যাঁরা উপরে লৌহমানবী আর ভেতরের মানুষটা খড়ের, তাঁরাই রায় দেওয়ার ভার জনগণের উপরে ছেড়ে দেওয়ার সাহস পান না। গণতন্ত্র খড়ের মানুষদের জন্য নয়। লিখলেন উত্তম দেব-
ফল ঘোষণার আগেই বাংলার একটা শিশুও জানে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিশাল জয় অবধারিত। কিন্তু এই জয়ে কি তৃণমূলের নেতারা অন্তর থেকে উল্লসিত হতে পারবেন? ক্যামেরার সামনে আনন্দের অভিনয় করতে হয়তো অসুবিধা হবে না। কিন্তু যদি বিবেক বলে কোনও বস্তু তাঁদের থাকে তবে তার দংশন থেকে তাঁরা বাঁচতে পারবেন তো? বিবেক-টিবেক বাদই দিলাম। রাজনৈতিক দিক দিয়েও কি এই বিপুল জয় তাঁদের জন্য স্বস্তির কিছু? মমতা-অভিষেক কি সত্যিই আঠারোর পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে চেয়েছিলেন। নাকি আদৌ চান নি? তাঁদের অন্তরে কী ছিল ঈশ্বর জানেন। তবে ‘নব জোয়ার’ যাত্রায় নেমে মানুষকে শঙ্কামুক্ত করতে শব্দ খরচে কার্পণ্য করেন নি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
শেষ পর্যন্ত তেইশের পঞ্চায়েত নির্বাচন সাঙ্গ হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন সাঙ্গ হয়েছে না পন্ড হয়েছে লোকে এটাই বুঝতে পারছে না। ভোট শেষ হওয়ার পর থেকে পিসি-ভাইপোর একজনও মুখ খোলেন নি। যদিও তৃণমূলের সিকি-আধুলি নেতারা খুশিতে নেচে নেচে বলছেন, তোফা নির্বাচন হয়েছে। মানুষ তাঁদের রঙ্গ দেখে বলছে, অবোধের তো গোবধে আনন্দ, তৃণমূলের কি গণতন্ত্র বধে আনন্দ?
জোচ্চরের বাড়িতে ফলার করতে গেলে না আঁচালে বিশ্বাস নেই। বাংলার মানুষ তো বছরের প্রথম দিন থেকেই অবাধ ও সুষ্ঠু পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে শাসক তৃণমূলের রেপুটেশন জনগণের কাছে এতটাই ভাল। তারপরেও ভাইপোর মিষ্টি বাক্যে ভবি যখন খানিকটা ভুলবো ভুলবো করছিল তখন পিসির অঙ্গুলিহেলনে হঠাৎ করে পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা নতুন নির্বাচন কমিশনারের। নতুন নির্বাচন কমিশনারের নাম ও বদন দেখেই বিরোধীদের বুক ধক করে উঠেছিল। তিনি মাননীয়ার এমনই রেজিস্ট্রার্ড বশংবদ। নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণার পর জনগণের মনে আর কোনও সংশয় রইল না যে, ভোটের ভবিষ্যতের বারোটা বাজানোর ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ দিয়েই এনাকে বসানো হয়েছে।
বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে যিনি খেলায় বিজয়ী হন, তাঁর গৌরব করা সাজে। কিন্তু শকুনির মতো জোচ্চুরি করে যে পাশা জেতে তার দম্ভ পৈশাচিক ছাড়া কিছু নয়। মঙ্গলবার সকালে গণনা কেন্দ্রগুলিতে ব্যালট বাক্স খুলে ঢালা মাত্রই সুনামির ঢেউয়ের মতোই তৃণমূলের জয়ের সংবাদ আসতে থাকবে। কিন্তু এই জয় যে চোরের মতো চুরি করা, ডাকাতের মতো ছিনিয়ে আনা, সেই সত্য হাজার গলাবাজি করেও ঢাকতে পারবেন না তৃণমূলের নেতারা। চুরি-ছ্যাঁচড়ামি করে জয় কি দলটার ‘হ্যাবিটে’ পরিণত হয়েছে? ছাপ্পা ভোট জিনিসটা সারা দেশে তামাদি হয়ে গেছে। ভাবুন, ‘পেটেন্টটা’ বিহার-ইউপির। উন্নাসিক বাঙালি যাদের খোট্টা, ছাতুখোর বলে তাচ্ছিল্য করত, তারা নিজেদের আবিষ্কার করা জিনিস ত্যাগ করেছে কিন্তু তৃণমূল বিহারিদের ফেলে দেওয়া ছাপ্পার নেশা বাঙালিকে ধরিয়ে দিয়েছে। এদিকে তৃণমূলের চুনোপুঁটি থেকে বাকপটু মুখপাত্র- ভোটে ছাপ্পা-সন্ত্রাস নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর একটাই, “কেন বাম আমলে হয় নাই?” শুধু ভোটে ছাপ্পাই নয়; চুরি-ডাকাতি-খুন-ধর্ষণ থেকে নিয়োগ দুর্নীতি- অভিযোগের সম্মুখীন হলেই শাসকদলের ছোট থেকে মাঝারি, বড় সব নেতার এক রা, কেন ৩৪ বছরে দেখেন নাই?
