পঞ্চায়েত ভোটকে ঘিরে যাকে বলে ল্যাজে-গোবরে, ঠিক সেই দশাই হয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য সরকারের। খারাপ লাগে। কিন্তু কর্ম তো ফল বিনা নিষ্পন্ন হয় না। মহৎকার্যে নেমে কেউ যদি দুষ্টবুদ্ধি আর ভ্রষ্টবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে পরিশেষে তার কপালে লাঞ্ছনাই প্রাপ্য। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে সরকার সদ্বুদ্ধির পরিচয় দিলে এই অবস্থার সৃষ্টি হত না। আবার নির্বাচন কমিশন যদি সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সততা ও সাহসের পরিচয় দিত, তাহলেও পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে অনাকাঙ্খিত জটিলতা তৈরি হত না। গণতন্ত্রে একটি রাজনৈতিক দল জনাদেশ পেয়ে সরকার গঠন করে বটে কিন্তু সরকার গঠনের পর সরকার আর শাসকদল যদি একাত্মা হয়ে যায়, তবে সংবিধানের শাসন ব্যাহত হতে বাধ্য। পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের পরিচয় দিয়ে যে কুকর্মটি করে বসে আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
আকস্মিক পঞ্চায়েত ভোটের সূচি প্রকাশিত হওয়া মাত্রই সবাই বুঝে গিয়েছিলেন, এর পেছনে দুরভিসন্ধি আছে। সঙ্গত কারণেই যা বিচারবিভাগেরও দৃষ্টি এড়ায় নি। নির্বাচন কমিশন কীভাবে নির্বাচন করবে, তা বলে দিচ্ছে সরকার। অদ্ভুতভাবে নির্বাচন কমিশনার তা মেনেও নিচ্ছেন। অথচ ভারতের সংবিধান সচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার যাবতীয় ক্ষমতা কমিশনের হাতে তুলে দিয়েছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশনগুলির ক্ষমতা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের থেকে কোনও অংশে কম নয়। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা তাঁর উপর ন্যস্ত সাংবিধানিক দায়িত্ব বিস্মৃত হয়েছেন বলেই বিরোধীদের বারে বারে আদালতের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। আদালত সংবিধানের রক্ষক। অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ পঞ্চায়েত নির্বাচন করার ব্যাপারে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছার অভাব এতটাই প্রকট যে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ না করে উপায় থাকছে না আদালতের।
বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে বাধা। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরে প্রতীক বরাদ্দের ‘ফর্ম বি’ বিরোধী প্রার্থীদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলা। এমনকি আদালতের নির্দেশে বিরোধী প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরেও তা বাতিল করে দিয়ে শাসকদলের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করা। বিরোধী প্রার্থীদের তরফে জমা পড়া নথি বিকৃত করে দেওয়া। এমন কোনও অসদাচার নেই, যা এই নির্বাচন ঘিরে হচ্ছে না। সবথেকে আশঙ্কার কথা, প্রশাসনের একটি অংশও উল্লেখিত দুর্নীতিগুলির সঙ্গে জড়িত। পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গে ভোট নিয়েও সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছেন বিচারপতি!
পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন পর্বেই সহিংসতার বলি নয়টি প্রাণ। তারপরেও নিরাপত্তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনারের মাথাব্যথা নেই। থাকলে তিনিই স্বতপ্রণোদিত ভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের সুপারিশ করতেন রাজ্য সরকারের কাছে। কিন্তু সরকার ও শাসকদল যেহেতু ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী চায় না, তাই নির্বাচন কমিশনারও কেন্দ্রীয় বাহিনী চান না। মনে হচ্ছে, পঞ্চায়েত ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করার চাইতে শাসকদলের সন্তুষ্টিই উনার কাছে অগ্রাধিকার। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছার অভাব আদালতের নজর এড়ায় নি। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে। রাজ্য ও নির্বাচন কমিশন সুপ্রিম কোর্টে গিয়েও হাইকোর্টের নির্দেশ বদলাতে ব্যর্থ। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোটে কী অরাজকতা চলছে, তা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও জেনে গেছেন। সবথেকে পরিতাপের বিষয়, কেন্দ্রীয় বাহিনী সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশ পালনেও তঞ্চকতার পরিচয় দিয়েছেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা।
দরকার ৮০ হাজার কোম্পানি ফোর্স। নির্বাচন কমিশন বাইশ জেলার জন্য মাত্র বাইশ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছে। ফের আদালতে গেছেন বিরোধীরা। এবার আদালত কমিশনের কান আচ্ছাসে মুলে দিয়েছে বললে ভুল হবে না। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহা তো এমনও বলেছেন, সুষ্ঠু ভোট পরিচালনায় ব্যর্থ হলে রাজ্যপালের কাছে ইস্তফা দিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারেন নির্বাচন কমিশনার। পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের কাছে অভিযোগের পাহাড় জমেছে। সাংবিধানিক প্রধান নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহাকে রাজভবনে তলব করেছিলেন। কিন্তু রাজীব অগ্রাহ্য করেছেন। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে রাজীবের নিয়োগ পত্র স্বাক্ষর না করেই নাবান্নে ফেরত পাঠিয়েছেন রাজ্যপাল। সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার মহাশয় স্বপদে বহাল আছেন কিনা, এখন এটা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন কেউ কেউ। সততা ও সাহসে ভর করে নিজের দায়িত্ব পালনে অটল থাকলে এইভাবে আত্মসম্মান খোয়াতে হত না রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে।
Feature Image is representational.