড়া সন্ত্রাস-হিংসা নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
Feature image is representational. photo credit- PTI