মানুষ কি তবে ‘রিপিট টেলিকাস্ট’ দেখার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দিয়েছেন? গণতন্ত্রে মানুষ সরকার পাল্টায় কেন? যারা সমস্যায় পড়লেই অতীতের অজুহাত দেয়, তারা কীভাবে বাঙালির জীবনে, পশ্চিমবঙ্গে নতুন ভোর আনবে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তেইশের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আঠারোর রিপিট টেলিকাস্ট শেষ পর্যন্ত আটকাতে পারলেন না! এটা ছিল তাঁর সরকারের জন্য একটা মস্ত বড় পরীক্ষা। শনিবারের বাংলা বলছে, তিনি পাশ করতে ব্যর্থ। ছাপ্পা-সন্ত্রাসের ভোটে ৮০ শতাংশ আসনে জয়লাভের থেকে স্বচ্ছ ভোটে টেনেটুনে জয় এমনকি পরাজয়ও অনেক গৌরবের। আমাদের দুর্ভাগ্য, গৌরবের টেনেটুনে জয় কিম্বা পরাজয়ের থেকে অগৌরবের, লজ্জার ৮০-৯০ শতাংশ জয়কেই শ্রেয় বলে মনে করলেন মমতা।
২০১১ সালে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেছিলেন। পঞ্চায়েত ভোটে মৃত্যুর সংখ্যা বাম আমলের থেকে বেশি না কম- ১২ বছর পর এই তুল্যমূল্য বিচারে কেন যাবে মানুষ? মনোনয়ন পর্বের প্রথম দিন থেকে ভোট গ্রহণের আগের দিন পর্যন্ত রাজ্যে মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। ভোটের দিন খুন হয়েছে ১৫ জন। রাজনৈতিক হিংসায় মৃতদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু। রাজ্যের সংখ্যালঘু এলাকাগুলি যেন বারুদের স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে। এই কয়দিনে বল ভেবে খেলতে গিয়ে বোমা ফেটে জখম হয়েছে এক ডজন শিশু! বোমা বিস্ফোরণে গৃহস্থের মৃত্যু কিম্বা হাত-পা উড়ে যাওয়ার ঘটনা যেন জলভাত। এই রাজ্যে বোমা বাঁধা কি কুটির শিল্প? “ভোটে আমার দলের লোকই বেশি মারা গেছে, বিরোধীদের কম”- তৃণমূলের নেতাদের মুখে কী আজব যুক্তি! প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে প্রতিবেশীকে লেলিয়ে দিয়ে এখন লাশ গুণতে গিয়ে বলা হচ্ছে, আমার সংখ্যা বেশি তোমার সংখ্যা কম।
এমার্জেন্সির মধ্যেই সাতাত্তরের বসন্তে লোকসভা নির্বাচন ডেকেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। বিরোধী নেতাদের সবাই জেল থেকে বেরোনোরও সুযোগ পান নি। মানুষের মনে ক্ষোভের বারুদ ছিল ঠাসা। ব্যালটে বিপ্লব করে ইন্দিরাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল জনগণ। গোটা দেশের প্রশাসন তখন ইন্দিরা গান্ধীর হাতের মুঠোয়। প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করার সুযোগ কিন্তু ইন্দিরার সামনে ছিল। কিন্তু নেহেরু কন্যা এই কুৎসিত কর্ম থেকে বিরত ছিলেন। বিরত ছিলেন বলেই ভোটে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেছিল। দৈবের বশে ইন্দিরার পদস্খলন হয়েছিল বটে কিন্তু অন্তরে খড়ের মানুষও ছিলেন না। যাঁরা উপরে লৌহমানবী আর ভেতরের মানুষটা খড়ের, তাঁরাই রায় দেওয়ার ভার জনগণের উপরে ছেড়ে দেওয়ার সাহস পান না। গণতন্ত্র খড়ের মানুষদের জন্য নয়।
Feature image is representational.